Wednesday, October 28, 2015

অপরাজিতা

আকাশে নিঃস্বর মঞ্জীর বাজিয়ে চলে যাচ্ছে নক্ষত্রঝড়। জন্মমৃত্যু এক হয়ে গেছে যে বিরাট মোহনায়, তার কিনারপাহাড়ের পাথরে রয়ে গেছে কারুকার্য্য। অন্ধকারে সেই কারুকাজ দেখা যায় না, দেখা যায় না তার বর্ণ।
শেষরাত্রির শনশন পার হয়ে আকাশের কপালে জেগে ওঠে ঊষা, তারপরে জাগে জবাকুসুম সূর্য, কিছু পরেই উজ্জ্বল হয়ে হিরণ্যবর্ণ। সেই আলোতে দেখা যায় চিত্রল কথামালা, রক্তবর্ণ ও হিঙ্গুলবর্ণ রঞ্জকে রঞ্জিত।
ঝিনুক ছড়ানো বালি পার হতে হতে
দক্ষিণ থেকে আরও দক্ষিণে
সরে যেতে থাকে চিত্রা-
আবরণহীন পায়ের তলায়
শিরশিরে সাদা ফেনার সিক্ত আবেদন
যেন বলছে, "ফিরে এসো, ফিরে এসো"
কিন্তু ফেরার তো উপায় নেই চিত্রলেখার !

হাতের দর্পণ ভেঙে গিয়ে
টুকরো টুকরো কাচ চারিদিকে,
ছড়িয়ে পড়া অগণন স্ফটিকে
জ্বলছে একটাই সূর্য-
সেই সূর্য এখন কন্যারাশিতে,
আকাশ অপরাজিতা-নীল।

হিরণ্যরথ আসবে বলে
প্রথমে এলো পবনদূত
তারপরে ঝাঁকে ঝাঁকে নীলকন্ঠ পাখি,
উদয়দিগন্ত থেকে-
কোথায় যেন বাঁশি বেজে ওঠে,
কোথায় যেন বীণা....


অনন্ত আকাশপ্রান্তরে

অনন্ত আকাশপ্রান্তরে
এখন দপদপ করছে নক্ষত্ররাত্রি,
চিরন্তন সেই রহস্য দীপাবলির
ঝিকমিকি আলোর তলায় দাঁড়িয়ে-
তোমার হাতে হাত রেখে শপথ করি
আজীবনের বিশ্বস্ততা ও ভালোবাসার।

আমার এই ক্ষুদ্র ক্ষণায়ু জীবন,
কতবার জ্বলে ওঠে, কতবার ফুরায়-
অনন্তের নখপ্রান্তে একটুখানি ফুলকির মতন,
জন্মে জন্মে কতবার নতুন করে শপথ করি,
সেসব কি তুমি মনে রাখো?

তোমাকে দেখেছি

তোমাকে দেখেছি অগণন ঢেউয়ের ভিতর
আলো-আলো ঢেউ, সমুদ্রবেলাভূমে ভোর-
তোমার অজেয় স্বর ছুঁয়েছে ভিতরঘর
কেটে গেছে ধোঁয়া-ধোঁয়া নীল ঘুমঘোর।

আবারো দেখেছি তোমায় অন্য ঢেউয়ে
যখন নেমেছে পথে মানুষের ঢল
চরাচরে আনন্দসন্ধ্যার আলো ছলছল
সেই বন্যার ঢেউয়ের চূড়ায় চূড়ায়
দেখেছি তোমার মুখ, হাসি-ঝলমল।

আর তোমাকে দেখেছি নক্ষত্রের রাতে
নির্জন নিশিথিনীর বুকের উপর ,
নত হয়ে আছে তোমার তারাময় মুখ
চুপি-চুপি নিশিবাতাস যেন মন্ত্রঘোর।


নূপুরধ্বনি

আলোর পুকুরে হাত ডুবিয়ে দিলে
খলখল করে নেচে ওঠে
গতিময় রঙীন মাছেরা।
ওদের সপ্তবর্ণ পুচ্ছে
রিনিকঝিনিক খুশি ঝলকায়।
চরাচরে বেজে ওঠে
অমলীন শৈশবের নূপুরধ্বনি,
শিমূলফুল রঙের কৈশোর।
অনন্তের হৃদয়স্পর্শী
নক্ষত্রময় স্বপ্নেরা
ছড়িয়ে পড়তে থাকে
আকাশের গহীন বুকে।

জাগরস্বপ্নে

জাগরস্বপ্নে ছলছল করে নদী
আকাশে তখন ইচ্ছেরা মেলে ডানা -
দিগন্তপারে অদেখা দেশের দিকে
উড়াল দিয়েছে ভুলে ঠিক-ঠিকানা।
দিক নেই জানা, পথের নেই হদিশ
তবু তারা ভাসে স্বপ্নের নীল বুকে
চলে যেতে যেতে কেউ দিয়ে যায় গান
স্পর্শপালকে তীব্র বাতাসী সুখে।

Friday, September 4, 2015

তোমার মুখ

তোমার মুখ আলোকিত নীল
তোমার চোখে রোদ্দুরের জরির কাজ
কপালে, চিবুকে আনন্দের চন্দনসাজ।
আমি মাটির ঘর থেকে সসঙ্কোচে
লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাকে দেখি-
আর সাবধানে দীর্ঘশ্বাস গোপণ করে
নিজের মাটিমাখা হাতের দিকে তাকাই।
দু'হাতে ভেজা মাটি ছেনে যথাসাধ্য যত্নে
ছোট্টো ছোট্টো মাটির পুতুল বানাই।
কড়া রোদ্দুরে শুকিয়ে নিয়ে
ওদের গায়ে রঙ দিই,
নীল রঙ, সোনালি রঙ, সাদা রঙ-
স্বপ্ন দেখি একদিন সেই নীলে আকাশ ফুটবে
সেই সোনালিতে রোদ্দুরের ঝিকিমিকি,
সেই সাদায় আনন্দের জ্যোৎস্না ফুটে উঠবে।
কিছুই ফোটে না,
আমার মাটির পুতুলেরা
ব্যথানীল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শুধু।

ফিরে আসা

ছোট্টো একটা কচিমুখের
দুধে-দাঁত ঝিকমিকানো হাসি
একবার আমাকে ফিরিয়ে এনেছিল
ধূসর বিস্মৃতির ভয়ংকর বালিয়াড়ি থেকে,
সবুজের ছায়াজাল আঁকা স্মৃতির সরণীতে।

আকাশি জমিনের উপরে লাল বুটি বুটি দেওয়া
তাঁতের শাড়ীখানার চেনা সুগন্ধ
একবার আমাকে ফিরিয়ে এনেছিল
তামসী রাত্রির অন্ধকারযাত্রা থেকে
কোমল ভোরের শিশির-টলটল আলোয়।

শিরতোলা দুটি ঝিনুকের খোলা পাশাপাশি সাজানো ছিল
দেখনবাক্সের কাচের দেওয়ালের ভিতরে,
কোনোদিন হয়তো ইচ্ছেমুক্তো ছিল
ওদের কবেকার ভুলে যাওয়া শরীরে।
একদিন ওদের দিকে তাকিয়েই ফিরে এসেছিলাম
প্রতিদিনের মাটি-বালি-পাথরের সংসারে,
ঝড়ের সমুদ্রকে বিদায় জানিয়ে লবণাক্ত অশ্রুর অর্ঘ্যে।

স্বর-ব্যঞ্জন লিপি

একপাতে রাখা স্বরলিপি আর
অন্য পাতায় ব্যঞ্জন,
থালায় সাজানো জরিবুটি ঘিরে
বোবা শরীরের রঞ্জন।

জ্বলেছে পুড়েছে তন্দুর আর
উঠেছে আগুন গনগন,
মশলার ঝাঁঝ চোখেমুখে আর
হাতে হাতা বেড়ি ঝন্‌ঝন্‌ ।

ছুরি কাঁচি বঁটি কুড়ুনি
খুঁড়ে খুঁড়ে গেছে নন্দন,
পাথরফলার ডান্ডায়
শিলে বাটা হলো ক্রন্দন।

গেলাসে গেলাসে নোনাপানি আর
টুকরো লেবুর স্পন্দন,
উড়েছে ঘুরেছে চাপা ছাই
আর চৈত্রবনের চন্দন।

ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো যদি বলি

ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো যদি বলি
করবে কি ক্ষমা, ধরবে কি এসে হাত?
কবে কোথায় হারিয়েছে ধূলিখেলা
কোন্ অমারাতে লুকিয়ে গিয়েছে চাঁদ।

এখনো অনেক পথ তো রয়েছে বাকি
দু'পায়ে এখনই এত যে ক্লান্তি কেন!
খররৌদ্রের দুপুর এখনও ঢলেনি
এখনই দু'চোখে এত ঘুম নামে কেন?

পথের গোলাপ তৃষ্ণা নিয়েছে ছিঁড়ে
নগ্ন দু'পায়ে কেবলই কাঁটারা ফোটে,
গোড়ালি ছাপিয়ে অবুঝ রক্ত ঝরে,
বুকের পুকুরে নিঝুম দুপুর জোটে।

ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো যদি বলি,
আসবে কি তুমি, ধরবে কি এসে হাত?
স্মৃতিবেদনার গহীন প্রহর থেকে
উদ্ধার করে ঘুচাবে কি পরমাদ?

Through The Starry Darkness

I walked through starry darkness of a summer night
Following the footprints you left on the sand of time-
No one knew about my lonely search
Except the night sky which kept it memory well hidden
Inside the wings of glowing nocturnal clouds.

You came back when I disappeared into the mist
Just like a cloud which easily disappears into thin air-
You found one blue feather on my doorstep
Along with tiny dried petals of a red flower.

New Dawn

Hidden inside the glittering foil of pleasure
There exists a secret agony, a longing-
Like a lonely butterfly
It is flying around in autumn garden
Going from one tree to another.

It is flapping its wings
Against the red and orange leaves,
The leaves ready to fall
And disappear into darkness.

Above them up in the air –
Soft white clouds are losing their glory
To foggy and grey time of winter.

Somewhere far away-
Someone is waiting sleeplessly,
Inside the prison of time.
He still hopes to free the messenger dove
The free bird will across the empty dark void
To reach the heart of a new dawn.

Alphabets

Our alphabets fell asleep
Me and you sat by their side-
Silent, sad and exhausted.

We still had our senses to feel
We saw the shades of grey,
We heard the noise of discord
We smelled the scent of melancholy
We tasted bitter sweet,
And we felt cold, very cold -
So we embraced each other.
At that moment –
Alphabets woke up one by one
And we began our poems and songs
To flow without end.

The Blood-Red Moon

Storming through the ocean
The wild one reached the blue hills of the coast
And suddenly stood there, silent.
Grey clouds filled his hairs
An unknown light flickered in his bright eyes.

A strange moon rose from the horizon
It was as red as blood-
Then the giant waves rose high
The great drama began to unfold.

কাছে কাছে থাকি

তোকে ছেড়ে যাইনি কখনও
সবসময়েই কাছে কাছে থাকি,
একসাথেই কলাপাতায় সাজিয়ে দিই
চাট্টি গরম ভাত, এক হাতা মুসুর ডাল
একচিমটি লবণ, একটুকরো পাতিলেবু-
খেতে খেতে কত কথা হয়
হাসিকথা দুঃখকথা আনন্দকথা ব্যথাকথা
তবু তুই ভয় পাস আমি দূরে যাবো বলে?

সেই যে তোর বুকের মধ্যে লেবুপাতার গন্ধ ছিল-
আমি বলতাম তোর মধ্যে লেবুর বাগান বুঝি?
আছে সেই বাগান এখনও?
ঐ যে আমাদের সজনেগাছে
থাকতো দুটি কাঠবেড়ালী?
সজনেতলায় দৌড়োদৌড়ি করে
খেলে বেড়াতো ঝিমদুপুরে?
ওরা কোথায় আজ?
ঐ যে টালির চালের ঘরে
বাসা বানাতো দুই চড়াইপাখি?
আমরা ওদের নাম দিয়েছিলাম
ইমন আর রূপসা?
ওরা কোথায় গেল?

আমি আজ পাহাড়ী নদীতীরে
তুই আজ দূর সমুদ্রের কিনারায়-
তবু কিন্তু কাছে কাছে থাকি আমরা।
ইমন রূপসা কাঠবেড়ালী লেবুর বাগান-
সবাই আছে আমাদের ঘিরে-
বাইরে নাই বা রইলো!

তোকে ছেড়ে যাইনি কখনও-
কাছে কাছেই আছি,
কাছে কাছেই থাকি।
চিরদিন।

জ্যোৎস্না-জরি

আমাকে দেউলিয়া করে চলে যায় চাঁদ
পথে পথে পড়ে থাকে টুকরো টুকরো
জ্যোৎস্নার রুপোলি জরি।
আকাশের নীল ভেলভেটে
দপদপ করে জ্বলে সুদূরের নক্ষত্রেরা-
শক্তিময় কিন্তু নিরাসক্ত।

রাত্রির জঙ্গলে পথ হারিয়ে
একবার একদিকে ছুটে যাই
একবার তার বিপরীত দিকে-
ধ্রুবতারা দেখতে পাই না।
আসন্ন শীতের দিনের কথা ভেবে
ভীরু গাছেরা নীরব হয়ে আছে
ওদের সবুজ পাতার আঁচলে
এবারে পড়তে শুরু করবে
লাল-বাদামী-খয়েরী বিদায় অক্ষর।

এমন সব সময়েই তোকে মনে পড়ে,
শীতভীরু পাখির যেমন মনে পড়ে
সূর্য-ঝলমল বসন্তদিন, তেমনই।
ওরা ডানা মেলে উড়াল দেবে
দক্ষিণের বসন্তের দেশের দিকে,
আমার ডানা দুটি বন্ধক দেওয়া আছে বলে
এবারেও আর উড়াল দেওয়া হবে না।

আমাকে নিঃস্ব করে চলে গেল চাঁদ
পথে পথে অবহেলায় ছড়িয়ে পড়ে আছে
ওর ফেলে যাওয়া জ্যোৎস্নার জরি।

Tuesday, February 24, 2015

উশীরস্রোতা

১।
সৃঞ্জয় বললো, " কী, কেমন লাগছে এখন ? "
ভোরের হাওয়া ঠান্ডা বেশ, আমি স্কার্ফটা গলায় ভালো করে জড়াতে জড়াতে হেসে বলি, " ভালো লাগছে। এখন বেশ ভালো লাগছে। আসলে কালকে একটু বেশী আবেগের পাল্লায় পড়ে গেছিলাম। এখানে আসা যেন একটা স্বপ্নের মতন ব্যাপার, কে জানতো এভাবে এখানে আসা হবে? "
সৃঞ্জয় হাসে, আমি আরো চওড়া করে হাসি। কী আর করার আছে এখন? বিস্ময় এত বেশী যে কোনো কথা দিয়েই তা প্রকাশ করা সম্ভব না।নিজের বাচ্চাবয়সের কথা মনে হয়, তখন প্রত্যেকটা দিন এমন অমলীন বিস্ময়ে ভরে থাকতো, কী পালকের মতন হাল্কা ছিলো সেই জীবন!
এখানে দুপুরবেলাগুলো খুব গরম। তাই খুব ভোরবেলাতেই আমরা সেতু পার হয়ে এসেছি নদীর পশ্চিমে। এই নদীর বর্তমান নাম উশীত্থা। সুপ্রাচীনকালে এর নাম ছিল উশীরস্রোতা। সুগন্ধি উশীর তৃণ জন্মাতো এর তীরে। এখন নদীটা প্রায় শুকনো, বালি-বালি খাতের ঠিক মাঝখান দিয়ে সরু একটা জলস্রোত ধীরে ধীরে বয়ে যাচ্ছে। তবে বর্ষায় উত্তরে ঢল নামলে নাকি জল অনেক বাড়ে, তখন গোটা নদীখাতটাই ভরে ওঠে। নদীর উপরে পাকাপোক্ত ব্রীজ, গাড়ী চলতে পারে। ও পথেই এসেছি আমরা। আমাদের সারথী এখানকার স্থানীয় একজন লোক, হোটেল থেকেই আমাদের জন্য ঠিক করে দিয়েছে এই গাড়ী আর ড্রাইভারকে।
এখন আমরা গাড়ী থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছি নদীর পশ্চিমপারে। সামনেই নীল আকাশে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের পর পাহাড়। বাদামী, কালো, ধূসর বা বালিরঙ পাহাড়। ঋজু, উদ্ধত, কঠিন, শিলাময়, বৃক্ষবিরল পাহাড়ের সারি। এখানে জমিও খুব শুকনো, গাছপালা প্রায় নেই, মাঝে মাঝে একরকম কর্কশ ঘাস আর কন্টকগুল্ম দেখতে পাই।
কাছেই একটা ছোটো বাজারমতন, সেখানে পথের পাশের চায়ের দোকানে সবে উনুনে আগুন দিয়েছে। চা আর কিছু খাবার অর্ডার দিয়ে দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চিতে বসি আমরা। আমাদের অবাক করে দিয়ে খুব তাড়াতাড়িই এসে যায় চা, খাবার। সূর্যোদয়ের সময় হয়ে গেছিল, চা খেতে খেতেই দেখি পাহাড়ের চূড়াগুলো সকালের আবীরলাল আলোয় রঙীন হয়ে উঠে উঠে তারপরে গোলাপী থেকে সোনালী হয়ে উঠলো।
খাওয়া শেষ হলে আমরা রওনা হই সমাধি-পাহাড়ের দিকে। সম্রাজ্ঞীর খোঁজে যেতে হলে ঐখানেই তো যেতে হবে। সমাধি পাহাড়েই পরজীবনের প্রাসাদ। কয়েক হাজার বছর আগে রাণী সপ্তাশ্বসুতা তৈরী করিয়েছিলেন নিজের আর প্রিয়জনেদের জন্য। পার্থিব জীবনের সামান্য সময়টুকুর পরে বিস্তৃত যে অনন্ত জীবনকে তাঁরা জানতেন, সেই জীবনের জন্য।
সেখানে পৌঁছে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি সেই সুপ্রাচীন প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের সামনে। সপ্তাশ্বসুতা! মহারাণী, সম্রাজ্ঞী! সম্রাজ্ঞী নিজেকে বলতেন সূর্যসম্ভূতা। স্বয়ং সূর্যদেব নাকি নেমে এসে তাঁর পিতার মধ্যে প্রবেশ করে তাঁর জননীর সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁকে সৃজন করেছিলেন। প্রাচীরের চিত্রমালায় সেই মহাপবিত্র ঘটনার কিছু কিছু ব্যাপার নাকি খোদাই করে রাখা হয়েছে।
আসলে কেমন ছিল সে? কেমন করে সে ভাবতো, হাঁটতো, সাজতো, কথা বলতো? কেমন করে কাটতো তার গ্রীষ্ম বর্ষা শীত বসন্ত? কোনোদিন, সেই হাজার বছর আগে, তার কিশোরী বয়সে এইরকম কোনো সকালে সে কি তার কোনো চাহনেওয়ালার কথা ভাবছিলো? পুরানো পাথরের টুকরোয় কিংবা প্রাচীরে বা মেঝেয় আঁকা ছবিতে অথবা লেখা কাহিনিতে কি সময় আটকে থাকতে পারে? ধরা দিতে পারে পূর্ণ, সজীব, স্পন্দিত সেই হারানো জীবন? সেই মেয়েটিকে দেখতে চাই, সেই সূর্যসম্ভূতাকে। খুবই কি আশ্চর্য আর অন্যরকম ছিলো সে? একদম শৈশব থেকে ? নাকি সেই শৈশবে কৈশোরে আর পাঁচটা মেয়ের মতই সাধারণ ছিলো, পরে রাজত্বের দায়িত্ব আর রাজনৈতিক কূটকৌশল তাকে বদলে দিলো?
"শ্রমণা, কী হোলো? এতক্ষণ ধরে ডাকছি, সাড়া দিচ্ছ না যে! " মনের ভুলভুলাইয়া থেকে বাস্তবে ফিরে আসি সৃঞ্জয়ের ডাকে।
বলি, "ডাকছিলে নাকি? আরে আমিও যেমন! কী যেন ভাবতে ভাবতে..... ডাকছিলে কেন? "
সৃঞ্জয় আমার হাত ধরে নিয়ে যায় পাথরের সিঁড়ির দিকে, প্রাসাদে ঢুকতে গেলে আমাদের উঠতে হবে সেদিক দিয়েই।
সৃঞ্জয় বলতে থাকে, " কেন এরকম বারে বারে বেসামাল হয়ে যাও? তুমি নিজে ইতিহাসের ছাত্রী, তোমার গাইড ডঃ প্রসাদ কতবার বলেছেন আবেগ মিশিয়ে ফেললে আর নিরপেক্ষ ইতিহাসচর্চা হয় না? তুমি তবু কেন এরকম হয়ে যাও? এখানে এসে এইসব এলাহী কান্ড দেখে বেসামাল হবার কথা তো আমার! আমি তো ইতিহাসে পোড়খাওয়া লোক না। " সৃঞ্জয় হাসে, ওর হাসির সঙ্গে তাল দিতে আমিও হেসে উঠি।
সিঁড়ির কাছে এসে অদ্ভুত একটা ভয়ে আমার ভিতর-বাহির শিরশির করতে থাকে, অসহায় জ্বরগ্রস্তের মতন সৃঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলি, " আজ থাক। আমার শরীর কেমন করছে, মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে যাবো। "
সৃঞ্জয় আমাকে সাবধানে ধরে ধরে সরিয়ে নিয়ে আসে সিঁড়ির কাছ থেকে, বলে, "থাক তবে। কী হোলো তোমার? মুখচোখ একদম ছাইয়ের মতন দেখাচ্ছে। চলো, আজ ফিরেই যাই।"

আমরা এ শহরে এসেছি গতকাল। এখানে তিনদিন, তারপরে অন্য শহরে যাত্রা। পুরো ঘোরাঘুরির জন্য হাতে মোট পনেরোদিন আছে । অথচ কী তীব্র অস্থিরতা আমার ভিতরে ঘূর্ণী তুলছে ! মনে হচ্ছে যথেষ্ট সময় নেই। কোনোদিন আগে যে দেশ দেখিনি, কেন সেখানে আগে কখনো এসেছি বলে মনে হয়? কেন পথের এক-একটা বাঁকে এসে চমকে উঠি, এ যেন চেনা!
কিন্তু তাতো হতে পারে না! সৃঞ্জয় বলে যে আমি খুব বেশীরকম কল্পনাপ্রবণ। ছোটোবেলা থেকে গল্প আর ইতিহাস পড়ে পড়ে সব মিলিয়েমিশিয়ে নাকি ঘেঁটে ফেলেছি! এরকম হলেই নাকি এরকম অচেনা জায়গা চেনাচেনা ঠেকে !
ফিরে আসি নদীর অন্য পাড়ে, ছোটো একটা দোকানে ঢুকে ঠান্ডা পানীয় খেতে খেতে জুড়াতে থাকি ক্লান্ত শরীর আর আলোড়িত অনুভবকে গুছিয়ে আনতে থাকি যথাসম্ভব। তারপরে মিউজিয়ামে যাই, আমাদের পরিচিত বন্ধু একজন আছেন সেখানে।
সন্ধ্যাবেলা রওনা হই সরাইয়ে ফেরার জন্য, তখন অন্ধকার বেশ গাঢ়। আকাশের দিকে চেয়ে আবার কেমন হয়ে যাই। মরুভূমির রাত্রি অপরূপ! একসাথে এত তারা, এত তারা! একেবারে ঝকঝক করছে! হাল্কা ওড়নার মতন দেখা যাচ্ছে ছায়াপথ। এরকম কবে দেখেছিলাম, কোনোদিন দেখেছিলাম কি? হয়তো দেখেছিলাম কোনোদিন।
হয়তো সে এ জন্মে নয়, হয়তো বহুজন্ম আগে যখন এই বালির টিলাগুলোর পাশ দিয়ে যে পথ চলে গেছে পাথরের সীমানা দেওয়া গাঁয়ের দিকে, সেই পথে হাঁটতাম। রঙীন ঘাঘরা-চোলি থাকতো আমার অঙ্গে, কাঁখে থাকতো কলস, সখীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাসতে হাসতে জল নিয়ে ফিরতাম ঘরে। মরুগোলাপের ঘ্রাণ আমাদের মনকে উচাটন করতো!
সৃঞ্জয়কে এসব বলা বৃথা, আমি নিজের ডাইরিতে এইসব লিখে রাখবো। বহু হাজার বছরের যবনিকা কি খুলবে? জ্ঞান উন্মেষের সময় থেকে আজ পর্যন্ত যে মানুষটাকে খুঁজছি আমি, তাকে কি পাবো?
বহু বছর আগের কথা মনে পড়ে, একটা ছোট্টো বাড়ী, তার ছাদে উঠে চেয়ে আছি পশ্চিমের দিকে, পশ্চিমে খোলা ধানক্ষেত, আদিগন্ত আকাশ তার উপরে উপুড় হয়ে পড়েছে, সূর্যাস্তকালের রঙীন মেঘেরা চারিদিক রঙীন করে দিয়েছে, সন্ধ্যাতারাটি সবে চোখ মেলেছে। সেইসব সময়ে আমার মনে আসতো এক আশ্চর্য মানুষের কথা, কত হাজার মাইল ব্যবধান আর কত হাজার বছরের দূরত্ব থেকে আমার দিকে চেয়ে থাকতো তার দুটি গভীর কালো চোখ। রাতের স্বপ্নেও ফিরে ফিরে আসতো সে। কাউকে বলতে পারিনি তার কথা, কাউকে না। কী করে বলবো, আমিই কি জানতাম সে আসলে কে?
সৃঞ্জয় এসব বুঝবে না বা হয়তো ভুল বুঝবে, সেই আশঙ্কায় ওকে কিছু বলতেও পারছি না। সে এমনিতে আমার খুব ভালো বন্ধু, বন্ধুরও বেশি কি? বুঝতে পারি না। সে নিজে কী মনে করে আমাকে? বন্ধু? নাকি তার অনেক বেশী?

২।
রাতে হোটেলে ফিরে সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে ক্লান্ত সৃঞ্জয় অঘোরে ঘুমোচ্ছিলো। আমি ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে বসে বসে ভাবছিলাম! ভাবনাগুলো যেন শত শত রঙীন সুতো, একটা আরেকটার সঙ্গে জড়িয়ে জড়িয়ে ভয়ানক জট পাকিয়ে যাচ্ছিল।
তারপরে নিজেও শুয়ে পড়লাম । ঘুম আসে না। মনে পড়ে সৃঞ্জয়ের পাগলের মতন ভালোবাসার মুহূর্তগুলো। কিন্তু সেইসব মুহূর্তেও কেন আমার মন আলগা হয়ে যায়? কেন অজানা বিষাদ এসে জমে বুকের খুব ভিতরে?
আমার জীবনটা আর পাঁচজন মানুষের মতন সহজ সরল হলে কত ভালো হতো! কিন্তু তা নয় কেন? কেন ভিতরে বারে বারে জেগে ওঠে সেই রহস্যময় সত্তা? ভিতর থেকে ফিসফিস করে কী যেন বলে। একটা কী যেন সমাধান হওয়া বাকী আছে, সেটা সমাধান না হলে কিছুই হবে না।
নাইট ল্যাম্পের নরম হাল্কা আলো ঘরে, রুম ফ্রেশনারের মৃদু সুগন্ধ ভেসে বেড়ায় ঘরের বাতাসে। এইসবের মধ্যে চুপ করে চোখে চেয়ে শুয়ে থাকি, মনের ভিতরে কে যেন ডাকতে থাকে, আয় আয়। কে সে? কে ডাকে? কোথায় যেতে ডাকে? সপ্তাশ্বসুতার পরজীবনের প্রাসাদে? ক্লান্তি একসময় জয়ী হয়, দু'চোখ লেগে আসে।
চার ঘোড়ার রথে বসে আছেন এক তেজদীপ্তা মধ্যবয়সিনী নারী, সুশোভন বেশ তার, কিন্তু বস্ত্র রঙীন নয়, শুভ্র। দীর্ঘ গ্রীবায় মহার্ঘ্য রত্নহার। দুই কান থেকে দুলছে হীরকখচিত কর্ণাভরণ। মাথার দীর্ঘ কেশ জড়িয়ে তুলে চূড়া করে মাথার উপরে বাঁধা, চূড়া ঘিরে রত্নমুকুট। চোখে দীর্ঘ করে টানা কাজলরেখা। কিন্তু এইসব সাজসজ্জা অলংকার সব ছাপিয়ে উপচে পড়ছে সেই আশ্চর্য নারীর অকুন্ঠিত তেজের দীপ্তি, বোঝা যায় অনেক ক্ষমতার অধিকারিনী।
রথে এঁর পাশে বসে আছে এক কিশোরী, অদ্ভুত মায়া-মায়া মুখ তার, চোখে স্বপ্ন। এর বস্ত্রালঙ্কারের তত বাহুল্য নেই, শ্বেত বসন আর নীলাভ সাদা উত্তরীয়। গলায় ফুলের মালা। চুলগুলি জড়িয়ে তুলে ফুলের মালা দিয়ে বেষ্টন করে রাখা। এর হাতে পূজার থালি, সম্ভবত কোনো মন্দিরের দিকে যাচ্ছেন এঁরা।
রথ চালাচ্ছে এক তরুণ, এর পরনে শ্বেতবসন, উর্ধাঙ্গে শুভ্র উত্তরীয়। এর মাথার চুলগুলো ক্ষুদ্র, সারা গায়ে কোনো অলংকার নেই দেখে মনে হয় বুঝি খুব সাধারণ সামান্য অবস্থার মানুষ। কিন্তু মুখচোখ দেখে তেজোদ্দীপ্ত যোদ্ধার মতন মনে হয়। এর চোখের মণি গভীর, যেন কীসের রহস্য সেখানে। এরই দিকে কেমন অদ্ভুত কোমল চোখে চেয়ে আছে কিশোরী মেয়েটি।
ভোরের নরম হাওয়া এসে লাগে গালে কপালে, ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্নেদেখা কিশোরী মেয়েটি আর রথচালক তরুণ কিন্তু স্মৃতিতে তাজা হয়ে থাকে তখনো। কে ঐ মেয়েটি আর ছেলেটি? ওদের কেন চিনি চিনি মনে হয়? ওদেরই খোঁজে কি আসলে এসেছি এখানে? যা আমার সচেতন মন জানে না কিন্তু ভিতরের মন জানে? কোথায় পাবো ওদের? এই হাজার হাজার বছরের বিস্মৃতির ধূলা সরিয়ে কেমন করে বার করবো ওদের? আর বার করেই বা কী হবে? কোনো সার্থকতা কি আর থাকতে পারে এই এত হাজার বছর পরে?

৩।
আজ সপ্তাশ্বসুতার প্রাসাদ ঘুরে দেখে এসেছি সৃঞ্জয় আর আমি। এখনো আমাদের বিস্ময়ের রেশ ফুরায় নি। ফেরার পথে পুরোটা সময় ধরেই কেবল সেই হাজার বছর আগের মানুষের অতিমানুষিক কীর্তির কথাই বলাবলি করছিলাম দু'জনে। আধুনিক প্রযুক্তির কোনো সাহায্য ছাড়া ঐসব বিশাল বিশাল স্থাপত্য আর অতি উঁচুদরের ভাস্কর্য কী করে তারা করলো? এ আজও এক রহস্য আমাদের কাছে। আমাদের অতীত আর বর্তমানের মাঝখানে যেন এক অনতিক্রম্য শূন্যতা, কোথায় যেন যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছি আমরা।
বেলা তখনো ছিল অনেক। হোটেলে ফিরতে ভালো লাগলো না, বসলাম গিয়ে নদীর পাশে গাছের ছায়ায়। অনেক কথা বলার পরে আর অনেক বিস্ময়ের ঝলসানির পরে যেন ছায়ার নিচে একটুকরো শান্তি। ওপারে দেখা যাচ্ছিল দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, মাঝে মাঝে টিলা। আমরা আর কথা বলছিলাম না, নদীর কলধ্বনি শুনছিলাম, নদীটা যেন আমাদের গান গেয়ে শোনাচ্ছিল। সেই গানের মধ্যে করুণ এক সুপ্রাচীন কাহিনি শুনছিলাম আমি। নিজের অজান্তে কখন চোখ ভরে উঠলো জলে।
গাছের ছায়ায় ঘাসের উপরে শুয়ে পড়লো সৃঞ্জয়, মাথার নিচে নিজের ব্যাগখানা বালিশের মতন করে দিয়েছে। দিব্যি চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়লো কয়েক মিনিটের মধ্যে। আমি নিজেও গাছের কান্ডে মাথা হেলিয়ে দিলাম।
হঠাৎ শুনি মধ্যরাত্রির প্রহর বাজলো কোথায় যেন, আকাশ তারায় তারায় ছেয়ে আছে। এখন কৃষ্ণপক্ষ। চাঁদ উঠবে একেবারে শেষরাত্রে। অন্ধকারের ভিতর থেকে শুনি ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ, তার সঙ্গে মাটির উপরে কাঠের চাকার ঘর্ষণের শব্দ। একটা অশ্ববাহিত রথ আসছে, বেশ আস্তে আস্তে, চুপিচুপি। নদীর কিনারে ঝুপসি একটা গাছের নিচে এসে থামলো রথ, রথারোহী ও চালক বলতে একজনই ছিল। সে নামলো। নিবিড় নীল উত্তরীয়ে মাথা থেকে পা অবধি আবৃত তার। ঘোড়াটাকে রথ থেকে খুলে ঘোড়ার পিঠে আলতো চাপড় দিয়ে কী যেন বললো, মুক্ত ঘোড়াটা নদীতীরের তৃণভূমিতে নেমে গেল।
নিবিড় নীল উত্তরীয়ে আবৃত মানুষটি এইবার নদীতীর বরাবর চলতে শুরু করলো। বাদামী পাহাড়ের পায়ের কাছে নদী যেখানে একটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে চলে গেছে উত্তর-পূর্বে, সেইখানে এসে সে থামলো। পাহাড়ের গায়ের খাঁজগুলো সিঁড়ির মতন, খাঁজে খাঁজে সাবধানে পা রেখে সে উঠলো খানিকটা, এসে পৌঁছলো একটা পাথুরে চাতালে। চাতাল পেরোলেই একটা গুহামুখ, আলগা একটা পাথর গড়িয়ে এনে গুহামুখ বন্ধ করা হয়েছে।
মুখ ও মাথা থেকে উত্তরীয়ের আবরণ সরালো মানুষটা। এইবারে তাকে চিনতে পারলাম, সে ঐ কিশোরী মেয়েটি, আগে যাকে পূজা দিতে যেতে দেখেছিলাম। মুখের কাছে দুই হাত জড়ো করে সে এক অদ্ভুত শব্দ করলো, রাতপাখির ডাকের মতন সে আওয়াজ কিন্তু তার মধ্যে যেন মিশে আছে সাংকেতিক আহ্বান। একবার, দুইবার, তিনবার ডাক দিল সে। তিনবারের পর চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো খানিকক্ষণ। উত্তর এলো তখন। ঠিক ওরকম আওয়াজ। পাহাড়ের অন্যদিক থেকে উঠে এলো আরেক মানুষ, মুখের ঢাকা সরাতেই চিনতে পারলাম, আগেরবারে দেখা সেই রথচালক তরুণ।
কিশোরী মেয়েটি দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ছেলেটিকে, তাদের সম্মিলিত মিষ্টি হাসির রেশ ছড়িয়ে গেল রাত্রির বাতাসে। তারা গুহামুখের পাথর ঠেলে সরিয়ে গুহায় ঢুকে গেল। অন্ধকারে তারা দেখতে পায় নি শ্বাপদের মতন তীক্ষ্ণ দুটি চোখ তাদের লক্ষ করেছে, রাজার নিয়োগ করা গুপ্তচর। অন্ধকারে মিশে থেকে সে অনুসরণ করেছে একদম শুরু থেকে। নিঃশব্দ দ্রুতগতিতে পাহাড়ের কাছ থেকে রাজবাড়ীর দিকে দৌড়ে চলে গেল সেই গুপ্তচর।
" শ্রমণা, শ্রমণা! " – কে যেন কাঁধে নাড়া দিচ্ছে। চোখ মেলে দেখি সৃঞ্জয়, সে জেগে গেছে। আমায় জাগাচ্ছে। সবটাই স্বপ্ন ছিল। মাথা তুলে দেখি বেলা পড়ে আসছে, ছায়া দীর্ঘ হয়েছে। এবারে হোটেলে ফিরতে হবে আমাদের।
উশীরস্রোতার দিকে এগিয়ে গেলাম, জলে হাত ডুবিয়ে আস্তে আস্তে বললাম, "আসি।" নদী কলস্বরে কী বললো কেজানে! এমন কত মানুষ এসেছে, কত গেছে, নদী কাকেই বা মনে রেখেছে !
আমরা ফিরে চললাম পান্থনিবাসের দিকে। আগামীকাল দুপুরে আমাদের অন্য শহরের দিকে যাত্রা। নদীটাকে হয়তো আর ছোঁয়া হবে না। যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে তাকালাম, কেন যেন মনে হচ্ছিল কেউ ডাকছিল। মনের ভুল নিশ্চয়। সেই রহস্যময় মানুষটাকে কোথাও কি খুঁজে পাবো কোনোদিন? নাকি সে আমার নিজের মনের বানানো গল্প একটা? সবটাই কল্পনা?

৪।
হোটেলে ফিরে কিছুক্ষণ টিভি দেখলাম। রাতের খাবার সময় হয়ে গেছিল কিন্তু আমার একটুও খিদে ছিল না। খানিকক্ষণ সাধাসাধি করে সৃঞ্জয় একাই গেল ডিনার খেতে। আমি ব্যালকনিতে গিয়ে বসলাম এক গেলাস অরেঞ্জ জুস নিয়ে।
আকাশ তারায় তারায় ছেয়ে আছে ঠিক সেই স্বপ্নটার মতন। ওদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আচ্ছন্ন হয়ে আসে দু'চোখ। আবার দেখি সেই কিশোরীকে, আজকে সে সাদাসিধে পোশাকে না, আজকে তার জমকালো রাজকীয় পোশাক, সর্বাঙ্গে হীরামণিমুক্তার অলঙ্কার ঝলকাচ্ছে। আজ তার রাজ্যাভিষেক। তার নাম ছিল হেমা, কিন্তু আজ থেকে সে আর হেমা নয়, তার পূর্বজীবন মুছে গেছে, আজ থেকে সে সূর্যসম্ভূতা সপ্তাশ্বসুতা। কিন্তু ওর দীপ্ত কালো চোখের মণির গভীরে দেখি টলটলে জল, যেন উশীরস্রোতা বয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে সেখানে আগুনও জ্বলে ওঠে।
স্বপ্নের মধ্যে ছুঁতে পারি হেমার বেদনাস্পন্দিত হৃদয়, সেখানে থেমে আছে আছে সেই তরুণের নিথর মুখ, বুকে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত। হেমা সেই রাত্রে নির্বিঘ্নেই ঘরে ফিরে নিজের শয্যায় ঘুমিয়েছিল। সকালে পরিচারিকা ডেকে তুলে দুঃসংবাদ দিল। রথচালক সুষীম নিহত হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃতদেহ পৌঁছালো রাজবাড়ীতে, রাজ আদেশে আর সকলের সঙ্গে হেমাকেও দেখতে হলো সুষীমের মৃত মুখ।
হেমা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু, কাউকে কিছু বলতে পারলো না, কাঁদতে পারলো না, কোনোরকম শোকপ্রকাশ করতে পারলো না। সামান্য রথচালকের মৃত্যুর জন্য রাজকুমারীর শোকপ্রকাশ কীসের? শুধু তার বুকের ভিতর সব ভেঙে পড়ছিল, সে বুঝেছিল রাজা নিজেই লোক লাগিয়ে হত্যা করেছেন সুষীমকে, হয়তো রাজকুমারীর সঙ্গে ওর গুপ্তপ্রণয় জানতে পেরে গেছিলেন। কিন্তু কন্যাকে কেন অব্যাহতি দিলেন? কেন তাকেও হত্যা করলেন না?
তারপরে রাজকীয় মর্যাদায় অন্তেষ্ট্যিও হয়ে গেল সুষীমের। সুষীমের শোকাহত বাবা-মা চলে গেলেন তীর্থযাত্রায়, রাজকোষ থেকেই নাকি খরচ দেওয়া হয়েছিল।
সেইসব এই অভিষেকের আটদিন আগের কথা। আজ সপ্তাশ্বসুতা যৌবরাজ্যে অভিষিক্তা হচ্ছে। কিন্তু সে জানে হেমা এখানে নেই। হেমাকে এরা স্বর্ণশিকলে বাঁধতে পারে নি। সে একা একা একা চলে গেছে, দূর থেকে আরো দূরে, জন্মজন্মান্তর ধরে সে সুষীমকেই খুঁজবে। "সুষীম, সুষী-ঈ -ঈ ম!"
কলিং বেল বাজছে, আচ্ছন্ন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠি। শ্লথ পায়ে এগিয়ে যাই দরজা খুলতে, সৃঞ্জয় ফিরলো বুঝি।

৫।
হাতে একটা ছোট্টো আলো, চাবির রিঙ এ আটকানো আলো। সুইচ অন করতে উৎস থেকে আলো বেরিয়ে পাথুরে দেয়ালে একটা আলোকবৃত্ত রচনা করেছে, আলোকবৃত্তটি ঘিরে ছায়াবৃত্ত, তাকে ঘিরে আবার একটা হাল্কা আভার বৃত্ত, এইভাবে পর পর কয়েকটা আলো আর ছায়ার রিঙ এর পরে আবারো নিকষকৃষ্ণ অন্ধকার।
অদ্ভুত একটা পাথুরে সিঁড়ি দিয়ে নামছি, চারিদিকে পাথরের রুক্ষ দেয়াল। কোথাও কোনো শব্দ নেই। বাইরের পৃথিবীতে এখন দিন না রাত্রি? কেজানে! কখন এসেছি এখানে? তাও মনে নেই। আর কত পথ বাকী? কেজানে!
শুধু মনে পড়ে শেষরাত্রির ঠান্ডা বাতাসের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি নদীর দিকে, তারাগুলো দপদপ করছে মাথার উপরে। চলতে চলতে একসময় নদী পেলাম, নদীর পাশ দিয়ে চলতে লাগলাম, কে যেন ফিসফিস করে আমায় পথনির্দেশ দিচ্ছিল। আমার কোনো ভয় ছিল না, কোনো দ্বিধা ছিল না, দ্বিধাদ্বন্দ্ব সব শেষ হবার পরেই বেরিয়ে পড়েছিলাম।
বেরিয়ে পড়ার আগে একটা ছোটো চিঠিতে সৃঞ্জয়কে জানিয়েছি যে আমি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় সজ্ঞানে নিরুদ্দেশে যাচ্ছি, সে যেন আমার জন্য চিন্তা না করে। চিঠিটা টেবিলে রেখেছি গেলাস চাপা দিয়ে। সকালে উঠেই দেখতে পাবে ও।
মনে পড়ে হাঁটতে হাঁটতে পা দুটো ক্লান্ত হয়ে এলো, তারপরে দেখি নদীটা একটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে আর সামনে সেই পাহাড়, ঠিক স্বপ্নে যেমন দেখেছিলাম। পাহাড়ের গায়ের খাঁজে হাত পা রেখে রেখে উঠলাম চাতালে, সত্যিই একটা পাথুরে চাতাল ছিল আর তার সামনে ছিল সেই গুহা। গুহামুখে পাথর চাপা ছিল না।
মুহূর্তমাত্র দ্বিধা করে আলোটি জ্বালিয়ে ঢুকে পড়লাম। ঢুকে দেখলাম ধাপে ধাপে সিঁড়ি চলে গেছে, কখনো নামছে কখনো উঠছে। কখনো ঘুরে ঘুরে চলছে পাথুরে সিঁড়ি আর সিঁড়ি। চারিপাশে পাথরের দেওয়ালে কোথাও আর্দ্র জলধারা কোথাও রঙীন ক্রিস্টাল জ্বলজ্বল করে উঠছে আলো পড়ে, কোথাও অদ্ভুত সব নীল লাল সবুজ চিত্রমালা।
কোথা থেকে কে যেন ডাকে আমায়, ভাষাহীন, শব্দহীন সেই অমোঘ আহ্বান অগ্রাহ্য করার শক্তি নেই আমার। আমি চলতে থাকি, চলতে থাকি। হাজার হাজার বছরের বিরাট শূন্যতা, অতলস্পর্শী বিরহ-হাহাকার আমার পায়ের নিচে ভেঙে ভেঙে পড়তে থাকে। সময়হীন এক অমৃতলোকে দাঁড়িয়ে আছে জরাহীন, মৃত্যুহীন, বেদনাহীন এক তরুণ, অপূর্ব বিভা ঘিরে আছে তাকে।
চলতে চলতে নির্মোকের মতন খসে পড়ে যায় আমার সমস্ত বসন-ভূষণ-পরিচয়-ভাবনা-ঘরদুয়ারস্মৃতি। অদ্ভুত ফুলের গন্ধ এসে লাগে নাকে, অনুভব করি আমার অভূতপূর্ব কুন্ডলিত কেশভার বিচিত্র কবরীতে বাঁধা, তার উপরে জড়িয়ে আছে সুগন্ধী পুষ্পমালা। আমার পরনে সুবর্ণখচিত বস্ত্র, উর্ধাঙ্গে কঞ্চুলী ও উত্তরীয়। সেই সহস্র বৎসর আগে যেমন ছিল।
হাতের আলো কখন খসে গেছে, কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি, সব দেখতে পাচ্ছি বিচিত্র এক আলোতে। অক্লান্ত চরণে চলতে থাকি, চলতে থাকি, মনে মনে বলি, " আমি আসছি, আমি আসছি, সুষীম, আমি আসছি। "

*******