Tuesday, February 25, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(৫)

একদিন ফোনে অন্বেষাকে কনট্যাক্ট করি। এত উত্তেজিত যে কথা বলতে বলতে হাঁপাই, "টেঁপি রে, মারাত্মক কান্ড হয়েছে।"

অন্বেষা কিন্তু ধীরস্থিরই থাকে। ভারিক্কী গলায় বলে, "হয়েছেটা কী? আর, কী কুক্ষণেই যে আমার ডাকনামটা বলেছিলাম তোকে। "

আমি আরো বেশী হাঁপিয়ে টাপিয়ে একশা হয়ে বলি, " আরে তোর ডাকনাম তো ভালোই! কিন্তু কী কুক্ষণে না সুক্ষণে যে ইস্কুলবেলা সিরিজ লিখতে শুরু করেছিলাম! এতদিন কিছু না, না কোনো খোঁজ না কোনো পাত্তা, এই সিরিজ লিখতে শুরু করার পরেই মুখবইয়ে ভুচ্চুর ভাচ্চুর করে ইস্কুলবেলার ডজনখানেক বন্ধু ভেসে উঠেছে।"

"তাতে কী? তুই কি ওদের নামে বানিয়ে বানিয়ে লিখছিলি নাকি? উল্টাপাল্টা কথা?"

"না না তা না। এমনিতেও সব নামটাম বদলানো আছে, ইস্কুলের নামটাও কোথাও বলা নেই। সেসব ঠিক আছে। কিন্তু তবুও তো! যারা জানে তারা তো ধরে ফেলছেই। "

"ফেলুক না, নামযশ হচ্ছে জেনে তারাও আপ্লুত হবে।"

" নামযশ? আহা তা আর তেমন কোথায়? আমি তো কেবল তোর যশের জমিটি নিড়াতেছিলাম চষিতেছিলাম মই দিয়ে কষে ঘষিতেছিলাম---"

"এই এই এই! লেগপুল করতে চাস নাকি? আমিও কিন্তু তাইলে তোর নামে কেস আনবো।"

"আনিস, সে আনিস তোর যদি মন চায়। কিন্তু এই উইকেন্ডে আয়, সকাল সকাল বের হয়ে আমরা হাইকিং এ যাবো। আসবি? "

ও রাজি হলে আমি কানেকশান কেটে দিয়ে এগোতে থাকি টিউলিপের গোছার দিকে, কয়েকটা ফটো তোলা যাক। দুপুরের রোদে লাল ফুলগুলো একদম পুরো ফুটে গেছে, অগণিত বড় বড় চকচকে কালো কালো ভোমরা যাতায়াত করছে ফুলে ফুলে। আহ, বসন্ত পুরোপুরি আসতে আর দেরিই বা কত?

"আমি পথ ভোলা এক পথিক এসেছি/ সন্ধ্যাবেলার চামেলি গো সকালবেলার মল্লিকা--আমায় চেনো কি? " বসন্ত পথভোলা পথিক, ফাগুনপ্রাতের উতলা চৈত্ররাতের উদাসী।

কবে শুনেছিলাম এ গান সুগোপার গলায়? আমার বেসুরো গলায় গুণ গুণ করতে করতে হঠাৎ মনে পড়ে যায় আমাদের ক্লাস ফোরের গল্প, আমাদের রবীন্দ্রজয়ন্তী! মনে পড়ে দিতিপ্রিয়া আর পিয়ালীকে।

ওরা এই গানের সাথে নাচ করেছিলো সেই ফাংশানে। কবেকার কথা এসব? গতজন্মের? মনে পড়ছে আবীর লাল দিগন্ত, লাল লাল লাল। অত লাল ফুল ছিলো কোন গাছে? পলাশে শিমূলে না কৃষ্ণচূড়ায়?

সপ্তাহান্তে আমরা সত্যিই পাহাড়ে যাই, সঙ্গে দুপুরের খাবার আর জল। অনেকটা উঠে আমরা জিরাতে বসি, সিঙারা আর জল খাই। চারিপাশের ফুটন্ত কিশলয় পুষ্পমঞ্জরী অগণিত মৌমাছি ভোমরা পাখি আর দিব্যলোকের হেমপ্রভ সুরার মতন টলটলে রোদের বসন্তসৌন্দর্য অন্বেষার মতন আধা-ভালকানকেও কাত করে ফেলেছে নইলে হঠাৎ সে কেন বলে, " ক্লাস নাইনে আমাদের সেই অনুষ্ঠান মনে আছে তোর ? চন্ডালিকা নৃত্যনাট্য ? কণকচম্পা চন্ডালিকা চরিত্রে নেচেছিলো আর দিতিপ্রিয়া আনন্দ? "

আমি হেসে ফেলি, বলি, "মনে থাকবে না? আমাদের উন্মাদিনী স্টেজ রিহার্সালের দিন কী করেছিলেন মনে আছে তোর?"

এবারে ও ও হেসে ফেলে, গলার স্বর পালটে ফেলে বলে, "এই এই "হে ভৈরব শক্তি দাও" গানটা কোথায়? ওটা হচ্ছে না? তা চলবে না, এখুনি তোলো।" কী অবস্থা, শেষ মুহূর্তে এতজন মিলে কোরাস গান তোলা সোজা নাকি! উন্মাদিনীকে বোঝায় কে!"

আমাদের সম্মিলিত হাসিতে চারপাশের পাখিগুলো ফটফট করে উড়ে যায়।





*****



ইস্কুলবেলা লিখতে গিয়ে অনেক পাওয়া হলো আমার, কতকালের পুরানো বন্ধুরা উঠে এলো স্মৃতির জলরাশি সরিয়ে। মুখবইয়ে সত্যি করে উঁকি দিলো ছোটোবেলার বন্ধুরা। কাউকে চিনতাম প্রাইমারি স্কুলে, কাউকে পেয়েছিলাম সেকেন্ডারির বছর ছয়েক কাউকে বা এগারো-বারোতে।

তারপরে সময়ের স্রোতে জীবনের খরধারে কে কোথায় ভেসে গেছি নিজের নিজের কক্ষপথে। সেইসব ধূমকেতুরা যাদের কক্ষপথ অধিবৃত্ত বা পরাবৃত্তের মতন, যারা একবারই কাছে আসে তারপর চিরকাল দূরে সরে যায়, সেইরকম দেখা হয়েছিলো কতজনের সাথে। আবার কারুর কারুর পথ যেন উপবৃত্তের মতন, ফিরে ফিরে দেখা হয়েছে নির্দিষ্ট সময় পর পর। লিখতে গিয়ে যেন সময়ের স্রোতে উলটোবাগে নাও বাইছি, মনে পড়ে যাচ্ছে আগের থেকেও আগের কথা।

পাহাড়ে আমাদের সেই পিকনিকে ঘুরে ফিরে ইস্কুলবেলার কথাই আসছিলো শুধু। বারে বারে ছড়িয়ে যাচ্ছিলো আগে আর পরে। কিছুতেই যেন ফাইভ থেকে টেন এই ছয় বছরের গন্ডীতে তারা থাকবে না, বারে বারে গড়িয়ে যাচ্ছিলো আগের স্কুলে, সেই কেজি-ওয়ান কেজি-টু থেকে শুরু করে ক্লাস ফোর পর্যন্ত যেখানে ছিলাম সে স্কুলে, সেখানেও আমি আর অন্বেষা দু'জনেই ছিলাম কিন্তু তখন ওকে খুব ভালো করে চিনতে পারি নি। তাই সেখানে আমাদের স্মৃতিটুকরোগুলো আলাদা আলাদা।

অন্বেষা বলে কেজি ওয়ানের সেই প্রথম স্পোর্টসের কথা, বিস্কুট দৌড়। সুতোয় বাঁধা বিস্কুট ঝুলছে, দু'পাশ থেকে দিদিমণিরা দোলাচ্ছে আর দু'হাত পিছনে নিয়ে রুমাল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় প্রতিযোগীরা কামড়ে বিস্কুট খুলে নেবার জন্য লাফঝাঁপ করছে। আমার নিজের স্মৃতিতে সেই খেলার কিছুই নেই, কিন্তু কল্পনায় দেখতে পাই ঠিকই। শীতের রোদে ঝকঝকানো সবুজ মাঠ, সাদা সবুজ ইউনিফর্ম পরা একঝাঁক উজ্জ্বল শিশু। সত্যি কি আমরাই ছিলাম অমন?

আমার আবার মনে পড়ে কেজি-টু তে সেই ইঞ্জেকশান দেবার দিন। কী একটা ভ্যাকসিন যেন দেওয়া হবে ক্লাসের সব বাচ্চাকে। সবাই ভয়ে জড়োসড়ো আর ধীরস্থির ভারিক্কী চেহারার দীপাবলি দিদিমণি বলছেন, "কিছুই না, সামান্য পিঁপড়ের কামড়ের মতন লাগবে একটু।" এক এক করে বলির পাঁঠার মতন এক একজন এগিয়ে গিয়ে টেবিলের কাছে দাঁড়াচ্ছে, ওখানে তুলো স্পিরিট আর সিরিঞ্জ নিয়ে এক ভদ্রলোক রেডি আর দীপাবলি দিদিমণি ডানপাশ থেকে নানারকম মজার কথা বলে বলে বেচারা বাচ্চাটির মনোযোগ অন্যদিকে আকর্ষন করছেন। এর কথা অন্বেষার কিছু মনে নেই, কিন্তু তাতে আমাদের উপভোগে অসুবিধে হচ্ছে না, দুজনেই দিব্যি হাসছি।

হাসির ভিতরে হঠাৎ হানা দেয় অন্ধকার, কাহিনি ছড়িয়ে যেতে চায় অন্যদিকে, উৎসবময় মাধ্যমিকের পরেরদিকে। মাতাল কবির মতন তখন আমরা বাকীর খাতায় শূন্য রেখে পুরস্কারের সাকীর হাতে আপাতসাফল্যের সুরা পান করছি। জানি না সামনে কী আছে, সুদেআসলে কী ভয়ানক দাম দিতে হবে।

" টেঁপি, মাধ্যমিকের পরে আমাদের স্কুল বদলানো উচিত ছিলো, তাই না রে? "

এবারে আর ও ডাকনামে ডেকেছি বলে প্রতিবাদ করে না, ওর চোখ দূরে চেয়ে আছে, দেখছে তবু দেখছে না। আস্তে আস্তে যেন অনেক দূর থেকে শব্দ খুঁজে খুঁজে এনে কথা বললো, " টাউনের ভালো স্কুলে কেন তোরা গেলি না? আমার বাড়ীর লোকেরা না হয় আমাকে ডিসকারেজ করলো, সময় নিয়ে নাকি টানাটানি পড়বে অতটা জার্নি করলে, আরো কত হ্যানো হবে ত্যানো হবে, কিন্তু তোরা কেন কেউ গেলি না?"

আমি বলি, "তা কি হয় রে? তুই ছিলি আমাদের দৃষ্টান্ত, তোর মাধ্যমিকের রেজাল্টের জন্য দুইদিন ছুটি দিয়েছিলো স্কুল, সব অভিভাবকেরা তোর উদাহরণই দেখাতো। সেই তুই যখন রয়ে গেলি ওখানেই এগারো-বারোতে, তখন আমরা কেমন করে যাই? "

ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বলে, " বাড়ীর লোকের দোহাই দিলেও এতদিন পরে বুঝতে পারি আসলে আমারি দোষ। যে আমি এর আগে সব কিছুতে লড়াই করেছি, সেই আমি কেন ওরা বাড়ী থেকে যা বললো শুনে রয়ে গেলাম? আসলে নতুন জায়গা, নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে চাইলাম না। বিজয়ের সুরা তারিয়ে তারিয়ে খাবার জন্য রয়ে গেলাম। তার দামও দিতে হলো দু'বছর পরে, ঠিক হয়েছে, বেশ হয়েছে। তার পরেও বেহায়ার মতন বেঁচে রইলাম। তখনই ক্লিওপেট্রার শরণ নেওয়া আমার উচিত ছিলো।"

"অন্বেষা!!!" আমি শকড, ওর চোখে জল টলটল করছে। এর আগে আমি ওকে কোনোদিন কোনো অবস্থাতে কাঁদতে দেখিনি।

আমাদের চারপাশে অবারিত বসন্তসৌন্দর্যের মাঝখানে সময়ের ঋণশোধ করতে থাকি আমরা দু'জন। কবেকার- সেই কত বছর আগের আটকে থাকা কান্না, মিলিয়ে যেতে থাকে বাতাসে, কতদূরের এক অচেনা ভূমির করুণাভরা বাতাসে। সূর্যের উপরে উড়ে আসে একখন্ড মেঘ, স্নিগ্ধ ছায়া পড়ে। পৃথিবী তার কোমল হাত বাড়িয়ে আমাদের মনের অন্ধকার ছাড়িয়ে নিতে থাকে।

(চলবে )

Friday, February 21, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(৪)

আমাদের স্কুলের এক কিংবদন্তী চরিত্র মণিকুন্তলা মৈত্র। তিনি নাকি বহুকাল আগে ছিলেন প্রধানাশিক্ষিকা। একেবারে শুরুর দিকের কথা সেটা। উনি নাকি স্কুলেই নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, তাই নিজের সংসার আর করেন নি। স্কুলই তার সংসার, ছাত্রীরাই তার সন্তান। অতি সামান্য অবস্থা থেকে তারই হাতে নাকি বড়ো হয়ে উঠেছিলো স্কুল, নাম ছড়িয়েছিলো চারদিকে, ভালো ভালো শিক্ষিকারা কাজ করতে এসেছিলেন কাছের ও দূরের শহর থেকে।

আশেপাশের মানুষের স্মৃতিতে তখনো উজ্জ্বল হয়ে ছিলেন মণিকুন্তলা। আমরা তাকে দেখিনি, আমাদের জন্মের আগেই তিনি প্রায়াতা। কত গল্প বলতো লোকে, উনি নাকি সাবধানে ঘুরে ঘুরে দেখতেন কোন ক্লাসে কে কীভাবে পড়াচ্ছেন, এমনভাবে ঘুরে দেখতেন যাতে ছাত্রীরা বা শিক্ষিকা কেউ না বুঝতে পারে। পুরাণের সেই ছদ্মবেশী রাজাদের গল্পের মতন ব্যাপার। পরিদর্শন করে করে সুবিধা অসুবিধা বুঝতেন, নিজের স্কিল ও সাধ্য অনুসারে সমস্যা সমাধান করতেন আর সুবিধাগুলো বাড়িয়ে তুলতেন। কেজানে কতটা গল্প আর কতটা সত্য।

মাঝে মাঝে অবসরে কেন জানি কল্পনা করতে ভালো লাগতো চিরকুমারী এক জ্ঞানতাপসী হালকা পায়ে ঘুরে ঘুরে দেখছে তার তপস্যার ভুবন, নিজের হাতে গড়া স্কুল, তার প্রাণের সাথে যোগ এই স্কুলের। শত শত ছাত্রী তার মানসকন্যা। স্থানকালের দূরত্ব কবিতার মতন করে ফেলে তাকে। হয়তো বাস্তবে এরকম কিছুই ছিলো না। তা না থাকুক, তাতে কিছু এসে যায় কি?

আমাদের সময়ে ছিলো যাকে বলে যুদ্ধ। প্রধানাশিক্ষিকা আর উপপ্রধানাশিক্ষিকার লড়াই, ক্ষমতাদখলের লড়াই। ভাবা যায়? ঘটনাচক্রে সেই প্রধানাশিক্ষিকাও ছিলেন অবিবাহিতা, স্কুলে নিবেদিতপ্রাণা। খুব অল্পদিনই আমরা ওনাকে দেখেছি, সকালের সমবেতপ্রার্থনাসঙ্গীতের সময় এসে দাঁড়াতেন নির্দিষ্ট জায়গাটিতে। কমলাপাড় সাদা রেশমী শাড়ী পরা, খুব বিনীত সুন্দর চেহারা। দিদিমণিদের ইউনিফর্ম ছিলো লালপাড় সাদা শাড়ী। কমলা লালের খুব কাছ ঘেষে বলে বুদ্ধিমতী প্রধানাশিক্ষিকা কমলাপাড় সাদা শাড়ী পরতেন। সামাজিকতাও রক্ষা হলো (সে মফস্বলী সমাজের নিয়মে লালপাড় সাদা শাড়ী এয়োস্ত্রীদের জন্য রিজার্ভড) ইউনিফর্মও মেন্টেন করা হলো। ছাত্রীদের ইউনিফর্ম ছিলো নাইন-টেন সবুজপাড় সাদা শাড়ী, ইলেভেন টুয়েলভ নীলপাড় সাদা শাড়ী। ক্লাস ফাইভ থেকে এইট সবুজ টিউনিক।

ক্লাস ফাইভে কিছুদিন যেতে না যেতেই শুনি প্রধানাশিক্ষিকা খুব অসুস্থ। তারপরে উনি সিক লীভে চলে গেলেন আর তখন উপপ্রধানাশিক্ষিকা দ্রুত হয়ে গেলেন ভারপ্রাপ্তা প্রধানা। এই উপপ্রধানাশিক্ষিকা ভদ্রমহিলাকে সবাই আড়ালে ডাকতো উন্মাদিনী। একেবারে আলুথালু বেশবাশ, যখন তখন চেঁচিয়ে ওঠেন। বেশ উচ্চশিক্ষিতা কিন্তু পাগলাটে। শোনা যেতো উনি নাকি গাছের সঙ্গে অবধি ঝগড়া করেন।

কয়েকমাস এভাবে গেল। তারপরে পুরানো প্রধানাশিক্ষিকা ভালো হয়ে ফিরে এলেন। এদিকে ভারপ্রাপ্তা উন্মাদিনী রেগে চটে ক্ষেপে কুরুক্ষেত্র। এ ভার তিনি নামাবেন না। এ ভার তো যেন তেন নয়, এ এমনই ভার যাহা নামাইয়া রাখিতে ব্যথা বেশী।

তারপরে লেগে যা নারদ নারদ। তার উপরে আবার নানা সূক্ষ্ম লোকাল পলিটিকস ছিলো। এভাবে ওঠা আর নামা করতে করতেই কেটে গেল কয়েক বছর। তারপরে আর টিঁকতে না পেরে প্রধানাশিক্ষিকা চলে গেলেন অন্য স্কুলে শিক্ষিকা হয়ে, কমলাপাড় শাড়ী আর আমরা দেখতে পেলাম না। তখন এই উন্মাদিনীও কিন্তু আর সেই চেয়ারটিতে বসলেন না, অ্যাড দিয়ে অন্য জায়গা থেকে আরেকজনকে এনে প্রধানাশিক্ষিকা করলো স্কুলের ম্যানেজমেন্ট।

আমরা এসবের মধ্যেই বেড়ে উঠছিলাম, সময় দ্রুত বদলে যাচ্ছিল, টেকনোলজি বদলে যাচ্ছিলো। সবচেয়ে আগে বড় বড় শহরে। তারপরে সেই বদলের ঝাপটা এসে এসে লাগছিলো আমাদের ঐ গাঁঘেষা মফস্বলেও।

মুড়ি খেতে খেতে বললাম, "হ্যাঁ রে অন্বেষা, তোর মনে আছে উন্মাদিনীর ক্লাস? "

অন্বেষাও একমুঠো মুড়ি মুখে পুরে চিবোচ্ছিলো, হাসতে গিয়ে বিষম খেয়ে টেয়ে একশা। কোনোরকমে শেষ করে বললো, "ওরে এখন এসব বলিস না, হাসতে হাসতে বিষম খেয়ে যাবো। আরে একবার ইংরেজী ক্লাসে টিচার আসেন নি, সাবস্টিটিউট হিসাবে এসেছেন উন্মাদিনী। এসে পড়া ধরছেন, পোয়েট্রি মুখস্থ বলতে হবে। তো বলার আগে একজন বলেছে দিদিমণি, কবির নাম বলবো কি? আর যায় কোথা, উনি চটিতং হয়ে বললেন, থাপ্পড় দিয়ে তোমার সবকটা সব দাঁত ফেলে দেবো। আমার সংগে ইয়ার্কি? "

এবারে হাসতে গিয়ে দু'জনেরই বিষম লাগে। সামলে নিয়ে অন্বেষা বলে, "আরে মাঝে মাঝে খুশমেজাজেও থাকতেন। উনি গয়না হীরেপান্নাচুনি খুব পছন্দ করতেন।কেউ ওনার হাতের আংটি বা গলার হার নিয়ে জানতে চাইলে খুব খুশী হয়ে সেসব কোথা থেকে কত দামে কিনেছেন সব বলতেন। "

" জানিস অন্বেষা, ইস্কুলের পুরানো কত বন্ধু যাদের হারিয়ে ফেলেছিলাম বা যাদের কাছ থেকে আমিই হারিয়ে গেছিলাম এখন তাদেরকে আবার ফিরে ফিরে পাচ্ছি যুগ পার হয়ে। মুখবইয়ের কল্যাণে। কথা বলতে গেলেই ফিরে আসে ইস্কুলবেলার গল্প।"

" আমিও কয়েকজন বন্ধুকে পেয়েছি খুঁজে। তোর অলিপ্রিয়াকে মনে আছে তুলি? ক'দিন আগে তাকে পেলাম খুঁজে। কী ভালো গান গাইতো ও, তাই না? কী জানি একদিন হয়তো কোনো রি-ইউনিয়নে আবার দেখা হবে সবার। "

" কিংবা উপরে গিয়ে দেখা হবে। "

দু'জনে হেসে ফেলি, মনে পড়ে যায় সেই কোড। " উপরে গিয়ে দেখা হবে। "

সেই রেলস্টেশন আর ভীড়। সাবওয়ে দিয়ে দৌড়ে গিয়ে উপরে প্ল্যাটফর্মে উঠতে হতো। সবাই হয়তো ভীড়ের চোটে এক গলিতে ঢোকা গেল না, যে যার সুবিধামতো দৌড় দিলো, ছাড়াছাড়ি হবার সময়ে বলা হতো "উপরে গিয়ে দেখা হবে। " উপরে প্ল্যাটফর্মে এসে দেখা হতো। হেসে ফেলতাম সবাই। কথাটা খুবই সার্বজনীন, আমাদের এই নশ্বর জীবন যে যার মতন কাটিয়ে শেষে উপরে গিয়ে তো দেখা হবেই।

(চলবে )

Thursday, February 20, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(৩)

ইস্কুলে অনেক রুমা দিদিমণি৷ রুমা মুখার্জী, রুমা বসু, রুমা সেন,রুমা দত্ত৷ তাই এঁদের ক্ষেত্রে শুধু প্রথম নামের সঙ্গে দি বা দিদিমণি জুড়ে বোঝা যেতো না কে কোন্ জন৷ এদের নাম ও পদবী দুই লাগতো৷ কেন যেন রুমা মুখার্জীকে ওনার বিয়ের আগের পদবী ধরেই ডাকা হতো রুমা কাঞ্জিলালদি৷ হয়তো সেই পদবীটা আনকমন বলেই এত জনপ্রিয় হয়েছিলো৷

এই রুমা কাঞ্জিলালদি বাংলা পড়াতেন, অগাধ জ্ঞান বাংলায়, প্রচুর কোটেশন মুখের ডগায়, প্রচুর পড়াশুনোও ৷ অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন, গ্রীক দেবীদের মতন মুখ, ফর্সা দীঘল স্বাস্থ্যবতী চেহারা৷ একটাই মুশকিল খুবই তীব্র অহংকার আর পুরানো ভিক্টোরীয় এটিকেটের ধারনা ছিলো এনার৷ মেয়েদের নাকি চলতে হবে গজেন্দ্রগমনে, তাদের কথা বলতে হবে গলা না তুলে, থাকতে হবে খুব ফিটফাট। এইরকম খোলাখুলি উপদেশ তিনি দিতেন৷

ক্লাসে পড়ানো হয়ে গেলে দেশবিভাগে ওনাদের ওপারের জমিদারি ছেড়ে আসার গল্প বলতেন, দেশবন্ধু নেতাজী সুভাষচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ সকলের সঙ্গেই নাকি ওনাদের পরিবারের যোগাযোগ ছিলো, এইসব গল্প গুছিয়ে বলতেন৷ অদ্ভুত একটা রটনা ছিলো এনার বিষয়ে ইনি নাকি কেবল সুন্দরী ছাত্রীদের ভালো নম্বর দেন, অন্যেরা ভালো করলেও নাকি দেন না৷ কিন্তু রটনাটা ভুল, এটার প্রমাণ পেয়েছিলাম, তা সত্বেও কিন্তু লোকের মনে ধারনাটা রয়েই গেছিলো৷

মেয়েরা এনাকে নিয়ে আড়ালে বহু কথা বলতো, এক স্থূলবপু শ্যামাঙ্গ অধ্যাপক নাকি এনাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, ইনি শিউরে উঠে অসুস্থ হয়ে পড়েন শুনেই৷ পরে খুবই সুদর্শন এক ব্যক্তির সঙ্গে এনার বিয়ে হয়, কিন্তু সেই আগের অধ্যাপক আর কাউকেই বিয়ে করেন নি, চিরকুমার থেকে যান৷ কোথা থেকে যে এসব কথা জানা যেতো সে কেই বা জানে, কিন্তু দিব্যি আসতো এসব গল্প!

এনার পড়ানো বিষয়ে কোনো অভিযোগ ছিলো না, খুব যত্ন করে পড়াতেন, পরে এগারো বারোতেও প্রধানত এঁরই জন্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আমাদের পড়া হয়েছিলো৷নাহলে কাকে বলে দিব্যোন্মাদ, কাকে বলে ভাবোন্মাদ, কাকেই বা বলে বীভৎস উন্মাদ(আমাদের শ্রীতমা আবার বদ্ধ উন্মাদ আর মুক্ত উন্মাদ এই দু'খানা ক্যাটেগোরিও জুড়ে দিয়েছিলো)- এইসব আমাদের জানা হতো না, শ্রীকৃষ্ণবিজয় কীভাবে কেন লেখা হলো তাও না, আরাকান রাজসভার বাঙালি কবিদের কথাও না৷ লাউসেন অজানাই থেকে যেতো, লোরচন্দ্রাণীও৷ উচ্চমাধ্যমিকে বাংলাকে খুব হেলাফেলা দেখার একটা কালচার ছিলো, কারণ এর তো বিষয়কৌলীণ্য নেই! তবুও এনার ক্লাসে আমাদের সমঝে থাকতে হতো, নাহলে কী বলতে চিবিয়ে চিবিয়ে কী বলে দেবেন! বকার সময় ইনি কেন জানি প্রায়শই সকলের বাবামায়ের দেওয়া শিক্ষার উপরে অবধারিত কটাক্ষ করতেন৷ এরই শোধ হয়তো মেয়েরা তুলতো আড়ালে এনার ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনি চর্চা করে৷

কিন্তু মনে রাখার মতন ঘটনা ঘটলো একসময়, যখন জগতের নিয়মে আমাদের খুব দু:খ ও হতাশার দিন এলো, তখন ইনিই বলে দিলেন সেই কবির কথা, " দু:খের বরষায় চক্ষের জল যেই নামলো/বক্ষের দরজায় বন্ধুর রথ সেই থামলো৷" দু:সময়ে ভেঙে পড়লেই এই লাইন দুটি স্মরণ করতে বললেন বীজমন্ত্রের মত৷ এঁর স্বামীর তারপরেই বদলি হয়ে যায় অন্য রাজ্যে, ইনিও চাকরি ছেড়ে চলে যান স্বামীর সঙ্গে৷ শুধু বর্ষাসন্ধ্যার ধূপের ধোঁয়ার মতন ঐ লাইনটা পাক খায় ঘরের বাতাসে৷

সেলাইয়ের নীপবীথিদি আর গৌরমোহিনীদি-এদের ক্লাস আবার একেবারেই অন্যরকম৷ দুজনেই ঘোর শ্যামাঙ্গিনী আর ছোটোখাটো চেহারা৷ নীপবীথিদি খুব রগচটা আর গৌরমোহিনীদি শান্ত, মা-মা ধরনের৷ নীপবীথিদিকে মেয়েরা নাম দিয়েছিলো কেল্টিপিসি৷ প্রয় কেউই এনার উপরে প্রসন্ন ছিলোনা আর ইনিও কারুর উপরেই প্রসন্ন ছিলেন না৷ সকলের কাজেই কোনো না কোনো খুঁত ধরতে এত দক্ষ ছিলেন যে তাক লেগে যেতো! গৌরমোহিনীদির কোনো নিকনেম ছিলো কিনা মনে পড়ছে না, তবে বাফার হয়ে তিনি আমাদের এবং নীপবীথিদির মাঝে পড়ে অবস্থা সামাল দিতেন৷

আসন বোনা, উলের হাতপাখা, টেবিলক্লথে অ্যাপ্লিকের কাজ, কুরুশকাঁটায় ঢাকনি বানানো, হাফহাতা সোয়েটার, রুমালে গুজরাতি স্টীচের নক্সা, দড়ির পাপোষ, দু'কাটার আর চারকাঁটার উলের মোজা--এইসব হ্যানোতেন আমাদের করতে হয়েছে ক্লাস এইট অবধি৷ এসবের পরীক্ষাও হোতো রীতিমতো৷ কিন্তু তবু অনুচ্চারিত কিছু চোট্টামির অভিযোগ থেকে যেতো, কেউ কেউ নাকি বাড়ীতে মাকে দিয়ে বা অন্য কোনো দক্ষ মহিলাকে দিয়ে করিয়ে আনে, তাই সেগুলো এত ভালো হয়৷

নাইনে উঠে শুরু হলো প্র্যাকটিকাল, কাপড়ে মাপে মাপে কেটে তারপরে ক্লাসে বসে সেলাই করে করে ব্লাউজ জাঙিয়া বেবীফ্রক তৈরীর ক্লাস৷ নীপবীথিদি আর গৌরমোহিনীদি দুজনেই থাকতেন সেই বিশাল ক্লাসরুমে৷ রীতিমতো ফর্মূলায় ফেলে অংক করে মাপ বের করে নিঁখুত কেটে তৈরী করতে হতো৷

পরে এগারো বারোতে বায়োলোজি প্র্যাকটিকালে এই সূক্ষ্ম কাটার জ্ঞান খুব কাজে লাগতো পাতা কান্ড মূলের প্রস্থচ্ছেদ করার সময়৷ ব্যাঙের ডিসেকশানের সময়ও৷ তবে সেসব পরের কথা৷ তখনো ঐ ফিজিক্স কেমিস্ট্রি বায়ো ল্যাব আমাদের কাছে অনেক দূরের৷ তবে বায়োলোজি ল্যাবে ঝোলানো কালো কাপড়ে ঢাকা কংকালখানা আমাদের কাছে একেবারে ফাইভ থেকে ছিলো একটা বিশেষ রহস্যেমোড়া দারুণ জিনিস৷ পরে ফটফটে দিনের আলোয় বায়োলোজি প্র্যাককটিকাল ক্লাসে যখন হাট করে খুলে রুবীদি ঐ মনুষ্যকংকালের ফ্রীজ হয়ে যাওয়া অস্থিময় হাসি দেখালেন, পুরো শিরশিরানি আগ্রহ উবে গেলো আর রহস্যই যে রইলোনা! কিন্তু সেও পরের কথা৷

তখন আমরা ব্যস্ত কর্মশিক্ষার জিনিসপত্র তৈরীতে৷ সে রীতিমতো প্র্যাকটিকাল খাতায় ছোটো ছোটো স্যাম্পেল অবধি আটকে ওগুলো সম্পর্কে লিখতে হতো৷ তার উপরে পরীক্ষাও হতো মৌখিক ও হাতেকলমে৷ এক মৌখিক পরীক্ষায় নাকি "চিকনের কাজ কোন্ অঞ্চলের লোকের পোশাকে বেশী ব্যবহার হয়?" এই প্রশ্নে ঘাবড়ে গিয়ে এক ছাত্রী বলেছিলো, " মরুভূমির লোকের পোশাকে৷" প্রশ্নকারিণী দিদিমণি ঘাবড়ে ঘ হয়ে বলেন, " মরুভূমিতে? কেন? " ছাত্রী ততক্ষণে বেশ সাহসী, সে বলেছিলো, "মরুভূমিতে খুব গরম কিনা, ফুরফুর করে যাতে হাওয়া খেলতে পারে তাই চিকনের কাজ থাকে পোশাকে৷" আবার কালচার্ড করারও ব্যবস্থা ছিলো, একটি গান অথবা আবৃত্তি করার পরীক্ষাও থাকতো৷ তারপরে ফার্স্ট এইড বাক্স তৈরীও আমরা শিখলাম সেই সম্পর্কে গুছিয়ে লিখতেও হলো৷ কর্শিদা, হানিকম্ব ইত্যাদি জীবনে নাম না শোনা স্টীচ শিখে রুমালে করতে হলো! কী অবস্থা!

সেলাই প্র্যাকটিকাল ক্লাসে ঢালা শতরঞ্চি পাতা৷তার উপরে পাশাপাশি জমিয়ে বসে টুকটুক করে গল্প করতে করতে আমরা হেম দিয়ে ফ্রকের প্রান্ত মুড়ি যথাসাধ্য যত্নে৷ এই একটি ক্লাস যেখানে আস্তে আস্তে গল্প করা যায়, খুবই দীর্ঘ সময়, প্রায় আড়াই ঘন্টা নইলে সবাই বোর হয়ে যাবে তো! শুভাশ্রী আর আমি সেদিন পাশাপাশি, ও বেশ শক্ত মুখে বলে, "এইবারে আর ওরা আমাদের কিছু বলতে পারবে না যে কাউকে দিয়ে করিয়ে আনি৷ সামনাসামনি করতে হচ্ছে, এই ভালো হয়েছে৷"

আমি সায় দিই, সুতো ফুরিয়ে গেছিলো, নতুন সুতো পরাই৷ দিনটা খুব মনে আছে, হয়তো তখনো আমাদের শেলগুলো এত শক্ত হয়ে উঠে নি, তখনো হয়তো আমরা কিছুটা জ্যান্ত ছিলাম কিছুটা সত্য ছিলাম পরস্পরের কাছে, অসেতুসম্ভব দ্বীপে চলে যাই নি৷

কবে যেন সেই সরে যাওয়া শুরু হলো, ঠিক করে মনে পড়ে না৷ সে কি ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির কাছে অংকের টুইশন নিতাম বলে? নাকি শুভাশ্রী ইতিহাস পড়তে অমলেশ স্যরের কাছে ভর্তি হলো আমি হলাম না তখন থেকে? নাকি দেবু স্যরের কাছে ফিজিক্স পড়তে গেলাম আমি, ও গেলো কুমারপ্রসাদ স্যরের কাছে, তখন থেকে?

এক একজন স্যরের দ্বারা অনবরত বিষিয়ে দেওয়া চলতো অন্য স্যরেদের বা দিদিমণিদের কোচিং সম্পর্কে৷ নিজে নাকি উৎকৃষ্ট নোট দেন, অন্যে অতি নিকৃষ্ট ভুলভাল৷ প্রত্যেকেই অন্যের থেকে বেশী বুদ্ধিমান৷ নেহাত ভীড় নেই, দেবুস্যরের কিছুটা পাগলামির রেপুটেশানের জন্য, তাই সেখানে যেতাম ৷ শুধু এই কারণেই, কারণ এনার পড়ানো তেমন আহামরি কিছু না৷ তবে অন্যেরা যেমন গ্যালারি সিস্টেমে একসঙ্গে কুড়ি/ তিরিশজন ছাত্র বসিয়ে নোট দিতেন যন্ত্রের মতো, এখানে সেরকম না, বেশ গল্প গাছা করতেন৷ পরে অবশ্য অত্যন্ত মানসিক কষ্টের মধ্যে ফেলেছিলেন, বাইরের দেশে হলে হয়তো সাইকোলজিকাল টর্চার বলতো, কিন্তু সে প্রথম প্রথম না, বেশ অনেকদিন পরে ৷

বেঁটেখাটো গাঁট্টাগোঁট্টা মানুষটি দেবুস্যর, স্থানীয় বাংলা বয়েজ স্কুলে ফিজিক্স পড়াতেন৷ কিছুটা একসেন্ট্রিক৷ আই এ এস পরীক্ষা সম্পর্কে একেবারে দারুন ভক্তি ছিলো, উনি বলছিলেন, "জানো, আমি ভেবেছিলাম আই এ এস হয়ে রাশিয়াতে রাষ্ট্রদূত হয়ে যাবো৷" শুনে আমরা অতি কষ্টে হাসি চাপতাম৷ ইনি নাকি এত বেশী এই আই এ এসের গল্প বলতেন যে সহকর্মীরা তিতিবিরক্ত হয়ে ওনার আড়ালে ওনাকে এবিএফ বলে ডাকতো৷ এবিএফ হলো অ্যাটেম্পটেড বাট ফেইলড৷ এনার সম্পর্কে রটনা ছিলো যে ইনি আই এস পরীক্ষা দিয়েছিলেন কিন্তু পারেন নি, তাই পাগল হয়ে যান!

তো সেসব আমার কিছুই আগে জানা ছিলো না, সহজ স্বাভাবিক সরলমনে ঢুকলাম ওনার কাছে পড়তে, তুমুল ভক্তি করতেন ফিজিক্সকে, নাকি ওয়েভ মেকানিক্সের তুল্য জিনিস ত্রিভুবনে ও ত্রিকালে পাওয়া যায় নি৷ সময় আসার অনেক আগেই তিনি জানিয়ে দিলেন হাইজেনবার্গের নাম, এমন পদার্থবিদ নাকি ত্রিভুবনে ও ত্রিকালে খুব কম পাওয়া যায়!

আমরা মৃদু প্রতিবাদ করে বলতাম " কেন স্যর, আইনস্টাইন? "

আর যায় কোথা? উনি তুমুল তেজে বলতে শুরু করতেন কেন হাইজেনবার্গ আইনস্টাইনের থেকেও বেশী মেধাবী, কারণ ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ কখনো কোনো পরীক্ষায় দ্বিতীয় হন নি! এই ধারনাটা পরে নারায়ণ স্যানালের বইয়েও দেখেছি, কিন্তু মনে হয় না জার্মান পরীক্ষা ব্যবস্থা আমাদের চেনা পরীক্ষাব্যবস্থার মতন ছিলো৷ ওদেশে স্কুল ও তো অন্যরকম!

যাই হোক, এনার কাছে ভালো করে জানা গেলো যে সমস্ত সাবজেক্টের মধ্যে প্রকৃত কাজের জিনিস হলো গিয়ে ফিজিক্স আর যারা ফিজিক্স পড়ান তারা অবধারিতভাবে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশী ট্যালেন্টেড ও স্মার্ট৷ বাকী সব সাবজেক্ট যেমন বাংলা ইতিহাস ভুগোল জীবনবিজ্ঞান এসব যারা পড়ান তাদের বুদ্ধির কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো৷ শুধু তাই না তাদের নাকি সাহস পর্যন্ত খুব কম!

কেউ কেউ একবার অংকের হয়ে কিছু বলতে গেছিলো, দেবুস্যর বিপুল বিক্রমে বললেন প্রকৃত গণিতজ্ঞের কাছে দুনিয়া নাকি হাতের তালুর মতন৷ ঘোর অন্ধকারে টর্চ জ্বাললে যেমন আলো দেখা যায়, জিনিস খোঁজা যায়, এই দুনিয়ার প্রকৃত জ্ঞানী গণিতজ্ঞেরা তেমনি ৷ প্রকৃত পদার্থবিদের সঙ্গে এদের তফাত নেই ৷ কিন্তু যেসব অঙ্কের মাষ্টার এখানে আশেপাশে আছেন তারা সেরকম নন, তাদের কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো৷ প্রসঙ্গত, ইনি নিজেরই স্কুলের এক বহু প্রাইভেট ছাত্রওলা অংকশিক্ষকের উপরে হাড়ে চটা ছিলেন কারণ সেই ভদ্রলোক দেবুস্যরের নিকনেম দিয়েছিলেন বিশারদ!

কিন্তু দুনিয়া ও টর্চ এর গল্পটা আমাদের খুব ভালো লাগতো৷ অন্ধকার বিশ্ব ও আলোক-উৎস গণিতজ্ঞ/পদার্থবিদ৷ এই প্রকৃত গণিতজ্ঞ বা প্রকৃত পদার্থবিদ যে কে বা কারা সে সম্পর্কে আমাদের ধারনা ছিলো অত্যন্ত ধোঁয়াটে, হয়তো হাইজেনবার্গ, হয়তো আইনস্টাইন! হয়তো আরো অনেকে যাদের নাম আমরা তখনো জানতাম না৷

দিন চলে গেল গুণ গুণ করে, চ্যাপ্টারের পর চ্যাপ্টার চলে যেতে যেতে একসময় দেবুস্যর কেন জানি নিরুৎসাহ করতে শুরু করলেন৷ এদেশে নাকি গবেষণা খুব বড়োলোক আর খুব ইনফ্লুয়েনশিয়াল পরিবারের না হলে করা যায় না, তাই একটু ভালো ছাত্রেরা হায়ার সেকেন্ডারিতে প্রাণপণে তৈরী হয় জয়েন্ট পরীক্ষা দেবার জন্য, যাতে ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিকেলে একটা চান্স কোনোরকমে পেয়ে যায়৷ না পেলে তখন জেনারেল লাইনে গিয়ে ভর্তির চেষ্টা করে আর কলেজে একটা সীট দখল করে সেফসাইডে থেকে পরেরবার জয়েন্ট দেবার জন্য তৈরী হয় ৷

তাক লেগে গেল, তাহলে স্যর এই যে এত ত্রিভুবনে ত্রিকালে না হওয়া ওয়েভ মেকানিক্সের কথা কইলেন? হাইজেনবার্গ শ্রোডিংগার .... উনি হাসেন, বলেন, "তারা অন্য দেশের লোক, তাদের স্মার্টনেসের সঙ্গে আমাদের তুলনা?”

আমাদের মধ্য থেকে কেউ দুর্বল স্যাঁতানো গলায় বলে, "আমাদের মেঘনাদ সাহা সত্যেন বোসও তো ....”

উনি রেগে যান, বলেন, "এই সত্যেন বোস মেঘনাদ সাহা ধরনের তুখোর ব্যক্তিরা হাতের মোয়া না, এনারা হাজার বছরে একবার জন্মান৷ এদের দেখে এইম ঠিক করলে ভুল করবি৷”

দিন যায় মাস যায় বছর ঘুরে যায়, সময়ের স্রোতে ভেসে যেতে থাকি সবাই৷ একদিন কাছে এসে যায় মাধ্যমিক পরীক্ষা৷

তখন দ্রুততর দিনের গতি, সামনে প্রি-টেস্ট, প্রি-টেস্টের রেজাল্ট পাওয়ার সময় কান ঘেঁষে গুলি চলে গেল অন্বেষার। আমার কাছে অনেক পরে, ভিন্ন দেশেকালে বসে সে গল্প করেছিলো আমাদের ফার্স্ট গার্ল অন্বেষা। প্রিটেস্টের খাতাগুলো ফেরৎ দেওয়া হতো, টেস্টের সময় আর তা হবে না। তা একটা পর্যায়ে এমন অবস্থা হোলো যে ওর পাওয়া নম্বরগুলো যোগ করে যা হচ্ছে তা সেকেন্ড গার্ল মিঠুর চেয়ে এক না দুই কম। তখন আর মাত্র একটা খাতা বেরোনো বাকী আছে। অন্বেষা দেখছে সে নিশ্চিত খাদে পড়ে যাচ্ছে, ক্লাস ফাইভ থেকে টেন পর্যন্ত হাফ-ইয়ার্লি অ্যানুয়াল কোনো পরীক্ষায় সে সেকেন্ড হয় নি, প্রায় সব সাবজেক্টে সে পেতো হায়েস্ট মার্ক, ওকে বাদ দিয়ে সেকেন্ড থেকে হিসেব করতো দিদিমণিরাও। কিন্তু এখন?

অন্বেষাও পড়তো দেবুস্যরের কাছে। নিরাপদ সময়ের দূরত্বে বসে অন্বেষা আমায় বলছিলো সেদিনের কথা, " আমার গুরু ক্লিওপ্যাট্রার পথ প্রায় "ধরি ধরি মনে করি ধরিতে পারি না" অবস্থায় আছি, এমন সময় সেই দেবুস্যর! পাঁচ সেলের এক টর্চ নিয়ে বাঁশবাগান পার হয়ে আমাদের বাড়ীতে। ভাই বাইরে বারান্দায় ছিলো, তাকে জিগায়, "ওরে তোর দিদি টেঁপি কোথায়? আছে তো? " তা ছিলাম বটে, রয়েই গেলাম। আরো অনেক দেখতে হবে কিনা! আর তো গুলি কান ঘেঁষে যাবে না, সোজাসুজি কলিজা ফুটো করে দেবে আর তা এই স্যাডিস্টগুলো দেখবে বলেই কিনা ক্লিওপ্যাট্রা আড়ালে দাঁড়িয়ে আমায় যা মুখে আসে গালাগাল দিয়ে যাবার কালে বলে গেল, "ছি ছি অকৃতজ্ঞ, দুনিয়ার ঋণশোধ না করে দুনিয়া থেকে পালাতে চাস, লজ্জা নেই!"

আমি তো অবাক, "সে কী রে, তোর গুরু ক্লিওপ্যাট্রা নাকি রে অন্বেষা ????

অন্বেষা হাসে, বলে, " সে না হলে আর কে গুরু হবে? গোটা ইতিহাসে তো এই একজন নেত্রী মহিলাই সময়মতো ছিটকে পালাতে পারলেন।"

আগের কথার সুতো টেনে বলি, " তারপরে কী হলো সেদিন? "

সে বলে," পরদিন শেষ খাতাটা বেরোবে, তো পরদিনের জন্য অপেক্ষা করাই স্থির করলাম। তিন না পাঁচ নম্বরের জন্য কান ঘেঁষে গুলি বেরিয়ে গেল। সেভড। সেবারের জন্য অন্তত। ছি ছি, কীরকম ভাবে আমাদের মন তৈরী হয়েছিলো! অর্থহীন যুক্তিহীন স্বার্থপর প্রতিযোগিতা, মিথ্যা অহংকার। "

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, "সেদিন কিন্তু ব্যাপারগুলো খুব খুব স্ট্রং ছিলো রে অন্বেষা, ভেবে দ্যাখ তখন আমাদের পনেরো-ষোলো বছর বয়স, জীবনের কতটুকুই বা জানি। যতটুকু জানি সেখানে এই প্রবল প্রত্যাশার ভার। থ্যাঙ্ক গড, যে তুই সেদিন অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলি। "

প্রীটেস্টের পরে মাত্র পুজোর ছুটিটুকু ফুরিয়েই টেস্ট, তার তিনমাস পরে মাধ্যমিক৷ বনশ্রীদি আমাদের যত্নে ম্যাপ পয়েন্টিং শেখান, সমুদ্রস্রোত যেন দ্রুত এবংমোটামুটি ভালোভাবে আঁকতে পারে ছাত্রীরা সেটা নিয়ে যত্ন করে টিপস দেন৷ ইনিও বলতেন "ভুগোলে তোমাদের অনেকের বাইরে প্রাইভেটে পড়ার সুযোগ নেই, এখানেই যতটা যা পারো শিখে নাও৷"

অন্বেষা বলে, "বুঝলি তুলি, সেই পূজাতে মাইকে এত এত গান বাজে আর আমার কানে আসে খালি, "সব লাল পাথরই তো চুনি হতে পারে না " এই লাইনখান। আসলে একবার পালাবার পালার জন্য তৈরী হয়ে গেলে ফট করে তার প্রভাব থেকে বেরোনো শক্ত। "

"আহা রয়ে গেলি বলেই তো পরে আমাদের ইস্কুলে অত বড় একটা গৌরবমুহূর্ত এলো। স্মরণকালের মধ্যে ওরকম তো আর হয় নি। "

অন্বেষা চুপ করে জানালা দিয়ে দূরে চেয়ে থাকে, ফেলে আসা কিশোরীবেলার লবণচিনি স্মৃতি তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে বুঝি।

" সেভেনের পিকনিকের কথা মনে আছে তোর? সেই যে নন্দিনীদি নিয়ে গেল আমাদের দূরের মাঠে পিকনিকে।"

আস্তে আস্তে বলে অন্বেষা, "মনে থাকবে না? বাপরে সেকি ঝাল হয়েছিলো মাংস। চাটনি দিয়ে মেখে ঝাল কমিয়ে খেতে হলো। "

দু'জনে হেসে উঠি।

ক্লাস সেভেনে তখন আমরা, ঠিক হলো ক্লাসের সবাই মিলে পিকনিক করবো। ক্লাস টিচার নন্দিনীদি, উনি গণিতের শিক্ষিকা। চাঁদা টাদা ঠিকমতন তোলাও হয়ে গেল। পিকনিক-সাইটও দেখে এলেন দিদিমণি। উনি তো তিনজন পাচকের ব্যবস্থা করে নিজে টিফিনকৌটায় কৌটায় সবার জন্য পায়েস বানিয়ে নিয়ে গেলেন, রান্না হতে দেরি হবে, সেই সময়ে মেয়েগুলোর খিদে পেতে পারে, তখন উনি নলেন গুড়ের পায়েস সবাইকে দেবেন এই প্ল্যান।

গিয়ে তো দেখা গেল খুব রোদ, সামিয়ানা টানানোর ব্যবস্থা করতে হবে।বড় বড় মোটা কাপড় ছিলো সাথে। বাঁধার জন্য একদিকে কিছু সাপোর্ট পাওয়া গেল, কিন্তু অন্যদিকে কিছু নেই। অপটিমাম একটি গর্ত করে বাঁশ পুঁততে হবেই সামিয়ানার জন্য। এদিকে শাবল থাকলেও মেয়েরা কেউ তেমন গর্ত খুঁড়তে পারে না! শেষে নন্দিনীদি নিজেই গর্ত খুঁড়তে খুঁড়তে বললেন, "এমন জানলে আমি আগমনীকে সঙ্গে করে আনতাম। " আগমনীদি আমাদের ফিজিক্যাল ট্রেনিং এর দিদিমণি ছিলেন, খুবই স্ট্রং।

হয়ে গেলে সবাই সুস্থির হয়ে শতরঞ্জিতে সামিয়ানার ছায়ায় বসে শান্তিতে গানের লড়াই খেলা শুরু করলো, রান্নার বহু দেরি। প্রথমদিকে দিদিমণিও যোগ দিয়ে বেশ গান টান গাইলেন, তারপরে উনি অন্যদিকে ব্যস্ত হয়ে পড়লে জোশের গান গুলো শুরু হলো খুব আস্তে গলায়, যেন ওনার কানে না যায় কোনোমতে।এখন ভেবে দেখলে হাসি পায়, তেমন কিছু না, কিছু হিন্দি-সিনেমার প্রেমের গান মাত্র, সে সময় সে অঞ্চলে এগুলো নিয়েও খুব ছুৎমার্গ ছিলো।

এইভাবে বেশ কয়েক ঘন্টা কাটার পরে সবার তো খিদেয় কাহিল অবস্থা। তখন দিদিমণি বার করলেন পায়েসের কৌটোগুলো। এদিকে শালপাতার প্লেটের নাম্বার লিমিটেড, সেগুলো পিকনিকের মূল খাবারের জন্য রাখা আছে। এখন উপায়?

ব্যবহারিক গণিতজ্ঞদের নিয়ে একটা সুবিধা, এরা চট করে সমাধান করতে পারে নানা সমস্যার। সবাই ভালো করে হাত ধুয়ে এলো, দু'হাত জড়ো করে অঞ্জলি করলো, তাতে উনি পায়েস দিয়ে গেলেন, সবাই মহানন্দে খেয়ে ফেললো। যাদের কুলাবে না তাদের জন্য বিস্কুটের ব্যবস্থাও উনি রেখেছিলেন তবে সে আর লাগে নি দরকারে।

" হ্যাঁ রে অন্বেষা, তোর ডাকনাম যে টেঁপি, এটা তো কস্মিনকালেও জানতে পারিনি আমরা কেউ গোটা ইস্কুলবেলায়!"

অন্বেষা হাসে, বলে, " আরে ওটা তো বাড়ীর ডাকনাম, ইস্কুলে তোরা জানবি কীকরে? দেবুস্যর তো মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ী যেতেন, তাই জেনেছিলেন।"

"আরে বলিস কী? উনি তোদের বাড়ী যেতেন? "

"মাঝে মাঝে। উনি বলতেন লোকে নাকি গল্প করতো আমার ঘরে আমি মাবাবাকে পর্যন্ত নাকি ঢুকতে দিই না, বই দিয়ে ঢাকা সেই ঘরের মেঝে থেকে কড়ি অবধি। দেবুস্যর বেশ একটা গর্বের সুরে বলতেন আমি শিক্ষক, তাই ঢুকতে পেরেছি, শিক্ষকের মর্যাদাই আলাদা, শিক্ষক আর চিকিৎসক- এনারা নাকি সর্বত্র যেতে পারেন। আচ্ছা তুলি, আমি আমার ঘরে কাউকে ঢুকতে দিই না, হরিলুটের মতন বই ছড়ানো ঘর, এসব গল্প লোকে কেন বানিয়ে বানিয়ে বলতো আর কেনইবা বিশ্বাস করতো?"

"সে লোকেরাই জানে। তোর সম্পর্কে আরো নানা অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প ছিলো। সেই যে তুই নাকি ঘুমের মধ্যে নানা ইকোয়েশন টিকোয়েশন বলিস আর মাঝে মাঝে নানা অদ্ভুত নাম ধরে ডেকে উঠিস।"

দু'জনে হেসে উঠি। জানালার বাইরে তাকাই। বাইরে অনর্গল শুভ্র তুষার ঝরছে, আকাশ থেকে তুলোর ফুলের মতন। বাড়ীঘর গাছপালা বাইরের গাড়ীগুলো মাঠ পথ ঢেকে যাচ্ছে সাদা চাদরে। হোয়াইট ক্রিসমাস। সেই কতদিন আগের এক উষ্ণ দেশের আমাদের ইস্কুলবেলার গল্প এই পটভূমিতে বসে ভাবতেও অবাক লাগে। যেন গতজন্মের কাহিনি।

"সেদিন দেবুস্যর পাঁচসেলের টর্চ নিয়ে তোদের বাড়ী যে গেলেন, কী করে জেনেছিলেন উনি? "

অন্বেষা বলে "সেদিন বিকেলে পড়া ছিলো, হয়ে গেলে ফিরে আসার সময় আমি একটা চিরকুট দিয়ে এলাম যে! সেটায় ছিলো, এত এত কার্বন অক্সিজেন নাইট্রোজেন হাইড্রোজেন বৃথা আটকে রেখে লাভ কী? এই দিয়ে প্রকৃতি তৈরী করতে পারবে আরো অনেক মেধাবী অনেক সাহসী অনেক বেশী এফিসিয়েন্ট মানুষ, তারা পৃথিবীকে কিছু দিতে পারবে। আমি দ্রুত এসব যথাস্থানে ফিরিয়ে দিলেই মঙ্গল।"

"আরে সর্বনাশ! এসব তুই লিখেছিলি? তবে তো বাপু তোমার নাম খেপী হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু অন্বেষা, তুই এতখানি খেপীটাইপ হলে কী করে স্টিক করে রইলি তোর লক্ষ্যে? দেবুস্যর তো খোলাখুলি বলতেন পরিবারের লোকজন উঁচু পজিশানে না থাকলে গবেষণা টবেষণার আশা করা দুরাশা।"

স্মৃতিমেদুর হয়ে যায় ওর মুখ, বলে, "আমার কী যে দিন গেছে কী যে রাত গেছে! সব গুলিয়ে গেছিলো। মনে হতো এবারে কী হবে? আমাদের পরিবারে এর আগে কেউ সায়েন্স পড়েনি, বাবাজ্যেঠা কমার্সের লোক, মা-জ্যেঠিমারা আর্টসের৷ কোথাও কোনো পরিচিত পারিবারিক লোক নেই উঁচু প্রতিষ্ঠানে, অন্ধকার, অন্ধকার একেবারে ঘোর টর্চবিহীন অন্ধকার!

চাষী পরিবার থেকে উঠে আসা ক্ষণজন্মাপ্রতিভা নিউটনের গল্প পড়েও এতটুকু উষ্ণতা অনুভব করতে পারিনি, ঠান্ডা, খুব ঠান্ডা লাগতো৷ নিউটনের দেশ ও কাল তো নয় আমার দেশ ও কাল! এখানে অন্যরকম মানুষ, অন্যরকম ধারণা বিশ্বাস অন্যরকম সমস্যা ও সমাধান৷ এমনকি সত্যেন্দ্রনাথ মেঘনাদও তো আমার চেনা কালের নন!

গভীর রাত্রির মধ্যে ডুবে যাবার মতন লাগতো, ঠান্ডা অন্ধকার, গ্রহতারাহীন অসহায় শূন্যতা৷ গুজরাটী/ মাড়োয়াড়ী/ সিন্ধি/ সাহেবী কোম্পানিতে মগজ চাকর হয়ে জুতে যাওয়া অথবা আড়ঘোমটা দিয়ে শ্বশুরবাড়ী যাওয়া-দুটোই ঘোর অর্থহীন ও নিষ্ফল বলে মনে হতো৷

তুই জানিস আমাদের বাড়ীর খুব কাছেই গঙ্গা। সেই গঙ্গা মনের মধ্যে ছলছল করতো, মনে হতো বিয়েই যদি করতে বাধ্য করে মা-বাবা ও পরিবারের সবাই, তবে গঙ্গা তো রইলো। সে তো আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।

তারপরে একদিন ... সেই অন্ধকারে আলো ফুটে উঠলো, প্রথমে অতি অল্প, অতি হাল্কা, ভুলে যাওয়া গানের মতন একটা দুটো হাল্কা সুর, তারপরে অন্ধকারে ফুটে ওঠে সেই দীর্ঘকেশ ভবঘুরে জ্যোতিষ্ক, অভিমানী ধূমকেতুটি, সে বলে, "তুমি ভুলে গেছ আমায়, আমি কিন্তু তোমাকে ভুলিনি৷" অমনি ঘননীল পর্দাটা সরে যায়, অসংখ্য আয়নার মধ্যে ঘূর্ণ্যমান জগৎ হেসে ওঠে ৷

তারপরে দিনের পর দিন স্যর আমার পরিবারের কমজোরিতা নিয়ে বলে যান, যতরকমে পারেন নিরুৎসাহ করেন, তারপরে সান্ত্বনা দিচ্ছেন ভেবে আরো জোরে ছুরি বেঁধান সবচেয়ে গভীর স্পর্শকাতরতায়, "অবশ্য তোর ছেলেকে ভালো করে শেখাতে পারবি, তখন তো তুই নিজে হবি কিনা এই লাইনের লোক, তাই৷" আমি হাসি, কথাগুলো এককান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্যকান দিয়ে বার করি, কারণ এদের কাছে কিছু বলতে গেলে কোনোভাবেই কিছু হবে না৷ আমি মনে মনে জপি If it doesn't kill us, it makes us stronger. "

অন্বেষা চুপ করে বাইরের তুষারের দিকে চেয়ে থাকে, ওর চোখ দেখতে পাই না, আস্তে করে হাত বাড়িয়ে ওর হাত ধরে রাখি। চুপি চুপি বলি," হ্যালির ধূমকেতু, না রে? তুই বলেছিলি ও ধূমকেতু যখন আসলো তখন থেকেই তোর মন টানলো আকাশ। একেবারে " বিষয়মধু তুচ্ছ হইলো, কী যেন কুসুমসকলে।"

ও হেসে ফেলে, বলে, "এই দ্যাখ, তুইও গল্প বানাতে শুরু করেছিস। যাকগে, গান শোনা।"

আমি মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে শ্যামাসঙ্গীত চালিয়ে দিই ল্যাপীতে। পান্নালালের অপার্থিব কন্ঠসুধা বেজে ওঠে, " মায়ের পায়ের জবা হয়ে-"

গান শুনতে শুনতে বেগুনী ভাজি আর বাটিতে বাটিতে মুড়ি সাজাই, এমন দিনে মুড়ি আর বেগুনী খুব জমে। খেতে খেতে আবার ইস্কুলবেলার গল্প শুরু হয়। মাধ্যমিকের রেজাল্টে আগের সব হিসেব উলোটপালোট হয়ে গেল, অজপাড়াগাঁয়ের ঐ স্কুলে অত বেশী নম্বর স্মরণকালের মধ্যে পায় নি কেউ, অবশ্য অন্বেষা সম্পর্কে একটা এধরনের আশা দিদিমণিদের মনের মধ্যে ছিলো, সে কিনা বেশ অন্যরকম, ম্যাজিক-ম্যাজিক টাইপ, তাই একটা ম্যাজিক ধরনের কান্ড সে করে ফেলবে এই রকম আশা অনেকেই করতো।

দু'দিন ছুটি দিলো স্কুল। সেলিব্রেট করতে। আর উচ্চমাধ্যমিকের জন্য ঐ স্কুলেই অন্বেষা রয়ে গেল বলে গ্রুপের বাছা বাছা সব মেয়েই রয়ে গেল। এটাও ঐ স্কুলে অভূতপূর্ব, তার আগে ভালো ভালো সবাই উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হতো পাশের টাউনের অপেক্ষাকৃত ভালো স্কুলে।

অন্বেষা বলে, "ওটাই ভুল হয়েছিলো রে তুলি। বাড়ীর লোকেরা যদি আমায় এটা সেটা বলে ভুজুংভাজাং দিয়ে পুরানো স্কুলেই থাকতে না বলতো, নিশ্চয় আমি থাকতাম না। তাহলে বাকীরাও থাকতো না। আমার সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও ওভাবে সর্বনাশ হতো না দুবছর পরে।"

বেগুনীতে কামড় দিয়ে একমুঠ মুড়ি মুখে পুরে আমি বলি, " আরে ওদের পায়ে দড়ি দিয়ে রেখেছিলো নাকি কেউ? ওরা গেল না কেন? আর সর্বনাশ আবার কী? এই না বললি নম্বর নিয়ে লাফালাফি সবই একেবারে অর্থহীন! "

"তা ঠিক, তবে কিনা ব্যবস্থা তো বদলায় না অত তাড়াতাড়ি, তার মধ্য দিয়েই লড়ে বেরুতে হয় মানুষকে। যে জায়গার যে রীতি।"

আমি হেসে ফেলি, "পথে এসো সখী, এবারে পথে এসো। নোবেল সায়েবের দোরের সামনে দিয়ে দুবেলা যাতায়াত করতে করতে তোমার এখন সেইসময়ের ব্যবস্থা বোকামো মনে হতে পারে, তবে তখন সেটা ছিলো জীবনমরণ। হ্যাঁ রে অন্বেষা, তোকে মাধ্যমিকের পরে নানা জায়গা থেকে সম্বর্ধনা দিতো, কেমন লাগতো রে তোর? "

" আর বলিস না, সে যে কী সর্বনাশ! একেক জায়গায় সভাপতি প্রধান অতিথিদের কী বক্তৃতা, কী বক্তৃতা! কী মারাত্মক বক্তৃতা যে লোকে দিতে পারে!"

" আরে জুনিয়ার স্কুল থেকে যেটা দিয়েছিলো, সেটাতে তো ক্লাসের সবাই গেলাম। বাইরে মঞ্চ বেঁধে তো হয়েছিলো। তোর মনে আছে সভাপতি বক্তৃতা দিচ্ছেন আর বয়েজ স্কুলের এক স্যর যিনি আবার অঞ্চলপ্রধানও, তিনি সামনের সারিতে বসে দুহাতে কান ঢেকে ঘুমাচ্ছেন?"

হি হি করে হেসে উঠি দু'জনেই, আবার যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, স্মৃতি সত্যিই এক আশ্চর্য জগত।

(চলবে )

Tuesday, February 18, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প(২)

মনে পড়ছে সেই দিনটা! স্পষ্ট হয়ে মনে পড়ছে। নাইনের পরীক্ষার সীট পড়েছে দোতলায়, ভীষণ গরম ও লোডশেডিং (লোডশেডিং প্রায় অঙ্গাঙ্গী জড়িত ছিলো গরমের সঙ্গে সেইসব দিনে )৷ সবাই দরদর করে ঘামতে ঘামতে ও আঁচলে মুছতে মুছতে পরীক্ষা দিচ্ছে, সেদিন ইংরেজী পরীক্ষা৷ কাগজ ও প্রশ্নপত্র পর্যন্ত গরম, গার্ড যিনি দিচ্ছিলেন তিনি বোতলে করে জল এনে টেবিলে রেখেছেন, কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে মুখে চোখে দেওয়া হবে৷ পরীক্ষা শেষের যখন আধাঘন্টা বাকী, তখন বিদ্যুৎ এলো, ফ্যান ঘুরতে শুরু করলো ৷হাওয়াটা গরম,তবু তো হাওয়া! ঈশ, যেন সেই হাওয়াটা মুখের আর চুলের উপরে অনুভব করতে পারছি এখনো৷ কিছুই কি ফুরায় না? খানিকক্ষণের মধ্যে হাওয়া ঠান্ডা হয়ে এলো, আমাদের ঘামশুকানো কালচে মুখে শান্তি৷ উত্তর শেষ করে গুছিয়ে বেঁধে জমা দিয়ে বেরোনোর পরে শ্রীতমা বাইরে এসে বললো," পরীক্ষা তো নয়, অগ্নিপরীক্ষা৷"

পরের দিন আরেক কান্ড৷ সেদিন জীবনবিজ্ঞান পরীক্ষা, যথারীতি লোডশেডিং, ঘামতে ঘামতে ও মুছতে মুছতে পরীক্ষা৷ কিন্তু অর্ধেকের পরে হাওয়া ঠান্ডা হয়ে এলো, আলো ও বেশ কমে এলো৷ জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি,"ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে" আকাশ মেঘে ঢাকছে,বৃষ্টির সম্ভবনা, ঠান্ডা স্নিগ্ধ হাওয়া, আহা আহা আহা, কী মধুর৷

কিন্তু মধুতে টক মিশে যায় যখন আর নজর চলে না, এত অন্ধকার৷ এ ঘরে দুখানা টিউবলাইট থাকলে কি হবে, লোডশেডিং তো! জানালার কাছ ঘেঁষে বসে সেই আলোতে প্রাণপণে ছাত্রীরা লিখছে, যাদের আগেই ৮০% লেখা হয়ে গেছে তারা আর দু:সাহসিকতায় না গিয়ে খাতা বাঁধতে শুরু করেছে৷ বিপুল ঝড় এসে হাজির এমন সময়৷ সঙ্গে ছাঁট বৃষ্টি৷ সে এক টোটাল কেওটিক অবস্থা!

জয় মা বলে খাতাটাতা বেঁধে ফেলছে সবাই, এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে নাকি সবাইকে গ্রেস মার্ক্স দেওয়া হবে, জেনারেল গ্রেস৷ এক ঘোর কূটতাত্ত্বিক এই অবস্থায় প্রশ্ন তুললো, "দিদিমণি কারুর যদি এমনিতেই নব্বুই লেখা হয়ে গিয়ে থাকে, সে পুরোটাই ঠিক করে, তাহলে জেনারেল গ্রেসের তিরিশ জুড়ে তো তার একশোকুড়ি হয়ে যাবে!" সকলে তো থ! বলে কী রে এ?

সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের আরেক ঝাপ্টা, কার না বাঁধা খাতার পাতা ফরফর করে উড়ে গেলো, পিছনে দিদিমণি দৌড়ালেন, বাইরে ঠল্লর ঠল্লর শিলপড়ার আওয়াজ! খাতা জমা দিয়ে কয়েকজনের শিল কুড়াতে দৌড়৷ "ওরে ছাতা, ছাতা নে রে, নইলে চাঁদি ফেটে যাবে" বলে তাদের ফেরানো হয়, তারা ছাতা খুলে সামনের খোলা ছাদে শিল কুড়ায়, সাদা হয়ে গেছে তখন সেই ছাদ ৷

সেভেনে এইটে দু'বছর পড়া হতো সংস্কৃত৷ সেটাও একটা অন্য ভাষা, কিন্তু কদর নেই৷ প্রচুর শব্দরূপ ধাতুরূপ মুখস্থ করতে হয় বলে ভারী বিরক্ত সবাই৷ কেউ কেউ নাইনে ঐচ্ছিক বিষয় সংস্কৃত নেয়া যায় এই মর্মে এটাকে গুরুত্বপূর্ণ করার একটা চেষ্টা দেখালে অন্য চটপটে বলিয়ে কইয়ে লীডার গোছের বন্ধুনীদের ধমকে থেমে যায়, এর নাকি কোনো সাবজেক্ট ভ্যালু নেই৷ কোনোরকমে দুবছর তরে গেলেই ব্যস৷

কালের কী পরিবর্তন! মাত্র কয়েকশো বছর আগে এ দেশে শিক্ষা বলতে ছিলো সংস্কৃত মাধ্যম-ব্যাকরণ সাহিত্য জ্যোতিষ তর্ক মীমাংসা৷ আজকের দুনিয়ায় এরা লুজার, সাগরপাড়ের নৌপ্রযুক্তিধারী বিজয়ীরা শুধু আমাদের দেশ দখল করেনি, মন পর্যন্ত কব্জা করেছিলো৷ ওদের রেনেসাঁস? সত্য ত্রেতা দাপরমে কৈ নেহি কিয়া!!!

কেমন করে যেন পশ্চিমের ওরা লীডার, আমরা সবেতে ফলোয়ার৷ আজ যদি ওরা বলে সংস্কৃতের দাম আছে, এইসব লোক, বহুমস্তক একাকার জাতি, মুহূর্তে লয়াল ফলোয়ার হয়ে পড়তে শুরু করবে৷ অথচ আমরা তো এমন করে সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত নাচাতে পারিনে আঙুলের ডগায়!

এইসব কূট প্রশ্ন অবশ্যই তখন দেখা দেয় নি৷ এত সময় কোথায়? ভবিষ্যতের দুনিয়ার চেয়ে আসন্ন পরীক্ষার তাড়া ঢের বাস্তব৷

গোটা ইস্কুলে একজন মাত্র শিক্ষক, বাকীরা শিক্ষিকা৷ এই শিক্ষক হলেন পন্ডিত স্যর৷ ইনি আর রুম্পাদি সংস্কৃত পড়াতেন৷ চটপটে সমাজসচেতন মেয়েরা এও বলতো শুধু নাকি কিছু লোককে চাকরি দেবার জন্য এই হতচ্ছাড়া ভাষার দুটি বছরের ক্লাস যা নিয়ে ভবিষ্যতে কোনো কিছুই করা যাবে না৷ এইটে বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে গেলে সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে ও কালীতলায় পুজো পাঠাবে এই মোটামুটি পরিকল্পনা ছিলো৷

সেভেনে পড়াতেন পন্ডিত স্যর, বার্ধক্য ও দন্তহীনতা তাঁর কথা বোঝার ব্যাপারে বাধা সৃষ্টি করতো৷ তবে খুবই ইন্ট্রোডাক্টোরি লেভেলের পড়া হওয়ায় আর নানা সহায়ক থাকায় তেমন পাত্তা দেয়া হতো না এসব অসুবিধের৷ ক্লাস এইটে রুম্পাদি পড়াতেন৷ খুব ঠান্ডা গোছের মা-মা চেহারার দিদিমণি, মন দিয়ে পড়াতেন৷ আগের বছরের মেয়েরা নাকি খুব দুরন্ত ছিলো, উনি ক্লাসে আসার আগে নাকি বোর্ডে মেয়েরা লিখতো "ফলম ফলে ফলানি/ না পারলে রুম্পা দেবে ক্যালানি৷"

দেখতে দেখতে বছর ঘুরে গেলো, আমাদের বার্ষিক পরীক্ষার শেষে আর সংস্কৃত পড়তে হবে না এই আনন্দে অনেকেই পুজো দিয়ে এলো রক্ষাকালীতলায়৷ ঐ পরীক্ষার দিন আবার আমি আর শুভাশ্রী জানালার তাকে রাখা জলের জাগ উল্টে ফেলে দিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি, তারপরে দুজনেরই মনে পড়ে, "য পলায়তি স জীবতি"৷ সেই মর্মে বাঁচন সেদিন৷

নাইনে আর নেই শব্দরূপ ধাতুরূপের ড্রিল, এইবারে গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজী নিয়ে লড়াই৷ কিন্তু শেষের ও শেষ থাকে কখনো কখনো৷ নাইনে পন্ডিত স্যর রিটায়ার করলেন, আমাদের উপরে পড়লো ওনাকে বিদায় শুভেছা জানানোর ভার৷ অনেক সুমধুর তৎসম শব্দ দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে মানপত্র লেখা হলো, বিদায়ের দিন সকলের চোখ ছলছল৷ রিটায়ারের কয়েকমাস পরে উনি পরলোকগমন করেন৷

আমাদের ওখানে প্রথম বইমেলা হলো ঘোর বর্ষায়, তখন আমরা সবে উঠেছি ক্লাস নাইনে। এতদিন শুধু আমরা শুনে এসেছি কলকাতায় বইমেলা হয় শীতের শেষে, সে এক দুর্দান্ত কান্ড, কিন্তু অতি অল্প কয়েকজন ছাড়া সেই বিরাট বিখ্যাত বইমেলা দেখার সৌভাগ্য কারুর হয়নি৷ ইস্কুল থেকে দিদিমণিরা নিয়ে চললেন আমাদের, রাস্তা জলেকাদায় ভর্তি, মেলা-প্রাঙ্গন কাদা প্যাঁচপেঁচে যথারীতি, কাঠের পাটাতন পেতে পেতে চলার জায়গা করা হয়েছে কোনোরকমে, স্টলের উপরে তাঁবুর কাপড় দিয়ে বৃষ্টির জল আটকানোর প্রচেষ্টা৷ আমরা জলে কাদায় হেঁটে হঁটে পরম উৎসাহে বই দেখতে লাগলাম৷ ভোস্তকের স্টলে তখনো পাওয়া যেতো মানুষের মতো মানুষ, ইস্পাত, পাহাড় ও স্তেপের আখ্যান৷

স্টলের হাসিমুখ ভদ্রলোক কেন কে জানে আমাকে "মানুষের মতো মানুষ" কিনতে উৎসাহিত করলেন, এদিকে আমি দু'খন্ড ইস্পাত নিয়ে ঝুলোঝুলি করছি৷ কিনতেই হবে৷ মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার সময় নাকি লোকে ও বই সঙ্গে নিতে চায়, কী আছে দেখতেই হবে৷ আর এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর মানুষের মত মানুষ আছে, ধলা কুকুর শামলা কান আছে, ওর থেকে এনে তো ওগুলো পড়তেই পারবো৷ কিন্তু এই পাভেল করচাগিনের গল্প আমার নিজের চাই, দৃষ্টি হারিয়ে হাতড়ে হাতড়ে ও কি এমন লিখেছে যে লোকে মঙ্গলগ্রহে নিতে চায়? ভদ্রলোক আমার যুক্তি মেনে নিলেন, দুইখন্ড বই বেঁধে প্যাক করে দিলেন, মহানন্দে ফিরে এলাম ৷

অনেক পরে, অনেক অভিজ্ঞতার পরে দেখেছি এই ইস্পাত, মানুষের মত মানুষ, পাহাড় ও স্তেপের আখ্যান, ধলা কুকুর--এইসব বইয়ে লক্ষ্যণীয় ভাবে অকৃত্রিমের একটা জোরালো রঙ থাকতো যেটা কিনা ইংরেজী বইয়ে খুবই মৃদু৷ সেখানে ব্যাপারটা মানুষকেন্দ্রিক, অনেক বেশী অ্যাকোয়ার্ড গুণের বর্ণনা৷ তুলনায় রুশ বইগুলো শুরুই হতো এইরকম সব বর্ণনা দিয়ে, "ঠান্ডা আলোয় তখনো তারারা ভাস্বর" নিপুণ অকৃত্রিম বর্ণনায় জেগে উঠতো শীতশেষের বরফগলা বনে স্নোড্রপ ফুল, বিশাল মহীরুহসমূহ যেন প্রাসাদের মতন, ছড়ানো ডেইজির মধ্যে বসে আছে এক তরুণী, নদী থেকে স্নান করে ভিজে ডানার মতন পরশ রেখে শস্যমাড়াইয়ের জায়গায় ফিরে আসছে তরুণী, সূর্যমুখী পুষ্ট হয়ে উঠছে আলো শুষে শুষে৷ বারে বারে ফিরে ফিরে তাই ঐ বইগুলো পড়তে ইচ্ছে করে, আমাদের সমস্ত সফিস্টিকেশনের শেকলের আড়ালে লুকিয়ে থাকে যে হৃদয়বাসী মুক্ত দিগম্বর, সে চকিতে দেখা দিয়ে যায় ঐ ঠান্ডা খরশান আলোর তারাদের মধ্যে, ঐ দিগন্তলীন মাঠে কুশবিছানায় ৷

এইভাবে আলোয়-ছায়ায় রোদে-বৃষ্টিতে মায়ায়-নির্মায়িকতায় কোমলে কঠোরে আমরা বড়ো হয়ে উঠতে থাকি, নিজেরা বুঝতে পারিনা, এত তাড়া আমাদের তখন৷ একে ইস্কুল তায় টিউশন পড়তে যাওয়া ৷ ছোটোবেলা যারা গান নাচ আবৃত্তি আঁকা বা অন্য কোনো এক্সট্রা কারিকুলার কিছুতে ঢুকেছিলো, নাইনে উঠে সব বন্ধ রাখে, পরে আবার সময় সুযোগ বুঝে ঝাঁপানো যাবে৷

প্রচুর বিষয় মাধ্যমিকে, অংক, বাংলা, ইংরেজী, প্রকৃতি বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, ইতিহাস ভূগোল কর্মশিক্ষা শারীরশিক্ষা--সব আবশ্যিক৷ শুধু একটি ঐচ্ছিক, কেউ নিতো পদার্থবিদ্যা, কেউ অংক, কেউ জীববিদ্যা, কেউ সংস্কৃত আর বাকীরা গৃহবিজ্ঞান৷ কেন যেন এই ধারণাটা ছিলো সকলের যে যারা পদার্থবিদ্যা বা অংক নিয়েছে তারা একটু কুলীন ধরনের ছাত্রী, যারা জীববিদ্যা নিয়েছে তারাও কুলীন তবে নৈকষ্য নয়, বাকীরা অকুলীন! কেউ এসবের প্রতিবাদ বা অন্যরকম কথা বলে না, হয়তো কোনো অর্থই নেই বলার, সমাজব্যপী ধারনা তো সহজ কথা নয়! ছোটো একটি বিভাজন হয়ে যায় আমরা খেয়াল করিনা, অথবা করি কিন্তু এটাই এত অনতিক্রম্য যে মেনে নিই৷ হয়তো অন্যরকম হতে পারার কোনো প্রশ্নই ওঠে না আমাদের মনে!

শুভাশ্রীর দিদি তখন জয়েন্টের জন্য তৈরী হচ্ছে, সে আমায় বুঝিয়ে দিলো উচ্চমাধ্যমিকে পিওর সায়েন্স নিতে পারলে জয়েন্টে সুবিধে হয়, জয়েন্টে পেলে আর দেখতে হবে না, হয় ডাক্তারি নয় ইঞ্জিনিয়ারিং৷ ওর নিজের ব্যক্তিগতভাবে ইঞ্জিনিয়ারিংএ যাওয়ার ইচ্ছে, এদিকে নাকি বাড়ীতে বলছে মেয়েরা ইঞ্জিনিয়ারিং এ শাইন করতে পারে না ভালো৷ তাই ওকে প্রথমে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে তারপরে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়তে হবে৷

কী সুন্দর ছক করা হিসেব নিকেশ আগে থেকেই করে রাখা! আমার তাক লেগে যায়! তবু কুট কুট করে একটা প্রশ্ন কামড়াতে থাকে মনের মধ্যে, এই দুইখানা লাইন ছাড়া অন্যদিকে যাওয়ার পথ নেই? তাহলে রিসার্চ কারা করে, নতুন আবিষ্কার কারা করে? শুভাশ্রীকে জিজ্ঞেস করতে ও স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলো ওসব লাটসাহেবীর রিস্ক এখানে, এ গরীব দেশে চলেনা, আইআইটি থেকে যারা পাশ করে বেরোয়, তারা আমেরিকা গিয়ে তারপরে রিসার্চ টিসার্চ ইত্যাদি করতে পারে যদি চায়!

আমার তো শুনে আরো তাক লেগে যায়! বলে কী মেয়েটা? আইআইটি মানে কি সেই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলো যেখান থেকে নানারকম গল্প আসে? আরশোলা নিয়ে বক্তৃতা দিতে বলেছে আইআইটি ড়্যাগিং এর সময়, এইটাই যেখানের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ গল্প, বাকী সব ভয়াবহ? ইলেকট্রিক শক টক নাকি পর্যন্ত দিয়েছে, তিনতলার ছাদের আলসেতে হাঁটতে বাধ্য করেছে পা ফসকে নাকি একজন পড়েও গেছিলো, এইরকম সব ভয়াবহ কথাও শোনা যেত।

ও বলে হ্যাঁ, সেই আইআইটি ৷ ওর এক মামাতো দাদা নাকি ওখানে আছে৷ ও আরও বলে ড়্যাগিং ভালো জিনিস, ওতে নাকি লোককে স্মার্ট করা যায়৷ শুনে আমার এত তাক লাগলো যে আর সেদিন কিছু জিজ্ঞেসই করতে পারলাম না৷

স্কুলে আমাদের অংক শেখান এণাক্ষীদি, অরুণাদি প্রকৃতিবিজ্ঞান, এদের দু'জনের ক্লাস নাকি খুব মন দিয়ে করতে হবে৷ রুবীদির জীববিদ্যাও৷ যদিও প্রাইভেট দিদিমণি মাষ্টারেরা বুস্টার ডোজ পরে দেবেনই, মোটা মোটা নোটও, তবু এদের ক্লাস মন দিয়ে শোনা ভালো, সেফসাইডে তো থাকতে হবে, নাকি? যদিও ইস্কুল শুধু নিয়মরক্ষার জিনিস, এখানে না এলে ডিগ্রী মেলে না, তাই আসা৷ এই ধারণা এত সর্ব্যব্যাপী যে কিছুই বলে ওঠা যায় না অন্যরকম ৷

কিন্তু মজাও হয় কখনো কখনো৷ ইতিহাস পড়াতে আসেন শিলাবতীদি, এসেই প্রথমে একটি সস্নেহ ধমক, "মেয়েরা, চু-উ-প করো! বাপরে কী টকেটিভ কী টকেটিভ! " বই খুলে পড়ে যান ইতিহাসের নানা ব্যাপারস্যাপার, কোনো কোনো অংশে এসে বলেন "এসব পোড়ো না মেয়েরা, সময় নষ্ট৷" সাজেশান দেন কী কী পড়তে হবে মাধ্যমিকের জন্য৷ বলেন, "জানি তোমাদের অনেকের অন্য বিষয়ে প্রাইভেট টিচার থাকলেও ইতিহাসে নেই, তাই এখানেই সাজেশান গুলো নিয়ে নাও৷"

ওনার এই সময় নষ্ট আর টকেটিভ এই দুটি ক্রমশ ওনার সঙ্গে সমার্থক হয়ে পড়তে থাকে৷ আমরা নিজেরা হাসাহাসি করি, ইতিহাসের শিক্ষিকা নিজেই বলছেন ইতিহাস পড়া সময় নষ্ট-এর চেয়ে সাংঘাতিক তির্যক কমেডি আর কী হতে পারে?

আর ছিলেন কুন্তলাদি, ইনিও প্রকৃতিবিজ্ঞান পড়াতেন, এনার নাম মেয়েরা বহুকাল ধরেই দিয়েছিলো চিন্তামণিদি৷ কারণ কোনো প্রশ্নের উত্তর বা অন্য কোনো কিছু এনার কাছে জানতে চাইলেই ইনি নাকি বলতেন, " দাঁড়াও আমি একটু চিন্তা করে নিই" বলেই গভীর চিন্তায় ডুবে যেতেন।

( চলবে )

Friday, February 7, 2014

ইস্কুলবেলার গল্প (১)

কত বছর হয়ে গেল, এখন পিছন ফিরে দেখলে মনে হয় যেন গতজন্ম ৷ অথচ সেরকম ততবেশী কি ? হ্যাঁ, আমাদের মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরুনোর দিন৷ তখন না ছিল এত কম্পুটার, না ছিল ইন্টার্নেটের এমন রমরমা ৷ দিদিমণিরা মাস্টারমশায়েরা নিজেরা গিয়ে বড় চটের ব্যাগে ভরে নিয়ে আসতেন ছাত্রছাত্রীদের ফলাফলের কাগজপত্তর ৷ প্রথম দিন শুধু মুখে মুখে জানিয়ে দিতেন, পরের দিন হাতে পাওয়া যেতো ৷

উ:, সে কি টেনশান, সে কি টেনশান ৷ পাড়াগেঁয়ে ইস্কুল হলে হবে কি, মুখে মুখে কাগজে কাগজে রেডিও টিভিতে গরম আবহাওয়া তৈরীর টেকনিক তখনি তৈরী হয়ে গেছিল৷ তাই টেনশান ৷

সেদিন সকাল থেকে যতবার টেনশান হাল্কা করার কোনো গপ্পের বই পড়ার জন্য হাতে নিচ্ছি কেবল খুলে যাচ্ছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশফেল৷ সে কি যন্ত্রণা রে বাপু! কেন যে ও বইটাই উঠছে হাতে কে জানে, আর ও পাতাটাই বা খুলছে কেন?

মাধ্যমিকের প্রায় তিনমাস পরে তখন বেরুতো ফল, সেই সময়টায় অনেকেই প্রাইভেট টিউটরদের কাছে হায়ারের জন্য পড়তে লেগে যেতো, বইপত্তরও কেনা হয়ে যেতো৷ আসলে ঐ গপ্পোটা হায়ারের সহায়ক পাঠে পাঠসঙ্কলনে ছিল ৷ বেশ ভালো ভালো ছোটোগল্পের কালেকশান ছিল ঐ বইটা। হায়ার সেকেন্ডারিতে বেশ বাধ্যতামূলকভাবে কিছু ভালো বাংলা ছোটোগল্প পড়া হয়েছিলো অনেকের ঐ বইটার সৌজন্যে।

তো পাশফেলের গপ্পোটায় ছিল দুইজন বন্ধুর মধ্যে একজন ভালো রেজাল্ট করে অন্যজন পাশ করতে পারে নি৷ ভালো ফলের ছাত্রটির নাম ছিলো নীরেন, ওর বাবা যখন তাকে জানালেন তিনি আর পড়াতে পারবেন না, নীরেন যেন কাজের চেষ্টা করে, এই শুনে নীরেন বিষ খেলো৷ মানেবইয়ে আবার ব্যখ্যা ছিলো নীরেনই আসল বীর, সে জীবনকে আছড়ে ভেঙে জীবনকে ছাপিয়ে গেছে, আহা মধু মধু!!!! কী ব্যাখ্যাই না শোনালেন! এমন আর হয়?

আজকে এই সাদাকালো সাহেবেরা যদি এসব শোনে অবাক হয়ে মেঝেতে পড়ে যাবে নির্ঘাৎ ! ভাগ্যিস এসব এরা জানে না, মানে বিশেষ তো এসব বাজে খবর আসে না বাইরে, ভালোগুলোই আসে, তাই আসার কথা৷

তো আমরা অকুতোভয়, টেনশানে সেঁকা হলেও, আমাদের সামনে অক্ষয় নীরেন ৷ কমন রুমে সবাই মিলে ছিটিয়ে-ভিটিয়ে বসে আছি, গানের লড়াই চলছে, খবর এলো এক দিদিমণির মেয়ে, সে কলকাতার ইস্কুলে পড়ে, দিদিমণিও কলকাতার, তো সেই মেয়ে ও মাধ্যমিক দিয়েছিলো, সে সাতশো চব্বিশ না কত পেয়েছে, শুনে গান থামিয়ে তিড়িং করে উঠে পড়লো সবাই, চললো দিদিমণির খোঁজে ৷

নাতিদীর্ঘ ফুটফুটে ফর্সা পুতুল-পুতুল গড়নের ছিলেন সেই দিদিমণি, বোর্ডের পাশে চেয়ারে বসে বসে কী অপূর্ব কৌশলে যে তিনি বোর্ডে লিখতেন সেই টেকনিক আজও অজানা৷ তো পরে এগারো-বারোতে ঐ কৌশলের নাম দেয়া হয়েছিলো কৌণিক আক্রমণ, অবলীলায় বসে বসে ছোটো চেহারার উনি বোর্ডের এককোণে কেমিস্ট্রির সমীকরণ ইত্যাদি লিখতেন ৷

তো সেদিন সবাই খুব করে প্রণাম করা হচ্ছে, যেন উনি ওনার মেয়ের ভালো রেজাল্টের পুন্যফল কোনো না কোনোভাবে এই আমাদের খানিকটা টাচ টেকনিকের দ্বারা দিয়ে দিতে পারেন!

তো আরেকটু বেলা গড়ালো, এসে পড়লেন রুবীদি, উনি আর পাঞ্চালীদি একসঙ্গে গিয়ে ব্যাগে পুরে এনেছেন আমাদের জীবন অথবা মৃত্যু ৷ এতখানি ক্ষমতা যে যিনি সেদিন ধরেছিলেন তা কি তিনি নিজেও জানতেন?

আমরা সংশপ্তক বাহিনী, চোখের পাতা না ফেলে চুপ করে থাকি অপেক্ষায়, ঐ টিচার্স রুম থেকে কী সংবাদ আসে, কে থাকবে আর কে থাকবে না ৷ মহাভারত আমাদের জানিয়েছিলো কাকে বলে সংশপ্তক, যুদ্ধে যারা নিজেদের শ্রাদ্ধ করে নিয়ে তারপরে লড়তে যায়, লড়াইয়ের ময়দান থেকে বাড়ী ফিরবে না যারা আর ৷ নিজেদের আমরা তাদের সঙ্গে আইডেনটিফাই করতে পারতাম কি অনায়াসে, না মহাভারত দিয়ে নয়, তার আধুনিক ভার্সন সুইসাইড বম্বারদের দিয়ে ৷ ততদিনে রাজীব হত্যার ঘটনায় সবাই জেনে গেছে কাদের বলে সুইসাইড বম্বার, তার আগেও হয়তো লোকে জানতো ততটা প্রচার পায় নি৷ শান্ত ঠান্ডা নিজকেন্দ্রিক অযথা বড়ো করে দেখানো কম্পিটিশানপ্রবণ জীবনে আসলে যুদ্ধটা যে কোথায় তা কি সত্যি আমরা জানতাম? অথচ কি অনায়াসে ঐসব বুনে গেছিলো আমাদের মনে, প্রত্যেকে কি সাংঘাতিক সমাধান ভেতরে পুরে নিয়ে বেড়াচ্ছিলো! শিক্ষিকারা আমাদের পড়াতেন রবীন্দ্রনাথের এত এত দার্শনিক কথাওলা লেখা, এত সব পজিটিভ আউটলুকওলা নানাধরনের লেখা,অথচ কেমন করে কেজানে আমরা বড়ো হয়ে উঠলাম মরণের মুখে মুখ ঘষাঘষি করে!!!

এক ভারী চটপটে বলিয়ে কইয়ে বন্ধুনী ছিলো, শ্রীতমা ৷ সে তো আরেক বন্ধুনীর পটাশিয়াম সায়ানাইডপ্রিয়তা দেখে এককথায় পরামর্শ দিয়ে দিলো এল টি টি ই তে গিয়ে যোগ দিতে ৷ সে বন্ধুনী তো অবাক, হঠাৎ সেখানে কেন? শ্রীতমা কইলে, "না অন্য কিছুর জন্য না, ওরা ফ্রীতে পটাশিয়াম সায়ানাইড দেয় !" বোঝো কান্ড!

এই শ্রীতমা যে সে মেয়ে ছিলো না, খুবই চমৎকার মেয়ে ছিলো৷ একেবারে নার্সারী থেকে কী নিটোল গুল দিতে যে পারতো সে না শুনলে কেউ বিশ্বাস করবে না৷ শুনে প্রায় মেঝেতে পড়ার উপক্রম হতো৷ বলতো," হ্যাঁ রে তোর মা কি বি এ পাশ? হ্যাঁ শুনে বলতো," জানিস, আমার মা বি এ এমএ আর ল পাশ৷"

বন্ধুবান্ধবসহ আমি চোখ গোল গোল করে," ল পাশ, তোর মা ল পাশ?"

চোখমুখ অত্যন্ত চোখা করে শ্রীতমা," শুধু ল না, সঙ্গে ব আর ধ টাও পড়েছিলো ৷"

ভাবা যায়, তখন আমাদের পাঁচ বছর বয়স!!!!

আরেক বন্ধুনী ছিলো শুভাশ্রী৷ সে গুলটুল দিতো না, সে স্বপ্ন-দেখা দুর্বল মেয়েও ছিলো না, খুব শাণিত বুদ্ধির মেয়ে ছিলো, তেজে জ্বলজ্বলানো চেহারা ছিলো শুভাশ্রীর৷ ওর দিদি আমাদের কয়েক ক্লাস উঁচুতে পড়তো, সেই দিদি পড়াশোনায় দারুণ ভালো, নিঁখুত সুন্দর দেখতেও৷ কোনো কোনো বছর ওর দিদি ফার্স্ট হতো বলে দিদিমণিরা শুভাকে বলতেন, "তোর দিদি ফার্স্ট হয়, তুই হতে পারবি শুভাশ্রী?"

শুভা সতেজে বলতো, "শুভাশ্রী চক্রবর্তীর সঙ্গে অন্য কারুর তুলনা করতে আসবেন না দিদিমণি, এটা হয় না৷" আমরা তো শুনে থ! দিদিমণিদের সঙ্গে এমন জোরালো তক্ক!

শুভাশ্রীর কথা বলতে গেলে ফুরাবে না কোনোদিন, অথচ মাত্র কয়েকটা বছরের জন্য একসঙ্গে ছিলাম, আরো অল্পদিনের জন্য কাছের বন্ধু ছিলাম৷ তীব্র ব্যক্তিত্ব-জ্বলজ্বল মেয়েটি মাঝে মাঝেই অপ্রিয় বাক্য বলতে পটু ছিলো, তা সত্বেও এত খাঁটি একটা কিছু ছিলো ওর মধ্যে, যে লোকে বন্ধু হয়ে যেতো সহজে, মুগ্ধ হয়ে যেতো সে বন্ধুত্বে৷

শুভাশ্রী আর শ্রীতমা একদম বনতো না, সর্বদা এ ওর লেগ পুল করতো সামান্য ফাঁক পেলেই, সাদামাঠা স্কুলদিন দিব্যি জমে থাকতো নানা চাপানে উতোরে৷প্রথম ফাইভে যখন ও স্কুলে ভর্তি হয়েছি, তখন শুভা আলাদা সেকশানে, আমার বন্ধুরা তখন সম্পূর্ণ আলাদা একটি গ্রুপ, জয়তী, কুহেলী, বিজয়া, মীনাক্ষীরা৷ শুভাশ্রীর সঙ্গে প্রথম দেখা কুইজের আসরে, শীর্ণ দীর্ঘ অতিরিক্ত ফর্সা মেয়েটির এতই অন্যরকম অ্যাপিয়ারেন্স যে চোখ টেনে নেয়৷

সিক্সে একই সেকশানে চলে এলাম এই সবাই, শুভাশ্রী, শ্রীতমা, কুহেলী, মীনাক্ষী, দীপশিখা, শিবানী, সুগোপা সবাই ৷ আর ছিলো এরা৷ এর নাম নিয়ে দারুণ কনফিউশান, ও যত বলে আরে আন্তর্জাতিক নারীবর্ষের কথা ভেবে নাম রাখা হয়েছে এরা(Era), কে শোনে কার কথা! একে পাতি বাংলা স্কুল, তায় অজ-পাড়াগাঁ, সেখানে এরাই বা কি ঈপোকই বা কি ঈপোক-মেকারই বা কে!

বিভা দিদিমণি অংক করাতে আসতেন, বয়স্ক রাশভারী কিছুটা রাগী গোলগাল চেহারা, দিদাদিদা গোছের দিদিমণি৷ অংকটংকে জট লেগে গেলে দুইঘর দূরে টিচার্সরুমে গিয়ে এণাক্ষী দিদিমণির কাছ থেকে জেনে আসতেন কেমন করে সে জট ছড়ানো যাবে৷ উনি আসলে অংকের লোক নন, উনি সেলাইয়ের ট্রেনিং নিয়ে এসেছিলেন৷ কিন্তু এরোপ্লেনের মিস্ত্রীও যেমন কালের ফেরে এরোপ্লেন চালাতে নেমে পড়ে তেমনি উনিও অংক করাতেন, মাত্র তো ক্লাস সিক্স, এদের সামান্য কটি পাটিগণিত আর জ্যামিতি করাতে আবার কী লাগে, এই ছিলো হয়তো যুক্তি৷

তো একবার ক্লাসের পরীক্ষায় উনি প্রশ্ন দিয়েছেন সূক্ষ্ম কোণের দ্বিবিভাজন, তো পেন্সিল কম্পাস দিয়ে যেভাবে করা হয় সেইভাবে করলাম, কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ে বড়ো ব্যাসার্ধ নিলাম, অর্ধেকের চেয়ে বড়ো নিতে বলা ছিলো, নিলাম পুরোর চেয়ে বড়ো৷ সূক্ষ্মকোণ দিব্যি হাফাহাফি হলো, কিন্তু উনি মেথডের এই ডেভিয়েশানে অত্যন্ত ব্যথিত ও চিন্তিত হয়ে নম্বর দেবেন কি দেবেন না এই দ্বিধায় জর্জরিত হয়ে টিচার্স রুমে চলে গেলেন৷ খানিক পরে ডেকে পাঠিয়ে কইলেন এণাক্ষী বলেছে ঠিক আছে, বলে নম্বর দিলেন৷ সেদিন কেমন যেন লেগেছিলো কিন্তু পরে অনেক বড়ো বড়ো জায়গাতে বড়ো বড়ো উচ্চপর্যায়ের লোকেদের মধ্যেও এই জিনিস দেখেছি, তাই আজ আর ঐ দিদাদিদা গোছের মানুষটিকে খারাপ লাগে না৷ সামান্য চেনা পথের বাইরে যেতে পোড় খাওয়া লোকেদেরও এত দ্বিধাদ্বন্দ্ব!

সিক্সে ইংরেজী পড়া শুরু, ভারী উত্তেজনা৷ ইংরিজী যে বাংলার মতই আরেকটা ভাষামাত্র, তা মনে হতো না, এটা যেন খুবই সাংঘাতিক ভয় ভক্তি করার মতন একটা জিনিস, খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার, মোটেই বাংলা ব্যাপার নয়! আরে বাংলা? ছো:? ওতে কোয়ান্টাম পড়া যাবে? স্পেস-টেকনোলোজি আয়ত্ত করা যাবে? কখনো না৷ বন্ধুনীরা ভালো করে বুঝিয়ে দিলো, ইংরেজী একমাত্র ভাষা যা কিনা আমাদের স্পেসে তুলে দেয়৷ টেলিস্কোপ মাইক্রোস্কোপের জটিল পথে আমাদের ভবিষ্যৎ উন্নতির দিকে ঠেলে দেয়৷

তখন অজানা থাকায় আমাদের তর্ক উঠতে পারেনা, রুশরা রুশ ভাষাতে স্পেস টেকনোলোজি শিখেই তো স্পেসে চলে গেছিলো? কিংবা তেমন বেয়াড়া হয়তো কেউ ছিলো না যে এই প্রশ্ন করতে পারে৷ কৃপন বর্তমান ও নিরাপত্তার অভাব৷ কিংবা এসব কিছুই না, সত্যিই ইংরেজী ভাষাটাই এমন যা কিনা সত্য ত্রেতা দ্বাপরমে কৈ নেহি কিয়া!

সেই ভাষা আয়ত্তে ঝাঁপিয়ে পড়ি আমরা৷ লার্ণিং-ইংলিশ বইয়ে যে চ্যাপ্টারগুলি ছিলো, তা আমাদের খুব বেশী সাহায্য করতে পারে না, এদিকে পুরানো বইয়ের তাকে লালমলাট দেয়া উইয়ে খাওয়া মোটা ইংরেজী আরব্যরজনী৷ এইভাবে শিখতে শিখতে কবে ওটা পড়তে পারবো কে জানে! কী সুন্দর সব ছবি ছিলো! আহা ওদের গল্পও না জানি কত সুন্দর৷

সেসব হয় না, অবশ্যই না, ক্লাসের কাজগুলো উতরেরে দেয়ার জন্য ছাত্রবন্ধু থাকে, নোট থাকে, আমরা লিখতে শিখি না, টুকতে শিখি৷ মানে দেখে টোকা না, সেটা বে-আইনী, কিন্তু মুখস্থ করে পরে মেমোরির থেকে লেখাও একরকম টোকাই তো, না? আমাদের কেউ বলে দেয় না, এটা অনুচিত, বরং বড়ো বড়ো নোট দিয়ে রচনা মুখস্থ করতে উৎসাহিত করা হয়৷ যে যত ভালো পারবে সে তত ভালো! অদ্ভুত এক ব্যবস্থা!

আমরা নতুন ভাষাটা বলতে শিখি না, শুনতে পাইনা, শুধু শিখি দ্রুত পড়তে আর প্রাণপণে টুকতে! অথচ এত কড়াকড়ি হাঁসফাঁস দৌড়ের কোনো প্রয়োজন ছিলো না, বাংলার মতন এটাকেও আমাদের কাছের করে নেওয়া যেতো, এমন কিছু সাংঘাতিক বেশী দামী জিনিসের দরকার ছিলো না, শুধু ইস্কুলের লাইব্রেরীতে দু'চারটে বেশী বই, একটা টেপ আর কিছু ক্যাসেট৷ ছাত্রীরা উৎসাহীই ছিলো, ঐ বারোতেরো বয়স উৎসাহেরই সময়, সদ্য নতুন হাতে পাওয়া খেলনার মত মুচমুচে একটা ভাষা! কিছু বেশ ভালো শিক্ষিকাও ছিলেন, ঐ কাঠামোতেও৷এমন কিছু সাংঘাতিক পয়সার দরকারও ছিলো না, স্কুল ফান্ড থেকেই ও কটা বই আর টেপ হয়ে যেতো, কিন্তু কেউ ভাবেই নি!

তো, ওভাবে পড়ে টুকেই বছর কেটে যেতে যেতে নাইনে সকলেই প্রাইভেটে পড়তে ঢুকে গেলো৷ সেই দিদিমণি বেশ ভালো, যত্ন নিয়ে গ্রামারও পড়াতেন৷ বাড়ীরে বইয়ের পাহাড়৷ পড়তে দিতেনও৷ খুব ভালো সুলিখিত নোট দিতেন, কিন্তু ছাত্রছাত্রী নিজে লিখতে চাইলে দিতেন না, বলতেন রিস্ক তিনি নিতে পারবেন না, নিজে লিখতে গিয়ে যদি ছাত্রের নম্বর কম হয়, তখন?

নম্বর৷ নম্বর৷ সংখ্যা৷ স্কোর৷ মার্কস৷ পরীক্ষায় পাওয়া সংখ্যাবলী৷ এই সংখ্যাগুলো আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হয়, যেন তেন প্রকারেণ একটা ভালো নম্বর যেন ওঠে৷ কে কতটা শিখতে পারলো বা আত্মস্থ করতে পারলো সব গৌণ হয়ে যায়৷ স্কিল কার কত কে জানে, কিন্তু একমাত্র বিচারের উপায় পরীক্ষায় পাওয়া নম্বর৷ তাই সেটা এতখানি জীবনমরণ তফাৎ গড়ে দেয়৷ যার বাপমায়ের যতটা সাধ্য, সেই অনুযায়ী প্রাইভেট টিউটর, ইংরেজী আর অংকের তো প্রায় কম্পালসারি৷ বাকীগুলোর মধ্যে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর জন্য, কারু কারু ইতিহাস ইত্যাদির জন্যেও৷

অথচ মাধ্যমিক স্তরে কিন্তু আমাদের ঐ বাংলা গার্লস ইস্কুলের মধ্যেও বেশ কিছু ভালো সিরিয়াস পড়াশুনো হতো, ভুগোলের এক দিদিমণি ছিলেন যিনি প্রায় হাতে ধরে ম্যাপ চিহ্নিত করা ইত্যাদি শেখাতেন৷ নিয়মিত করাতেন ক্লাসে ও বাড়ীর কাজ দিতেন৷ অংকের এণাক্ষীদি ও তেমনই ভালো শিক্ষিকা, ধরে ধরে সিরিয়াস পড়াতেন৷ জীববিদ্যার রুবীদিও খুব ভালো ছিলেন৷

ভরসা করতে পারলে হয়তো প্রাইভেট টিউটর লাগতো না, কিন্তু ব্রাত্য হয়ে যাবার ভয় থাকতো, ঠিক যেমন দুর্গাপুজায় নতুন জামা না হলে ব্রাত্য হয়ে যেতে হয়! তাছাড়া এইসব বিভিন্ন স্কুল শিক্ষক বা শিক্ষিকা যারা প্রাইভেট টুইশনি করতেন, তাদের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম অদৃশ্য পলিটিক্সের খেলা চলতো, কে কার গ্রুপে আছে, এটা অত্যন্ত ইম্পোর্ট্যান্ট ছিলো৷ পরে বহু পরে এইচ এসেরও পরে এটা টের পেয়েছিলাম৷

শুধু এই প্রাইভেট টিউটর আলাদা বলে স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে ধীরে পাঁচিল উঠতে থাকে, আমরা মহাদেশ ছিলাম, ছোটো ছোটো দ্বীপে ভাগ হয়ে যেতে থাকি, সেই দ্বীপগুলো ক্রমাগত অসেতুসম্ভব হয়ে পড়তে থাকে৷ তবুও আমরা সেতু গড়ার চেষ্টা রাখি, চেষ্টা রাখি, কখনো কখনো একে অন্যের দ্বীপে পৌঁছতে পারি কোনো অল্প সময়ের জন্য৷

সেই ভাগ হয়ে যাবার শুরু৷ পরে সারাজীবন ধরে ভাগের পর ভাগ, পাঁচিলের পর পাঁচিল পরিখার পর পরিখা৷ কিসের এত যুদ্ধ, কার সঙ্গে যুদ্ধ? কে জানে! আমাদের রক্তকণিকায়ই হয়তো রয়ে গেছে এই ভাঙনপ্রবণতা, হয়তো মিলে থাকতে চাই, তবু কিছুতেই পারি না৷ আজ সেই শুভাশ্রী, শ্রীতমা, দীপান্বিতা, সুগোপা ----কোথায় ? সকলেই নিজ নিজ কক্ষপথে চলতে চলতে পৃথক পৃথক জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছে৷ কেউ ঘোরতর সংসারী, কেউ চাকরি করছে৷ কেউ নিজ রাজ্যেই কেউ অন্য রাজ্যে বা অন্যদেশে৷ সব স্মৃতি জলের আল্পনার মতো উবে গেছে ৷ গেছে কি?

(চলবে )