Saturday, October 26, 2013

হেমন্তদিনের পথযাত্রা

সে অনেকদিন আগের কথা। আমাদের দীর্ঘ পথযাত্রা শুরু হয়েছিলো এক অক্টোবরের শেষদিনের দুপুরে। মোবাইলে আবার সব সবক'জনে মিলে "রোড ট্রিইইইইপ" বলে একজনকে শোনানো হচ্ছিলো আর উনি মোবাইলের মধ্য থেকে অভূতপূর্ব শব্দ শুনে হাসছিলেন।

যাইহোক, পালা করে চালানো হবে ঠিক হয়েছিলো আর যদ্দূর যাওয়া যায় গিয়ে গভীর রাতে কোনো সরাইয়ে ওঠার কথা ছিলো। হাজার মাইলের পথযাত্রা, একটানা তো সম্ভব না। থামতেই হবে। কিন্তু প্ল্যান অনুযায়ী কিছু হলো না, বিকালে এক ইটালিয়ান রেস্তরাঁয় খেতে থামা হলো, সেখানে বেশ অনেকটা সময় লেগে গেলো এক সঙ্গী একটু অসুস্থ হয়ে পড়ায়।

পরে রাত্রে গাড়ী চলছে, যিনি চালাচ্ছেন তার ঘুম এসে যাচ্ছে, পাশ দিয়ে দৈত্যের মতন সব ট্রাক... ভয়ে উদ্বেগে বাকীরা অস্থির। রাত একটায় থামা হলো পথের ধারের কম্ফর্ট ইন এ। দোতলায় দুই ঘর মিললো,সব কজনে দুই ঘরে ভাগ হয়ে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া, সকালে উঠে ফের নতুন করে পথে, হিট দ্য রোড এগেইন...

এসব দীর্ঘ যাত্রায় অডিও-বই খুব ভালো জিনিস, যন্ত্রের মধ্য থেকে শান্ত ধীরগতি গলাটি পড়ে যায় গল্প, শুনতে শুনতে চালাতে থাকে চালক, শুনতে থাকে অরোহীরা, পথের একঘেয়েমি কেটে যায়। সেই বেতালের গপ্পো শুনতে শুনতে রাজা বিক্রমের পথচলার মতন, তবে গল্পের শেষে প্রশ্ন নেই, এইটা অনেক সুবিধে।

বনপাহাড়ের ভিতর দিয়ে কেটে বেরিয়ে গেছে আন্তঃরাজ্যমহাসড়ক। চারিপাশে ছড়ানো হেমন্ত সৌন্দর্য্য। পাহাড়ের গা ভরে সমস্ত গাছপালার পাতাগুলো রঙীন হয়ে গেছে-লাল, বাদামী, কমলা, হলুদ-ঝরে যাবার আগে ওরা এত রঙীন হয়ে যায়, তারপরে গাছেরা ন্যাড়া বৈরাগী হয়ে যাবে গোটা শীতকালের জন্য, এ ক্ষণিক রাঙাবাস খসে যাবে ধারালো শীতবাতাসে, তারপরে নামবে তুষার। এখন এই অপূর্ব ফল-কালারের উপরে ঝলমল করছে হেমন্তের সোনালী রোদ,নেশা ধরানো সৌন্দর্য্য। মনে পড়ে যায় এই সময়েই তো আমার দেশে ধানের উপরে কোমল উজল রোদ ছড়িয়ে গেছে দূর কতদূর...

এরপরে তো ধান পাকবে, ধানকাটা হবে, তুলে আঁটি বেধে নিয়ে যাবে, গাঁয়ের পথ ভরে যাবে ধান্যসুবাসে...

দেখতে দেখতে পাহাড়নদীর পাশ দিয়ে ভুটাক্ষেতের দেশে চলে আসি আমরা। যে ছোট্টো শান্ত শহরটিতে আমরা অতিথি, সেখানে গিয়ে মুগ্ধ। বিশাল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সমস্ত গাছেরা ফল কালারে সেজেছে, অবর্ণনীয় সৌন্দর্য্য। ছবিতে এর শতাংশে একাংশও ফুটবে না, তবু ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক। বহমান সময়ধরাকে দু'হাতের অঞ্জলিতে একটুখানি ধরে রাখার চেষ্টা। চিরবৃদ্ধ অথচ চিরতরুণ কাল হাসে মানবশিশুদের ব্যর্থ এ চেষ্টা দেখে।

গিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেছিলো, হোস্ট ভদ্রলোক নিয়ে গেলেন ডিনারে। এঁরই ষাটতম জন্মদিন উপলক্ষ্যে কনফারেন্স, আয়োজন করছেন প্রাক্তন ছাত্রশিষ্যেরা।

ডিনারের জন্য বুক করা ছিলো ঝর্ণাধারার কাছ ঘেঁষে হোটেল, ঝর্ণার উপরে মুখ বাড়ানো একটি ঘর, চারিধারে স্বচ্ছ কাঁচ আবরণী ঘেরা, সেখানেই আয়েশ করে বসে অতিথিদের খাদ্যপানীয়ের ব্যবস্থা।তখন সূর্য পশ্চিমে একদম দিগন্তে ঢলে গেছে, আলো আঁধারি জলধারার উঁচু পাড়ির উপরে একটি গাছ হেমন্তে সোনালী হয়ে যাওয়া পত্রসম্ভার নিয়ে ঝরঝর করে কাঁপছে সন্ধ্যার বাতাসে---কী অপূর্ব অনুভবী দৃশ্য। পৃথিবী কী আশ্চর্য সুন্দরী! ঋতুতে ঋতুতে প্রহরে প্রহরে কী অপরূপ তার সাজবদল রঙবদল সুরভিবদল সুরবদল। অবন ঠাকুরের ছবিকলমখানি থাকলে হয়তো বর্ণনা করতে পারতাম, কিন্তু আমার ছবিহীন এই রুখু কলমে সে বর্ণনা অসম্ভব।

তবু কেন লিখি? কেন এই অস্থির আকাঙ্ক্ষা? মনে হয় আকাশ-বাতাস জল-পাহাড়-গাছপালা-মানুষজন সব কিছু নিয়ে সমস্ত দৃশ্যখানি নকশীকাঁথার মতন মুড়ে উপহার পাঠিয়ে দিই সেই প্রিয়জনকে যে প্রান্তটুকু ছুঁয়েই বুঝে ফেলবে গোটাগুটি সবটাই, যা দেখা যায় তাও যা না দেখা যায় তাও-যা কিছু রয়েছে আঁকা আর যা কিছু পাওয়া গেলো অনুভবে-তার এতটুকুও বাদ যাবে না ওর বুঝতে। কিন্তু সেতো হবার নয়, এ যে জলচারী মীনের আকাশ ছোঁয়ার সাধ! তাই বুঝি দেখতে গিয়ে সব ঝাপসা হয়ে যায় নোনতা অশ্রুতে?

দু'দিন থাকা হলো সেখানে, সদ্যপরিচিত মানুষগুলোর আন্তরিক আতিথেয়তা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। পৃথিবীতে কত ঋণ থেকে যায়, কোনো কোনো ঋণে ঋণী থেকেই সুখ। "তুমি যে তুমিই ওগো, সেই তব ঋণ..."

ফেরার পথ আবার সেই অপরূপ সৌন্দর্য্যের মধ্য দিয়ে-পথে বেরুলেই কেমন একটা লাগে, বোধহয় সেই বিস্মৃত পূর্বজদের যাযাবর রক্ত বুকের মধ্যে কোলাহল করে ওঠে, সেই যে এক কবি বলেছিলো- "তারাই যথার্থ যাত্রী যারা চলে যায়

কেবল যাবারই জন্য-

হাল্কা মন, বেলুনের মতন

নিশিত নিয়তি ফেলে একবার ফিরে না তাকায়

কেন তা জানে না,তবু চলো চলো বলে অবিরত

তাদের বাসনা পায় মেঘপুঞ্জে উজ্জ্বল বিন্যাস

স্বপ্নে হানা দিয়ে যায় সৈনিকেরে যেমন কামান

অপরিবর্তনীয় দেশ, মহাশূন্যে ইন্দ্রিয়বিলাস

যার নাম কখনো জানে নি কোনো মানবসন্তান..."

বনপাহাড়ীর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ যাত্রায় বারে বারে ফিরে আসে কবেকার এই লাইনগুলো, উড়ন্ত রঙীন পালকের মতন ভেসে যায় যেন, আকাশে তখন রঙীন মেঘ, বেলা ঢলে এলো, আরেকটু পরেই রাতবাতিরা জ্বলে জ্বলে উঠবে। রাত্রির সরাই এ বিশ্রামের পরে আবার পরদিন সকালে চলা শুরু, একসময় এসে গেল চেনা শহর, ক্লান্ত আমরা ফিরে যাবো যে যার নীড়ে।

কিন্তু পথ ফুরাবে না, সে অনিঃশেষ বয়ে গেছে, এক সূর্যোদয় থেকে নতুন সূর্যোদয়ের দিকে, দেশ থেকে দেশান্তরে, কাল থেকে কালান্তরে ... সেই পথযাত্রার আনন্দতিলক কি পড়বে এসে এই কপালে, পরিব্রজনপ্রিয় পা দু'টি যে পথের ডাকে খুশী হয়ে ওঠে?

"এই পথ যদি না শেষ হয়..."

Thursday, October 24, 2013

অশূন্য অমৃত

টুকরো টুকরো দ্বীপেরা ছড়িয়ে আছে। অসেতুসম্ভব সব দ্বীপেরা। মাঝে বয়ে গেছে বিচ্ছেদের আর বিষাদের নোনাপানি। অবিশ্বাস আর বেদনার নীল সমুদ্র। একদিন এইরকমই এক দ্বীপে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। মাঝে মাঝে গতজন্মস্মৃতির মতন মনে পড়ে বহুদিন আগে আমরা একটা মহাদেশে থাকতাম।

দিনগুলো কেমন ছিলো তখন? সোনালী, রূপালী, মেঘলা, রোদ্দুরে ঝলসানো, শুভ্র মেঘের ওড়না ওড়া সোনারঙের দিন--সবই ছিলো। নানারকম সব দিন। টুংটাং রুনরুন ঝমঝম করে তাদের নিজস্ব বাজনা বাজিয়ে চলে গেছে সেইসব দিনেরা। নিজের নিজের রঙে রাঙিয়ে দিয়ে গেছে স্মৃতিবেদনার অশূন্য অমৃতপাত্র।

তখন আমরা একটা মহাদেশে থাকতাম, ভাগ করে নিতাম সুখদুঃখের খুদকুঁড়ো। তখন আমরা একে অন্যের কথা মন দিয়ে শুনতাম, বুঝতাম ও। একইসঙ্গে বেরোতাম জল আনতে, ফল পাড়তে, মাটি চষতে। আমাদের আয়না ছিলো না, একে অন্যের চোখের আয়নায় নিজেদের দেখে নিতাম। কখনও বা স্বচ্ছ জলে নিজেদের মুখ দেখতাম বনফুলের মালা চূড়ায় পরে। তখন সবকিছু এত ঘোলা হয়ে যায় নি। তখন বাতাস অনেক নির্মল ছিলো, তখন জল অনেক জীবনময়ী ছিলো। তখন সব অন্নই পরমান্ন ছিলো।

দিনেরা চলে গেছে তাদের নিজের নিয়মে। গেছে কিন্তু সব এত ভেঙে দিয়ে গেল কেন? এত ভেঙে দিতেই কি চেয়েছিলো তারা? জগতের নিয়মই কী এই? মহাদেশ ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে যাবে টুকরো টুকরো দ্বীপ হয়ে? আর সেতু ও থাকবে না দ্বীপ থেকে দ্বীপে যাবার ? তবে প্লেট টেকটনিকের পন্ডিতেরা যে ভিন্ন কথা বলে? তারা যে বলে সব মিলেমিশে আবার এক হবে? সে কবে? কত কল্পকল্পান্ত পরে? কত অতল অন্ধকার পার হয়ে?

আমার অসেতু দ্বীপে বেলা পড়ে আসে, সূর্য নামে পাটে। সন্ধ্যার কমলা মেঘেরা রঙ হারাতে থাকে আস্তে আস্তে। শীতশিহরিত শীর্ণ নদীটি পার হয়ে ফিরে যাই আগুন-ওম্‌ ভরা গুহায়, ঘুমের মধ্যে সমর্পণ করি নিজেকে। স্বপ্নে ফিরে আসে পুরানো সব কথারা আবার। অবচেতনের জল সরিয়ে সরিয়ে ভেসে ওঠা মাছেরা-শত শত রুই, কাতলা, হাঙর, কুমীর, ডলফিন, তিমি, সিন্ধুঘোটকেরা।

বেশীদিন আগের কথা ও তো না! এরই মধ্যে গতজন্মস্মৃতির মতন সুদূর হয়ে গেলো সব? এত দ্রুত বিশ্বাস ভেঙে যায়? যেতে পারে? এত দ্রুত বন্ধুদের মুখ মুখোশের মতন খসে পড়ে? বেরিয়ে আসে আদিম হিংস্র জোটবদ্ধ আক্রমণকারীদের মুখ? ন্যায়-নীতি সব জলাঞ্জলি যায় এত সহজে? দলছুটকে সবাই মিলে পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে হত্যা করে দলবদ্ধেরা? একজনও থাকে না সেই যূথচ্যুতের পাশে দাঁড়াবার মতন? তার ন্যায্য কথা সব চাপা পড়ে যায় সম্মিলিত জান্তব চিৎকারে?

তবু নাকি বিশ্বাস হারাতে নেই, তবু নাকি আশা রাখতে হয়। সুপ্রাচীন পিতামহ মনে করিয়ে দিয়েছিলেন খুব কঠিন সময়ে। বারে বারে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। আমি তাই ঝড়ের রাতে কালির মতন কালো অন্ধকারে ছোটো ডিঙাখানি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম সব ছেড়ে, নইলে হয়তো বিশ্বাসটুকুও বাঁচাতে পারতাম না। ঝড়ের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে ক্লান্ত ডিঙাখান আমায় এখানে এনে আছড়ে ফেলেছিলো। পরদিন চেতনা ফিরে পেয়ে দেখেছিলাম পুবে ফরসা হয়ে আসছে, ছোট্টো দ্বীপে ভোর হচ্ছে।

তারপরে কেটে গেলো কতকাল,সে যে কতকাল! ভাঙা ডিঙা মেরামত করে এদিক ওদিক ভেসে ভেসে বেড়াই, টুকরো টুকরো দ্বীপগুলোর পাশ দিয়ে ভেসে যাই। আশায় থাকি হয়তো দেখবো কোনো "সবুজ ঘাসের দেশ" কোনো "দারুচিনি দ্বীপের ভিতর।" হয়তো দেখবো কোনো শান্ত বিশ্বাসের আদিগন্ত ভূমি, সোনার ফসল দুলছে যেখানে। বনফুলের মালা চূড়ায় পরে মেলায় যাচ্ছে তারা সবাই মিলে, বন্ধু বলে হাত বাড়াতে দ্বিধা নেই যাদের। আমার আশার তরী নিয়ে ঘুরে বেড়াই ঘাটে আঘাটায়, কিজানি কোথায় আছে সেই সাধের ভূমি!

মাঝে মাঝে কোথা থেকে জানি ভেসে আসে অদ্ভুত সুন্দর এক সুর, সে সুরে অসীম করুণা, বোধাতীত গরিমা। বুঝি বা নক্ষত্রের অক্ষরে তার স্বরলিপি লেখা! আমার ক্লান্ত আশা শক্তি ফিরে পায় সেই সুরে। সারাদিন ঘুরে ফিরে এসে যখন বসি তারাফোটা আকাশের নিচে, তখন কোনো অলীক নীলপাখির মতন কানে কানে কে বলে যায়, "আছে, আছে, আছে।"

আশার ডানায় ভর করে পাড়ি দিয়ে চলি অসেতুসম্ভব সময়ের সমুদ্র। আলোকের দূত বলে," পার আছে, পার আছে।" আমি পরম বিশ্বাসে তার হাতে হাত রেখে বলি, "জানি।"

*****

ইচ্ছে-বাতাস

কারা যেন কানের কাছে ফিসফিস করে ওঠে, শুনতে পাই অনেক গলার স্বর-- কোনোটা হাল্কা কচি স্বর, কোনোটা গম্ভীর জোরালো, কোনোটা মেয়েলী কোমল স্বর-প্রায় গানের মতন সুরেলা, কোনোটা দানা-দানা পুরুষালী স্বর, কোনোটা তীক্ষ্ণ চড়া স্বর, কোনোটা তরুপত্রে বাতাসের মর্মরের মতন নরম স্বর। ওরা বলে, "বলবে না আমাদের কথা?"

কাগজের উপরে কলম সরে সরে যেতে থাকে, অক্ষরের পর অক্ষর, শব্দের পর শব্দেরা উঠে আসতে থাকে, সেসব ঐ স্বরগুলোর গল্প। একসময় দেখি তাদের গল্পের একেকটা অংশ কখন পুরো বা অর্ধেক ফুটে উঠেছে কাগজের উপরে। তখন ঐ কুঁড়ির মতন ক্ষুদে ক্ষুদে শব্দগুলো কথা বলতে থাকে, অন্ধকার থেকে আলোর ফুলের মতন ফুটে উঠতে চায় তারা, তাই...

ইচ্ছে-বাতাস উড়ছে আমার বেভুল বাগান পথের বাঁকে

জাঁকজমকের উড়নতুবড়ি জ্বলতে জ্বলতে পুড়তে থাকে।

এই দ্যাখো এই তুলির টানে লেবুরঙের সকাল আঁকি-

এই দ্যাখো এই শিশির ফোঁটায় রাত্রিবিষাদ লুকিয়ে রাখি।

এই দ্যাখো সব মুছে দিলাম ঝড়বিকালের এক ঝাপটে

ঐ দ্যাখো সেই কাচপোকা টিপ বন্ধ ঘরের ঐ কপাটে।

কথার শেষে চুপকথামন একলা হয়ে উদাসচোখে

সাঁঝদিঘিটির আয়্নাজলে মুখ দেখতে অবাক ঝোঁকে।

আলতো হাতে দরজা ঠেলি সেই আমাদের সবুজ বাড়ি

মধ্যরাতের মেলগাড়িতে তারায় তারায় অবাক পাড়ি।

*******

সেইসব বসন্তদিন

সে অনেকদিন আগের কথা। দূর দক্ষিণের এক ছোট্টো সবুজ শহরে তখন থাকতাম। আপনদেশের মাঠের থেকে শিকড়সমেত উপড়ে নেওয়া একলা একটা গাছের মতন গিয়ে সেখানে যখন প্রথম নামলাম, তখন ঘোর শীত। গাছপালা বেশীরভাগই পাতাহীন বিবর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু চিরসবুজ পাইনেরা সবুজ করে রেখেছে শহরের আকাশরেখা। তারপরে প্রকৃতির অনিবার্য নিয়মে সূর্য সরে গেল উত্তরে, হয়তো কোনো দূর কাননের কুন্দকলি করুণ চোখে শেষ চাওয়া চেয়ে নিয়ে ঝরে গেল ধূলায়। শীত বিদায় নিল পুরোপুরি। কিশলয়বর্ণ জয়পতাকায় দিকদিগন্ত আচ্ছন্ন করে এসে পড়লো ঋতুরাজ বসন্ত।

বসন্ত এসে গেল, কিন্তু আমাদের রুটিনবাঁধা কাজকর্ম-নেটওয়ার্ক-ডেডলাইন-দূরভাষ-বাড়ী-আপিস দিয়ে আঁট করে বাঁধা জীবনে কিন্তু বিশেষ পরিবর্তন হল না। হরেক রকম ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি আর কম্পুটারে ঠাসা সব ঘর। গভীর রাতে সব বড়ো বড়ো আলো যখন নিভে যায়, তখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সবুজ আলো জ্বলে নেভে জ্বলে নেভে জ্বলে নেভে। অন্ধকার ঘরে ভারী অদ্ভুত লাগে, আমার এক বন্ধু এদের ইলেকট্রনিক ফায়ারফ্লাই বলে। বৈদ্যুতিন জোনাকি। জ্বলে জ্বলে উঠে সবুজ আলো ছড়ায়।

চুপ করে শুয়ে থাকি রাত্রির ঘুমের জন্য, ঘুমের জলে ডুবে যাবার আগে বহুদূরে ফেলে আসা ঘরবাড়ী মাঠ বাগান ঝোপঝাড় সব মনে পড়ে, সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি জ্বলতো সন্ধ্যার পরের থেকে শুরু করে গভীর রাত্রি পর্যন্ত। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উড়ন্ত আলো। মনে হতো আহা ওরা কেন সবাই একরঙের আলো দেয়? কেন কেউ নীল আলো, কেউ সবুজ আলো, কেউ বেগুনী আলো, কেউ লাল আলো দেয় না? ঘরের ওই সবুজ আলো দেওয়া বৈদ্যুতিজোনাকিরা জ্বলতো নিভতো জ্বলতো নিভতো, আমায় ঘুম পাড়িয়ে দিতো।

মাঠবনবাগান তখন সবুজে সবুজ, ফুলে ফুলে ছয়লাপ চারিদিক। ঘাসফুলেদের বেগুনীহলদে পেরিয়ে গোলাপী আজেলিয়ার ঝাড়ের কাছে এসে লুটিয়ে পড়তো সোনালীরোদ। আজেলিয়ার ফুল গোলাপী, কমলা, লাল, সাদা-নানা রঙের হয়। আমার দোপাটির কথা মনে পড়তো, "তোমার নীলদোপাটি চোখ, তোমার শ্বেতদোপাটি হাসি..."। দক্ষিণের জোরালো হাওয়ায় আজেলিয়া ঝোপেরা এলোমেলো হয়ে হাসতো, ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে উড়তে থাকতো, রেণু ঝরতো পথের ধূলায়। পথের দু'পাশে ওক গাছেরা অজস্র নতুন সবুজ পাতায় ভরে গেছে তখন, শুধু তাই না, গাছ ভরে মঞ্জরী ধরেছে, রাস্তা ভরে গেছে সেই ঝরা মঞ্জরীতে।

স্প্রিং ব্রেকের ছুটি শুরু হলো তারপর, সপ্তাহখানেকের কিছু বেশী (আগের সপ্তাহের শনিরবি ধরে নিয়ে নয়দিন)। ব্রেকের আগের সেই শুক্রবারে যখন সব শুনশান হয়ে এলো, ধৈর্যশীল বাহনেরা যখন মালিকদের নিয়ে সব পাড়ি দিলো উত্তরে দক্ষিণে পুবে পশ্চিমে, খুব ইচ্ছে হলো বন্ধুকে নিয়ে হারিয়ে যাই নতুন বসন্তের সবুজ জঙ্গলে, তাঁবু খাটিয়ে রাত্রিযাপন করি, মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে উঠে বেরিয়ে আসি বনজ্যোৎস্নায়, দেখি কথা কয়ে ওঠে কিনা রহস্যময় বনস্থলীর কোনো আত্মা, যেমন কইতো বহু বহু বছর আগে, যখন এদেশে শ্বেতকায়রা প্রবেশ করেনি, গোটা ভূখন্ড ছিলো লালমানুষদের, যারা পৃথিবীকে তাদের মা বলে জানতো, তারা শুনতে পেতো পাতার কুঁড়ি খোলার শব্দ, তারা শুনতে পেতো জলের ঘূর্ণীর শব্দ, তারা দেখতে পেতো অনেক অনেক দূর, বৃষ্টির পরে কেমন পরিষ্কার হয়ে যায় আকাশবাতাস-অনুভব করতো তারা। আমি কতকাল পরে এসেছি এখানে, ওরা তো আর নেই এখানে, হয়তো আছে কোনো রিজার্ভে, হয়তো ভুলে গেছে সবকিছু।

লালমানুষদের এখন সবাই বলে" ইন্ডিয়ান", আমিও আরেক ইন্ডিয়ান, বহুদূরের ইন্ডিয়া বলে দেশটির মানুষ, আমাদের বলে এশিয়ান, নেটীভ আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের থেকে আলাদা করার জন্য। কী অদ্ভুত, না? কলম্বাসের ভুলই "সত্য" হয়ে গেলো, সে কিনা ভেবেছিলো ইউরোপের থেকে ক্রমাগত পশ্চিমের দিকে জাহাজ চালিয়ে এসে ইন্ডিয়াতে পৌঁছেছে, কারণ পৃথিবী যে গোলকাকার! তীরে নেমে সে অধিবাসীদের ইন্ডিয়ান বলে স্থির করলো। বোঝো কান্ড! পৃথিবী যে কত বড়ো গোলক, হয়তো ঠিকঠাক জানতো না ওরা, জানলে হয়তো টাকাকড়ি যোগাড় করে পাড়ি দিতে পারতো না। পশ্চিমের পথে পাড়ি দিয়ে ভারতে পৌঁছাতে ওদের আরো বহুদিন চলতে হতো, ততদিনে সব ফুরিয়ে যেতো, খাবারদাবার, জল, সব। ঝড়টড় হলে তো আরো সোনায় সোহাগা। মাঝে বিরাট ঐ মহাদেশ না থাকলে কী হতো কেজানে!

উনি তো ইতিহাসে ঢুকে গেলেন, কিন্তু ওঁর ভুলটিও ইতিহাসে ঢুকে গেলো, আদি-অধিবাসীরা হয়ে গেলো ইন্ডিয়ান। কী গেরো! দ্বীপগুলো হয়ে গেলো ইন্ডিজ, পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বলে কোনোভাবে একটা রফা করেছে, কিন্তু এই লালমানুষদের বেলায় তাও করেনি। "রেড ইন্ডিয়ান" কথাটা শুনলে এরা ভুরু কপালে তুলে তাকায়! আবার জিজ্ঞেস করে,"হোয়াই আর ইউ সেইং রেড?"

যাকগে, হচ্ছিলো সেই বসন্তের ছুটিতে বেড়ানোর প্ল্যানের কথা। আমরা প্ল্যান করতে থাকি ক্যাম্পিং এর, নানারকম প্রস্তাব উঠতে থাকে,পড়তে থাকে, কখনো একমত হয়ে জোরালো হয়, কখনো দ্বিমত হয়ে ভেঙে পড়ে। প্ল্যান করে ক্লান্ত তৃপ্ত মনে চলে যাই যে যার বাড়ী।

*******

"বিজন ঘরে, নিশীথ রাতে আসবে যদি

আমি তাইতে কি ভয় মানি?

জানি বন্ধু জানি---

তোমার আছে তো হাতখানি...."

এয়ারকন্ডিশনারের হাল্কা চাপা শব্দের গুম গুম শোঁ শোঁ, অসংখ্য সবুজ জ্বলানেভা আলোর মধ্যে অনুভব করি তাকে, যে ছিলো অনেক অনেক অনেক দিন আগে, যে আছে এখনো, যে থাকবে আরো অনেক অনেক দিন পরেও। সে জানে আমাদের লক্ষ লক্ষ বছরের অতীত, জানে আমাদের কৃপণ বর্তমান, প্রতি মুহূর্তে পালিয়ে যাওয়া ক্ষণগুলির জন্য আমাদের দুঃখ ও অশ্রুকণিকা, জানে আমাদের প্রসারিত অনন্তস্পর্শী ভবিষ্যৎ। সভ্যতার এই পরতের পর পরত খোলসগুলো আমাদের ঢেকে রেখেছে পোশাকের মতন, ঘরের মতন, যানবাহনের মতন, ডেডলাইনের মতন,আরো আরো অনেক ছোটো-বড়ো কনস্ট্রেইন্ট আমাদের চোখের সামনের জিনিস চোখের থেকে মুছে দিয়েছে। আমাদের ব্যথিত আত্মা যখন কেঁদে ওঠে সেইসব হারানো জিনিসগুলোর জন্য, হারানো সম্পর্কগুলোর জন্য, তখন কোনো আশ্চর্য কৌশলে সে ছুঁয়ে ফেলে আমাদের ভিতরমন, আমাদের আত্মা, এমন করে ছোঁয় যেন ছিলোই সে আমাদের একদম ভেতরে, কোনো খোলোস না পেরিয়েই কেমন করে যেন পৌঁছে গেছে সেখানে।ঐ সেই ফ্ল্যাটল্যান্ডের উপর দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে ত্রিমাত্রিক আপেল যেমন সোজাসুজি পৌঁছে গেছিলো বৃত্তের কেন্দ্রে, পরিধি না পার হয়েই! ঠিক তেমনি করে।

নানা কারণে ক্যাম্পিং হলো না, এমনিই আমরা ঘুরতে গেলাম বাইসিক্ল ট্রেইল ধরে, বসন্তের সবুজ গাছগাছালি, সুরমুখর পাখপাখালি আমাদের অভ্যর্থনা করলো নীরবে সরবে। হরবোলা পাখির ডাক শুনতে শুনতে আমার হারানো দুপুরগুলো মনে পড়ছিল, মনে পড়ছিল শালিক চড়ুই কাক কোকিল সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে আমার দেশেও, উষ্ণদিনের মোহন আলোর ঝর্ণাধারা যখন চরাচর ধুইয়ে দেয় তখন তা তো ওদের ভিতর বাহিরও ধুইয়ে দিয়েছে। আমরা মানুষেরাই শুধু এত এত জালের পর জালে আটকানো।

অর্ধেক দিন ধরে ঘুরে ঘুরে বেশ ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত হয়ে শেষে গড়িয়ে-যাওয়া দুপুরে আমরা বিশ্রাম নিতে আর আহার গ্রহণ করতে বসি স্টেট পার্কের কৃত্রিম সরোবরের ধারে, পল্লবিত ওয়াটার ওকের ছায়ায়। আকাশ সেদিন এক্কেবারে নীল, দূরে চিল পাক খায়, হ্রদের জলে সরু পাতলা মোটরচালিত নৌকায় লোকেরা জলবিহার করছে, নৌকার অতি দ্রুতগতি আর পাশ দিয়ে শাঁ শাঁ করে উল্টোমুখে বেরিয়ে যাওয়া হাওয়ার স্পর্শ নিশ্চয় ওদের খুব আনন্দ দিচ্ছে, ওরা চিৎকার করছে খুশীতে।

সকাল বেলাতেই দোকান থেকে খাবার দাবার কেনা হয়েছিলো, সেই সেদ্ধ টার্কীর ফালি আর চীজের ফালি মাঝখানে দেওয়া দুই স্লাইস পাউরুটিই অমৃত মনে হয়। ক্ষুধাই হলো সুধা, যদিও দেশের লুচি-আলুরদমের কথা মনে পড়ে যায়। সে যেন গতজন্মের স্বাদ, এত মধুর সেই স্মৃতি।

কচি সবুজ ঘাসের উপরে কাত শুয়ে পড়ি, ঘাসের সুড়সুড়ি লাগে কানে, বেশ লাগে।

"তোমার দেশ এত সুন্দর!" মুগ্ধ হয়ে বন্ধুকে বলি।

সে ব্যস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি বলে,"না না, এর চেয়ে অনেক অনেক সুন্দর জায়গা আছে, আছে রেড উডের বন, ওখানে পাঁচ হাজার বছরের পুরানো গাছ আছে, গত গ্রীষ্মে গেছিলাম, সে এক অদ্ভুত জিনিস। তুমি ঐ গাছ ছুঁলে মনে হবে টাইম মেশিনে চড়ে চলে গেছো সেই তত হাজার বছর আগে...মিশরে তখন পিরামিডগুলো তৈরী হচ্ছে।"

আমি হেসে ফেলি, পাছে এই দুটো গাছপালা ঘাসফুল পাখপাখালি দেখে একেই দেশের সেরা সৌন্দর্য ভেবে বসি, এই ভয়ে কেমন ব্যস্ত হয়ে আশ্চর্য সুন্দর জায়গার কথা বলছে! আরে, বিখ্যাত জায়গা তো আছেই, আশ্চর্য সব জিনিস তো আছেই পৃথিবীতে, কিন্তু তার জন্য এই হাতের ছোঁয়ার মধ্যের, এই বুকের কাছের, এই চোখের সম্মুখের অপরূপ আশ্চর্য সৌন্দর্য কি বৃথা হয়ে গেলো? অপরূপ এই জগৎ, জগতের প্রতিটি কোণাতেই অফুরন্ত আনন্দের উৎস লুকিয়ে আছে। নিজেদের বাঁধা জালগুলো ছিন্ন করতে পারলেই রূপকথার সোনার পালক আপনিই উড়ে এসে পড়ে হাতে, মাথায়, চোখেমুখে।

আমরা গল্প করতে থাকি, কোথা থেকে কোথায় চলে যায় গল্পের বিষয়বস্তু, ছোটোবেলার কথা, সেকেন্ডারি ইস্কুলের কথা, নানাসময়ের বেড়ানোর গল্প, এখনকার কাজের কথা ---সব মিলেমিশে জগাখিচুড়ী হয়ে যায় গল্পের মধ্যে।

বেলা পড়ে আসে, ঢলে পড়া সূর্যের কিরণে কোমলতা, পশ্চিমের মেঘগুলি আরেকটু পরেই অরুণরঙে রাঙা হয়ে সন্ধ্যাকে মায়াবতী করে তুলবে। আমরা ঘরে ফিরতে থাকি, ক্লান্ত দেহে, তৃপ্ত হৃদয়ে। একটি মুক্তির দিনের স্মৃতি অবিনশ্বর হয়ে থাকে মনের মণিকোঠায়।