Wednesday, December 11, 2013

দেশবিদেশের উপকথা-চন্দ্রকুমারী (জাপান)

জাপানের এই উপকথাটা খুব আশ্চর্যরকমের সুন্দর। অনেকে বলে থাকেন আধুনিক কল্পবিজ্ঞানের গল্পের আদিরূপ এই উপকথাতেই প্রথম পাওয়া যায়। অনেকে আরো বলেন, উপন্যাস ইত্যাদির বীজও লুকানো ছিলো এই উপকথায়। এই উপকথাটির জন্য এক বন্ধুর কাছে ঋণী এই পুনর্কথক, উনিই মূল আখ্যানভাগের সন্ধান দিয়েছিলেন।

এক দেশে এক গরীব কাঠুরিয়া থাকতো। গ্রামপ্রান্তের ছোটো এক কুটিরে কাঠুরিয়া আর তার স্ত্রী বাস করতো। সকালবেলা দুটি খেয়ে নিয়ে কাঠুরিয়া নিজের কুড়ুলটি আর ঝোলাটি নিয়ে বেরিয়ে যেতো, সারাদিন বনে বনে কাঠ, বাঁশ কাটতো, দিন ফুরালে সব বোঝা বেঁধে পিঠে নিয়ে ঘরে ফিরতো। ঘরে তখন তার বৌ গরম খাবার বানিয়ে অপেক্ষা করতো, সে ফিরলে হাতমুখ ধোয়ার জল দিতো, গামছা এগিয়ে দিতো, তারপরে তারা দুইজনে খেতে বসতো। হাটের দিনে কাঠুরিয়া ঐসব সংগ্রহ করা কাঠ বাঁশ সব নিয়ে হাটে বিক্রি করে যা টাকা পেতো তাই দিয়ে খাদ্য বস্ত্র ইত্যাদি আবশ্যকীয় জিনিস কিনে আনতো।

এইভাবে তাদের দিন কাটছিলো, গরীব হলেও সেই নিয়ে তাদের তেমন দুঃখ ছিলো না, মোটা ভাত মোটা কাপড়েই তারা সন্তুষ্ট ছিলো। কেবল একটিমাত্র দুঃখ তাদের, বহু বছর তাদের বিবাহ হয়েছে, একত্রে সংসার করছে তারা বহু বছর, কিন্তু আজো সন্তানের মুখ দেখতে পেলো না। মাঝে মাঝে কাঠুরিয়ার বৌ স্বামীকে বলতো, "সারাটা দিন তুমি বাইরে থাকো কাজে, আমি টুক টুক করে এটা করি সেটা করি, রান্না করি, সেলাই করি, পাখা বানাই--কিন্তু মাঝে মাঝে দিন যেন আর কাটতে চায় না। একটা সন্তান থাকলে তাকে নিয়ে দিন আমার কেটে যেতো, কত যত্ন করে বড় করতাম তাকে।" বলতে বলতে সে কেঁদে ফেলতো আর কাঠুরে বলতো, "কেঁদো না বৌ, আমাদের ভাগ্যে থাকলে হবে, না হলে নাই। ঈশ্বর দয়া করলে হবে। এ তো জোর করে লাভ নেই, কপালের উপরে তো আমাদের হাত নাই।"

এমনি করে দিনের পর দিন যায়। একদিন কাঠুরিয়া সারাদিন বনে কাঠ কেটেছে, কাজ করতে করতে কখন যে সূর্য ডুবে সন্ধ্যে হয়ে গেছে, তার খেয়াল নেই। চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে, আকাশে তারা ফুটতে শুরু করেছে দেখে সে তাড়াতাড়ি কাঠ বাঁশ বোঝা বেঁধে বাড়ির দিকে চললো। চলতে চলতে বনের প্রায় প্রান্তে এসে গেছে সে, সামনে একটা খোলা মাঠ মাত্র, সেটুকু পেরোলেই তার গ্রাম। বনের মধ্যে হঠাৎ সে দেখলো ঝোপের আড়াল থেকে জ্যোৎস্নার মতন আলো বেরিয়ে আসছে। এখানে আলো? কেমন করে এলো? কৌতূহলী হয়ে কাঠুরিয়া এগিয়ে গেল।

গিয়ে দ্যাখে, একটা মস্ত মোটা বাঁশের মতন কী একটা জিনিস, কিন্তু চকচকে সেটা, যেন বা ধাতুর তৈরী। সেটার থেকে জ্যোৎস্নার মতন আলো আসছে, যেন চাঁদ নেমে পড়ছে বনে। মন্ত্রমুগ্ধের মতন আরো এগিয়ে গেলো কাঠুরিয়া, কাছে গিয়ে শোনে ভিতর থেকে ওয়াঁ ওয়াঁ শব্দ আসছে, যেন বা সদ্যোজাত শিশুর কান্না। এর ভিতরে মানুষ আছে নাকি?

বোঝা নামিয়ে রেখে নিজের কুঠারটি দিয়ে সে আঘাত করে সেই অদ্ভুত আলোময় বাঁশের গায়ে, অমনি একটা টুকরো ভেঙে যায়, সেই গর্ত দিয়ে উঁকি দিয়ে কাঠুরিয়া দ্যাখে ভিতরে বিস্ময়কর কান্ড! ভিতরে একটা নরম তুলো-তুলো বিছানা, সেই বিছানায় শুয়ে আছে একটা খুব ছোট্টো মেয়ে, এত ছোটো যে কাঠুরিয়ার হাতের তালুতে এঁটে যাবে, সেই মেয়েই ওয়াঁ ওয়াঁ করে কাঁদছে। বাচ্চাটির শিয়রের কাছে কতকগুলো সোনার মোহর।

কাঠুরিয়া খুব সাবধানে বাচ্চা মেয়েটিকে বার করে আনে, তারপরে তুলো তুলো বিছানাটাও। সোনার মোহরগুলোও। তুলো-তুলো বিছানা দিয়ে বাচ্চাটিকে সাবধানে জড়িয়ে বুকের মধ্যে নিয়ে কাঠুরিয়া দ্রুত নিজের বাড়ীতে ফিরে আসে। বাড়ীতে এসে নিজের বৌকে সব ঘটনা বুঝিয়ে বলে সে। বৌ তো মেয়েটিকে পেয়ে খুব খুশি, এতদিনে সে তার মনের সাধ পুরিয়ে এই বাচ্চাকে মানুষ করতে পারবে।

তারপরে দিন যায়, দিনে দিনে চন্দ্রকলার মতন বাড়তে থাকে তাদের কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে। কাঠুরিয়া আর তার বৌ মেয়ের নাম রাখে চন্দ্রকুমারী। কাঠুরিয়াদের আর দুঃখ নেই, দারিদ্রও নেই। সেই যে সোনার মোহরগুলো পেয়েছিলো, সেগুলো ভাঙিয়েই তাদের দারিদ্র ঘুচে গেছে।

দিন যায়, মাস যায়, বছর কাটে। চন্দ্রকুমারী এখন কিশোরী হয়ে উঠেছে। সে এত সুন্দরী হয়েছে যে তার দিকে চাইলে মানুষ চোখের পলক ফেলতে ভুলে যায়। উত্তরে দক্ষিণে পুবে পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে চন্দ্রকুমারীর কথা। কিন্তু চন্দ্রকুমারী কেমন যেন আত্মমগ্ন, সে নিজের মনে নিজের লেখাপড়া আর শিল্পকর্ম নিয়ে থাকে। গ্রামে তার কত বন্ধু বন্ধুনী, তাদের সঙ্গে ছোটো থেকে খেলধূলা করে সে বড় হয়েছে, কিন্তু তাও কেন জানি সকলের থেকে সে আলাদা। তার মনের নাগাল কেউ পায় না, বন্ধুরা না, বাবা না মা না। তার বাবা-মা মাঝে মাঝেই অবাক হয়ে তাকে তারাভরা রাতের আকাশের নিচে ঘুরে ঘুরে গান গাইতে দ্যাখে আর কেমন একটা আনন্দবিষাদ তাদের ঘিরে ধরে, ও যে পৃথিবীর মেয়ে নয়, কোথা থেকে একদিন এসেছিলো তাদের ঘরে, আবার বুঝি কবে চলে যাবে!

তারপরে চন্দ্রকুমারীর যখন বিবাহের বয়স হলো তখন চার দিক থেকে চার রাজপুত্র এসে তার পাণিপ্রার্থী হলো। কিন্তু চন্দ্রকুমারীর মন পৃথিবীর মানুষকে বিবাহ করতে সায় দেয় না। এদিকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেও এই রাজকুমারেরা হয়তো ক্ষুব্ধ হবে, তাহলে উপায়? বুদ্ধিমতী মেয়ে সে, একটা খুব চমৎকার উপায় সে ঠিক করলো।

প্রথম রাজপুত্রকে সে বললো, "রাজপুত্র, আমি তোমাকে বিবাহ করতে পারি এক শর্তে।"

রাজপুত্র সাগ্রহে জানতে চায়, "কী শর্ত?"

চন্দ্রকুমারী বলে, " জম্বুদ্বীপে আছে মহাভিক্ষু দশবলের পবিত্র ভিক্ষাপাত্র। সেই ভিক্ষাপাত্র খুব পবিত্র, সর্বদা তা থেকে দিব্যজ্যোতি স্ফুরিত হয়। যদি ঐ ভিক্ষাপাত্র এনে দিতে পারো আমায়, তবেই তোমাকে আমি বিবাহ করবো।"

এই শুনে রাজপুত্র জম্বুদ্বীপের দিকে রওনা দেয়।

দ্বিতীয় রাজপুত্রকে সে বললো, "রাজপুত্র, আমি তোমাকে বিবাহ করতে পারি এক শর্তে।"

রাজপুত্র সাগ্রহে জানতে চায়, "কী শর্ত?"

চন্দ্রকুমারী বলে, " প্লক্ষদ্বীপে আছে এক আগুনমুখো ড্রাগন, সেই ড্রাগনের গলায় আছে এক রত্নহার, সেই রত্নহারের কেন্দ্রমণিটি, তার জোড়া নেই ভুবনে। যদি সেই মণিটি আমাকে এনে দিতে পারো, তবেই তোমায় আমি বিবাহ করবো।"

এই শুনে রাজপুত্র প্লক্ষদ্বীপের দিকে রওনা দিলো।

তৃতীয় রাজপুত্রকে সে বললো, "রাজপুত্র, আমি তোমাকে বিবাহ করতে পারি এক শর্তে।"

রাজপুত্র সাগ্রহে জানতে চায়, "কী শর্ত?"

চন্দ্রকুমারী বলে, " শাল্মলীদ্বীপে আছে এক আশ্চর্য বৃক্ষ, যার প্রতিটি শাখা রত্নময়। যদি সেই গাছের একটি শাখা আমায় এনে দিতে পারো, তবেই তোমায় আমি বিবাহ করবো।"

এই শুনে রাজপুত্র শাল্মলীদ্বীপের দিকে রওনা দিলো।

চতুর্থে রাজপুত্রকে সে বললো, "রাজপুত্র, আমি তোমাকে বিবাহ করতে পারি এক শর্তে।"

রাজপুত্র সাগ্রহে জানতে চায়, "কী শর্ত?"

চন্দ্রকুমারী বলে, " ভদ্রাশ্ববর্ষে আছে এক অদ্ভুত অগ্নি-মুষিক। সেই অগ্নিমূষিকের আছে এক আলো-ঝলমল দিব্যবস্ত্র। সেটা আমায় এনে দিতে পারলে তবেই আমি তোমায় বিবাহ করবো।"

এই শুনে রাজপুত্র ভদ্রাশ্ববর্ষের দিকে রওনা দিলো।

প্রথম রাজপুত্র জম্বুদ্বীপের দিকে রওনা দিয়েছিলো বটে কিন্তু যেতে যেতে মনে করলো মহাভিক্ষু দশবলের ভিক্ষাপাত্র পাওয়া কি সোজা কথা? তারচেয়ে এখানকার কোনো ভিক্ষু উপাশ্রয় থেকে দামী একটা ভিক্ষাপাত্র কিনে নিয়ে যাই। তো সে তাই করলো, একটি দামী ভিক্ষাপাত্র এনে চন্দ্রকুমারীকে দিল। কিন্তু সেটা যে জাল, তা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় নি চন্দ্রকুমারীর, ভিক্ষাপাত্র থেকে কোনো দিব্যজ্যোতি বেরোচ্ছিলো না।

দ্বিতীয় রাজপুত্র রওনা হয়েছিলো প্লক্ষদ্বীপের দিকে কিন্তু যেতে যেতে মনে করলো ওরে বাবা, ড্রাগনের গলার হারের মণি, সে কি সোজা কথা? আর প্লক্ষদ্বীপ এমনিতেও অনেক দূরে, সাগর পাড়ি দিয়ে যেতে হয়। সে এক নাবিককে অনেক টাকা দিয়ে প্লক্ষদ্বীপে যেতে রাজী করলো, কথা হলো সেখান থেকে নাবিক তাকে ড্রাগনের গলার হারের কেন্দ্রমণিটা এনে দেবে।

নাবিক টাকাকড়ি সব নিয়ে নিজের লোকজন নিয়ে সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়ে পড়লো প্লক্ষদ্বীপের দিকে। তারা তো আর আসে না আর আসে না, ঝড়ে পড়ে ডুবে গেলো নাকি? কিংবা ড্রাগন ওদের সবাইকে খেয়ে ফেললো?

এইসব ভেবে দ্বিতীয় রাজপুত্র তাদের আশা ছেড়ে দিয়ে নিজের রত্মভান্ডার থেকে খুব দামী একটা মণি নিয়ে রওন হলো চন্দ্রকুমারীর কাছে। সেটা যে জাল, তা ধরে ফেলতে চন্দ্রকুমারীর সামান্য সময় লাগলো। ধরা পড়ে মুখ চুন করে ফিরে গেলো রাজপুত্র।

তৃতীয়জনও জাল জিনিস এনে দেখিয়েছিলো ও ধরা পড়ে গেছিলো। চতুর্থজন ফিরে আসে নি আর, হয়তো বা কাজটি না করতে পারার লজ্জায়।

এর কিছুকাল পরে দেশের মহারাজ স্বয়ং মৃগয়ায় এলেন চন্দ্রকুমারীদের গ্রামের কাছে। সেই সময়ে মহারাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো এই বিশ্ববিমোহিনী সুন্দরী চন্দ্রকুমারীর। মহারাজ তো তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বন্ধুত্ব করলেন। তারপরে যখন তাদের বন্ধুত্ব খুবই দৃঢ় হয়েছে, তখন মহারাজ চন্দ্রকুমারীকে বিবাহ করতে চাইলেন।

তখন ছিলো সন্ধ্যেবেলা। মহারাজ আর চন্দ্রকুমারী প্রান্তরে বেড়াচ্ছিলো পঞ্চমীর চাঁদের আলোয়। নানা কথা বলছিলো, হাসছিলো তারা দুইজনে। যেন তারা একজন দেশের মহারাজ আর একজন গ্রামের এক সামান্য মেয়ে নয়, যেন তারা দুই সমপর্যায়ের বন্ধু। তারপরেই একসময় এলো মহারাজের বিবাহপ্রস্তাব।

শুনে চন্দ্রকুমারী হঠাৎ বিষন্ন হয়ে গেল, বললো, " মহারাজ, পৃথিবীর কোনো মানুষকেই যে বিবাহ করা আমার পক্ষে সম্ভব না! আমি পৃথিবীর কেউ নই। ঐ যে চাঁদ, ঐখানে আমার আসল ঘর। শীঘ্রই আমার নিজের লোকেরা আমাকে ফিরিয়ে নিতে আসবে। সব ছেড়ে আমার চলে যেতে হবে, হয়তো আর কোনোদিন এখানের কারুর সঙ্গে দেখা হবে না। " জ্যোৎস্নায় মহারাজ দেখলেন চন্দ্রকুমারীর দুই চোখে টলটল করছে অশ্রু।

রাজা দুই হাত দিয়ে চন্দ্রকুমারীর দুইহাত জড়িয়ে ধরে বললেন, "কে তোমাকে নিয়ে যাবে? কেউ নিতে পারবে না। আমি আমার সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করবো তোমাদের বাড়ির চারপাশে। দেখি কে তোমাকে কীভাবে নিয়ে যায়।" শুনে চন্দ্রকুমারী কেবল ম্লান হাসলো।

মহারাজ সত্যিই বিরাট সেনাবাহিনী এনে মোতায়েন করলেন কাঠুরিয়ার বাড়ির চারপাশে। আর ভয় নেই, কেউ চন্দ্রকুমারীকে কেড়ে নিতে পারবে না।

পূর্ণিমার রাতে আশ্চর্য দিব্যবিমানে চড়ে চন্দ্রকুমারীর দেশের লোকেরা এসে নামলো কাঠুরিয়ার বাড়ির সামনে। পাহারাদার সৈন্যরা সকলে আলোর ঝলকানিতে সাময়িকভাবে অন্ধ হয়ে গেল, অবশ হয়ে গেল। কোনোরকম লড়াই তো দূরের কথা, কোনো বাধা দেবারও সামর্থ্য তাদের রইলো না, তাদের নড়াচড়ার ক্ষমতাই সাময়িকভাবে হরণ করে নেওয়া হয়েছিলো।

চন্দ্রকুমারীর আপন লোকেরা তার ঘরে গেলো, সেখানে তাদের অপেক্ষাতেই ছিলো তাদের মেয়ে। কিন্তু মেয়ের চোখে তখন অশ্রু, পৃথিবীর এই মানুষগুলো তার বড় আপন, তার এই পালক পিতামাতা যারা নিজের সন্তানের মতন তাকে পালন করে শৈশব থেকে এত বড়টি করেছেন, এই গ্রামভর্তি তার বন্ধুরা যাদের সাথে খেলেধূলে সে বড় হয়েছে, এই মহারাজ যিনি তাকে অকপট বন্ধুত্ব দিয়েছেন---এই সবাইকে ছেড়ে যেতে তার মন চায় না, তার বুকের মধ্যে অশ্রুসমুদ্র উথলে ওঠে। কিন্তু যেতে তো হবেই, উপায় তো নেই।

চন্দ্রকুমারী চিঠি লিখে সব জানিয়ে মহারাজের জন্য রাখে সেই চিঠি। চিঠির সাথে রাখে একটি উপহার। তারপরে সে তার বাবামায়ের কাছে বিদায় নিতে যায়। কাঁদতে কাঁদতে সে জানায় আজ সে চলে যাচ্ছে বটে, কিন্তু একদিন সে আবার ফিরে আসবে।

এদিকে সময় গড়িয়ে চলেছিলো, চাঁদের দেশের লোকেরা তাড়াতাড়ি এসে তাদের মেয়েকে একটি পালকের পোশাক পরিয়ে দিলো। যেই না সেটা পরানো অমনি চন্দ্রকুমারীর মন থেকে পার্থিব মায়া আর পিছুটান লুপ্ত হয়ে গেল। যারা তাকে নিতে এসেছিলো, তাদের সাথে চন্দ্রকুমারী গিয়ে দিব্যবিমানে চড়ে বসলো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দিব্যবিমান শূন্যে মিলিয়ে গেল।

কাঠুরিয়া আর তার স্ত্রী পালিতা কন্যার শোকে অভিভূত হয়ে পড়লো। সাঁঝের বেলা উঠান থেকে চাঁদের দিকে চেয়ে তারা কেবল চন্দ্রকুমারীর কথাই ভাবতো। বয়সও হয়েছিলো তাদের, একসময় তারা অসুখ হয়ে মারা গেল দুইজনেই।

প্রতি রাতে মহারাজ চন্দ্রকুমারীর চিঠিটি আর উপহারটি হাতে নিয়ে আকাশভরা তারার নিচে ঘুরে ঘুরে ভাবতেন সে কি আবার আসবে, কখনো আসবে? নাকি "এ পৃথিবী একবারই পায় তারে, পায় নাকো আর !"

(সমাপ্ত)

অপরাজিতা

আমার সঙ্গে যদিও বহুকাল অনীশের দেখা নেই,তবু বসে বসে খাতায় লেখালিখি মকশো করে যাই। অনীশ শুনেছি বেড়াতে গিয়েছেন পাহাড়ে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন তিন ভাগ্নেভাগ্নী গ্যাঞ্জামা, নিশঙ্কা আর ঝঞ্ঝাকে। যাবার আগে আমায় কিছু ডেডলাইন দিয়ে গিয়েছেন , যাতে এসেই পাকড়াও করতে পারেন। অনীশ হলেন পাক্ষিক সাহিত্যপত্রিকা "আনন্দঝর্ণা"র সম্পাদক।

আমি জানালার ধারে বসে কবিতা লেখার চেষ্টা চালাই,"আকাশে চিল,বেঁফাসে নীল,বাতাসে ঢিল,বাড়ীতে খিল।"এই ধরনের ছোটো ছোটো ছন্দে প্রথমে হাত পাকাচ্ছি। ওদিকে আপনমনে জগাদা গান গাইতে গাইতে পথ দিয়ে চলে চলে গেলো,"সীমের মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর",ওর নজর ছিলো পাশের দত্তদের সব্জিবাগানের দিকে।নধর নধর সীম ফলে আছে মাচায়।

আমি উদাস হয়ে গেলাম, দুত্তোর বলে থলে হাতে বাজার করতে বেরিয়ে পড়লাম। উরেব্বাবা,সে কি গরম বাজারে! সব্জিওয়ালা, মাছওয়ালা, ফলওয়ালা তারস্বরে সেই গরমের মধ্যে চেঁচাচ্ছে,"তিরিশ তিরিশ তিরিশ, চল্লিশ চল্লিশ চল্লিশ।" ই কী রে বাবা?

বেগুনওয়ালার কাছে এসে কোনোমতে মিনমিন করে কইলাম,"এই বেগুন কত করে?" সে বীরবিক্রমে চিৎকার করে বললে,"এ চল্লিশ টাকা কিলো।"

চল্লিশ টাকা? বলে কী রে ব্যাটা? প্রায় ভির্মি খেয়ে যাচ্ছিলাম।

কোনোমতে সামলে বললাম,"এত দাম? এই তো গত হপ্তায় ছিলো পনেরো টাকা কিলো?"

একটুও না ঘাবড়ে সে বললে,"গত হপ্তায় আর এ হপ্তায়? কিসের সঙ্গে কিসে,চাঁদের সঙ্গে ইসে!এখন লগনসার বাজার। দাম কি আগের মতন থাকবে?"

এ তো ব্যাপার গুরুচরণ! বাজারেও কবিতা? বেগুনওয়ালাও কবিতা বলে,তাও আবার অন্তমিল দিয়ে?

আমি কান্নিক খেয়ে বাঁদিক ঘেঁষে বেরিয়ে গেলাম। কিন্তু সামনে পুজো,অষ্টমীতে খিচুড়ী-লাবড়া না হলে তো ....এদিকে বেগুন ছাড়া লাবড়া তো মধু ছাড়া মৌচাকের মতন....

দুত্তোর,যতো ভাবি কবিতা নয় কবিতা নয়,ততই এসে যায় কবিতা? তারচেয়ে "শ্রী শ্রী চন্ডী" ভাবি,তাতে কিছু উপকার হতে পারে। ভাবতেই ভাবতেই মনে হলো এক চ্যাংড়া প্যারোডি করেছিলো মেধস মুনি আর রাজ্যভ্রষ্ট রাজা সুরথের কথোপকথন আধুনিক কালের পটভূমিতে কেমন দাঁড়াবে,"হে মহাভাগ বলো বলো,আমরা কেন এমন দুখী?/বাজারে দাম দেখি তবু মন সদা রয় বাজারমুখী!/এমন কেন হয় বুঝেও বুঝতে নারি মহামতি/চিত্তে কেন লোভ জেগে রয় বিগুণ বেগুনগণের প্রতি?" সত্যিই বেগুনেরা বড়োই বিগুন আজও আমার প্রতি। চল্লিশ টাকা কিলো হয়ে গেলো তেরাত্তির পেরুতে না পেরুতে? কলির চারপোয়া পুরে গেলো নাকিরে বাবা?

যাক,পাকড়াশীদের বাগান থেকে রাতে মেরে দোবো,এই ভেবে নিয়ে বাড়ীর পথে চললাম চাট্টি কাচকি মাছ আর দু'ছড়া কলা কিনে নিয়ে।

বাড়ীতে আসতেই পাশের থেকে রুপী এসে ঘাড়ে ঝাঁপ দিলো। উদ্দেশ্য কলা ক'টা হাতানো।

রুপী হলো ঘেন্টুমেসোর পোষা রুপী বাঁদর। কেল্টিমাসী,মানে ঘেন্টুমেসোর একমাত্র বৌ স্বর্গে যাবার পরে পরে ঘেন্টুমেসো কেমন যেন পাগলা পাগলাহয়ে গেছিলেন, দাঁড়িটাড়ি না কামিয়ে চুলটুল না সামলে হুতাশী হুতাশনের মতন ঘুরতেন। কী খেতেন কোথা ঘুমোতেন কোনো খেয়াল থাকতো না। অনেকে কইলো আলঝাইমার,অনেকে কইলো চিত্তভ্রংশ,কিন্তু কেউ কোনো সমাধান দিতে পারলো না। মেসো ঘুরে ঘুরে ছড়া বলেন,"কেল্টি মাসী পল্টী মাসী বুল্টী মাসী কইতো/তাদের দেশের চিনাং নদী দুকুল ছেপে বইতো।"বোঝো কান্ড!এর মধ্যে এত মাসী কোথা থেকে এলো আর চীনই বা কোত্থেকে উপস্থিত?আর বৌকে শেষে বোনপো-বোনঝিদের দেখাদেখি মাসী বলে ফেলা!কী ডেন্জারাস কেস রে বাবা!শেষে পাড়ার ষন্ডাগুন্ডা গুপীদা একদিন ওঁকে নিয়ে গেলো ঘুটঘুটানন্দজীর কাছে। তিনিই সব শুনে টুনে বিধান দিলেন রুপী পোষার।আর যায় কোথা? ম্যাজিকের মতন কাজ!ঘেন্টুমেসো ভালো হয়ে এখন ভালো কোম্পানিতে করে খাচ্ছেন,বর্তমান পোস্ট রাঁচী হাজারিবাগের মাঝামাঝি।

যাবার আগে আগে উনি রুপীকে ছেড়ে দিয়েছিলেন।ছাড়া পেয়ে রুপীর সে কি ফূর্তি!পাড়ার গাছে গাছে ফলপাকুড় খেয়ে বেড়াতো,বাজারেও ছিলো অবাধ গতি,পাড়ার ষাঁড়েদের সঙ্গেও দিব্যি ভাব হয়ে গেছিলো। একেবারে চলে যাবার আগে রুপীকে একবার দেখার জন্য ঘেন্টুমেসো ভারী কেঁদেছিলেন, কিন্তু তখন রুপী কোথা? বোসেদের কলাবাগানে খুঁজলে পাওয়া হয়তো যেতো,কিন্তু লোকের অত কি দায় পড়েছে গাল বাড়িয়ে চড় খাওয়ার?

যাইহোক ঘেন্টুমেসো চলে গেলেন কিন্তু রুপী রয়ে গেলো আর যথারীতি দৌরাত্ম করে বড়াতে লাগলো। কারুর কিচ্ছু করার নেই। ঘেন্টুমেসোকে নাহয় ঘুটঘুটানন্দজী দিয়ে সামলানো যায়,কিন্তু রুপীকে সামলাবে কে, কেমন করেই বা? পারলে একমাত্র গুপীদাই পারতো,কিন্তু সেও রণে ভঙ্গ দিয়ে চাকরি নিয়ে আবুধাবি চলে গেলো। এই তো অবস্থা! এইসব বীরের মুখের দিকেই নাকি আমরা চেয়ে ছিলাম?

দু'ছড়া কলা গেল! কোনোক্রমে কেচকী মাছকটা বাঁচিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লাম। যদিও বাঁদরে আমিষ খায় না,কিন্তু বিশ্বাস কী?

রান্নাঘরে যেতেই দেখি জানালা দিয়ে পাশের বাড়ীর মোটা হুলো বেড়ালটা পালাচ্ছে,যেতে যেতে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে বিশ্রী একটা হাসিও দিয়ে গেলো। কড়ায় দুধ ছিলো,তাহলে সেটাও এখন আর নেই ধরে নিতে পারি। হুলো কি আর ছেড়ে দিয়ে গেছে?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে থলে নামালুম,নাঃ,এইবারে হিমালয়ের দিকে যাওয়া ছাড়া তো আর উপায় দেখিনা। সম্পাদক চালাক মানুষ,তাই কাজ এগিয়ে রাখতে পাহাড়ে ঘুরতে গেছেন। আমারও শিগগীরই যেতে হবে,মানে সম্পাদক আসার খবর পেলেই। অবিশ্যি সেখানে আবার কি গেরো বেঁধে আছে তাই বা জানে কে?

শিকে থেকে ডুলা নামিয়ে দেখি পড়ে আছে ক'টা অনার্য ঝিঙা আর দু'খানা অনার্য চিচিঙা। মুহ্যমান মুখ করে সেই কুটতে বসলুম। তাহলে আজ কেচকী মাছের ঝিঙে চচ্চড়ি আর চিচিঙা ভাজাই হবেখন ভাতের সঙ্গে। তাতে আমার অবিশ্যি কোনো অসুবিধে নেই,কিন্তু পাকেচক্রে কোনো অতিথি এসে গেলেই চিত্তির। ভদ্দরলোকেদের কিকরে এই অনার্য খাবার খাওয়াবো?

যাইহোক রান্নাবান্না সেরে সবকিছু শিকেয় তুলে পাশের ঘরে গেলুম মকশো খাতায় গদ্য লেখা অভ্যেস শুরু করতে।

খানিকটা বেশ র লেখা লিখতে হবে,যাকে বলে বাস্তব। পান্তাভেজা বোষ্টুমগোছের লেখা চলবে না।বেশ ঝাঁঝ ঝাঁঝ ঝাল ঝাল চচ্চড়ির মতন লেখা চাই।তো গোটা দেড়েক পাতা এগিয়েছে,অমনি দরোজায় ঠকঠক।কোন দুশমন এলো রে বাবা এই ভরদুপুরে?

দরোজা খুলে তো আমি অবাক!পাকড়াশীদের ছেলে দুষ্মন্ত।এর সঙ্গে ছোটোবেলা বন্ধুত্ব ছিলো আমার,পরে বড়ো হয়ে এ তো চলে গেলো ব্যাঙ্গালোরে ইঞ্জিনিয়ারিঙ পড়তে,পরে সেখান থেকে চলে গেলো বিলেত। কবে ফিরলো রে বাবা?

"আসুন আসুন,কেমন আছেন?" বলে তো ঘরে আসতে বললাম।

সে একগাল হেসে কইলো,"আমাকে আবার আপনি আজ্ঞে কেন মিন্টি?আগে তো তুমি বলতে।"

আমার একটা মজার কথা মনে পড়লো, ওকে তুমি বলতাম আর ডাকতাম দুশমন।

কিন্তু এখন? তাড়াতাড়ি বললাম,"সে আগে। এখন আপনি কত বড়ো মানুষ,কত দেশবিদেশ ঘুরেছেন,কত জানকারি। আর কি তুমি বলতে পারি?"

"না না মিন্টি,তুমি বলো।আমি এই কদিনের জন্য দেশে ফিরেছি,দুহপ্তা পরে আবার বিলেত যাবো।তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলাম। কেমন আছো?"

"ভালো। দুপুরে এলেন,খেয়ে যান। দাঁড়ান আগে সরবৎ করে আনি।"

হাত ধরে আটকে বললো,"আবার আপনি? তাইলে কিন্তু খাবো না,এক্ষুণি চলে যাবো।"

তাইলে তো বাঁচি,নইলে ঐ ঝিঙা চিচিঙা কিকরে খাওয়াবো এই বড়োলোকের ছেলেকে?

"ঠিক আছে রে বাবা,তুমিই বলবো। এখন সরবৎ আনি।" চটপট করে লেবুর সরবৎ বানিয়ে এনে দিলাম,সরবত খেতে খেতে সে বললো,"খুব ভালো সরবৎ। খেয়ে যেতে বললে, কী খাওয়াবে?"

আমার এইবারে একটু মনখারাপ হলো,সত্যি তো সেরকম ভালো কিছু তো নেই।

আমি বললাম,"তুমি খেতে চাইবে না দুশমন,ঝিঙে চচ্চড়ি আর চিচিঙে ভাজা কি তুমি খাবে? ভুল করে বলে ফেলেছি,সরবৎ খেয়েই বিদায় হও বরং।"

সে উৎফুল্ল মুখে বললো,"উল্স,কতদিন ওসব খাইনি।ঐসব পিত্জা বার্গার খেতে খেতে জিভে চড়া পড়ে গেলো,সঙ্গে আছে আবার আধাসেদ্ধ মাংস গুঁজে তৈরী স্যান্ডউইচ,হিন্দিতে বালুটা ডাকিনি যে কেন বলে কামড় দিলেই মালুম হয়।কখন দেবে চচ্চড়ি?"

দুশমনকে খাইয়ে দাইয়ে বিদায় দিলাম। মৌরী চিবিয়ে খুব হেসে চলে গেলো সে। আমি এরপরে দুই গেলাস জল আর চারদানা মৌরী খেয়ে লিখতে বসলুম আবার। ঝাড়া পনেরোপাতা লিখে উঠে দেখি অন্ধকার হয়ে গেছে, আলো জ্বেলে সন্ধে দেখিয়ে আবার এসে লিখতে বসলাম,কিন্তু এইবারে একটু মাথাটা ঘুরাচ্ছিলো। সম্পাদক তো শুনবে না,খালি আমায় তাড়াতাড়ি করতে বলে,দেরি হলে বকে। দুত্তোর লিখবো না,পয়সা দেয় না,কিছু না,সামনে পুজো,আমার কাপড় কখানা এত পুরানো.....

বাংলা ইস্কুলে পড়তাম,ইংরেজী শিখতে পারিনি,তাই অন্য কোথাও কিছু কাজও তো পাইনা। বাবামাও তো তাড়িয়ে দিলো,ভাগ্যিস এই কুটিরখানায় কম ভাড়ায় থাকতে দিয়েছে অনীশ! তাঁর তো টাকাকড়ির অভাব নেই, পূর্বপুরুষের জমিদারি ছিল,এটুকু করলে কিছু কম পড়ে না। কিন্তু তাই বা করে ক'জন?

দুশমনও তো বাংলা ইস্কুলে পড়তো,কিন্তু ওর তো বাড়ীতে জমিদারি,বিলেতফেরৎ বাবামা। ওর সঙ্গে কিসের তুলনা? তাছাড়া ও পড়াশোনাতেও খুব তুখোর ছিলো।তাই তো চটপট মেমসাহেব রেখে ইংরেজি বলা দুরস্ত করে নিয়ে বিলেতে চলে গেলো। যাক গে যাক,আজকে রাতে ওদের বাগান থেকেই তো বেগুন ঝাড়তে হবে।

রাত বাড়লে শাড়ীটার আঁচল কোমরে জড়িয়ে রেডি হলাম। পাঁচিলের এক জায়্গা একটু ভাঙা,ওটাই সুবিধের জায়গা। পরিকল্পনা মতন চারটে বেগুন,কিছু পালং,কটা সীম,বরবটি তুলে চলে আসছি,কোথা থেকে একজন এসে হাতটা মুচড়ে ধরে আটকালো। গালাগাল করছিলো,পুলিশে দেবে বলছিলো। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিলো না, গলা শুনে বুঝেছিলাম দুষ্মন্ত। ঝটাপটি করতে গিয়ে আঁচল থেকে সব বেগুন,পালং পড়ে গেলো মাটিতে।

আহ,হাতটা এত জোরে ধরেছে! ছাড়াতে পারছি না কিছুতেই। শব্দ করিনি,পাছে চিনে ফেলে।মনখারাপ লাগছিলো। একসঙ্গে পড়তাম, এখন এ রাজা,আমি ওর বাগানে সব্জি চুরি করতে এসেছি সারাদিন না খেয়ে থেকে।

এইবারে টানাটানিতে আঁচলটা ফরফর করে খানিকটা ছিঁড়ে গেলো,এত পুরানো জীর্ণ কাপড়! হাতটায় মোচড় দিয়ে দুশমন বললে,"ছাড়বো না,মেরে তক্তা করবো,হুকে ঝুলিয়ে রাখবো,বাঁশপেটা করবো।"

হাতটায় বড্ড লাগছিলো,কাতরে উঠলাম,"আহ আহ,আর কোনোদিন করবো না,ছেড়ে দাও আজ।বড্ড লাগছে,দয়া করো।"

সে ছেড়ে দিলো,খুব অবাক হয়ে বললো,"মিন্টি? তুমি?"

আমি ওর পায়ের কাছে বসে পড়লাম,খুব কান্না পাচ্ছিলো,মাথাটা ঘুরাচ্ছিলো। আস্তে আস্তে বললাম,"মারতে চাও মারো,পুলিশে দিও না দয়া করে। সারাদিন কিছু খাইনি,মাথা ঘুরাচ্ছে।"ওর পা জড়িয়ে ধরলাম।

সে ম্রিয়মান গলায় বললো,"নিজের খাবার তখন আমায় দিলে তুমি?কেন বললে না তোমার কিছু নেই?"

ধরে তুললো আমায়। হাতটা ব্যথায় টনটন করছিলো।ও ডলে দিলো একটু।

তারপরে ধরে ধরে ওর ঘরে নিয়ে গেলো। মুখের কষ বেয়ে রক্ত পড়ছিলো আমার, এমনিই পড়ে মাড়ি থেকে,ও মারেনি ওখানে।ও গেলাসে জল দিলো,মুখ ধুয়ে নিলাম।

ও ভয় পাচ্ছিলো,"মুখ থেকে রক্ত পড়ছে তোমার,ভিতরে কোথাও লাগে নি তো?"

আমি হেসে বললাম,"ও এমনি পড়ে,রোজই পড়ে। হয়তো স্কার্ভি কিংবা ভিটামিন সি এর অভাব। আহ,হাতটা .....বড্ড ব্যথা। এমন করে মুচড়ে দিলে!অবিশ্যি কে আর চোরকে না মেরে ছেড়ে দেয়?"

ও ম্লান মুখে বললো,"অমন বোলো না। আমি জানতাম না তোমার এরকম অবস্থা। কাপড়টা ছিঁড়ে দিলাম। মায়ের একটা কাপড় নেবে? রাতে খেয়ে যাও,হ্যাঁ,মিন্টি?"

আমার কান দুটো গরম হলো,বললাম "না না,ছেড়ে দিলে চলে যাই,কিছু দিতে হবে না,ছেঁড়াটুকু সেলাই করে নেবোখন।"

"এই,আমি যে খেলাম তোমার ওখানে দুপুরে? তবে? আমার এই পাশের ঘরে ফ্রীজেই আছে খাবার,মাইক্রো-ওয়েভে গরম করে এনে দোবো।একটুও দেরি হবে না।আর মায়ের কাপড় আছে ও পাশের ঘরের আলমারিতে, এটা পুরোটাই স্পেয়ার কাপড়,মা পরেও না।"

খেতে দিলো,ভালো ভালো সব খাবার। সারাদিন খাইনি,খুব খিদে পেয়েছিলো,কিন্তু লজ্জা লাগছিলো খেতে। ও বুঝতে পারছিলো,আমায় কইলো,"তোমার এত লজ্জা করতে হবে না। খাও না ভালো করে। এমনিই এসে সব্জি নিয়ে যেও তো সকালে,আমি তুলে দেবো।"

"দুশমন,আমায় কোনো চাকরি দিতে পারো? এই যে লেখার কাজ করি,সম্পাদক সস্তায় থাকতে দিয়েছে আর মাঝে মাঝে কিছু পয়সা দেয়,ইচ্ছে হলে দেয়,নইলে দেয় না। আমার ....আমার দিন চলে না,উপোস করতে হয়। বাবামা তাড়িয়ে দিয়েছে চোর আর অন্নধ্বংসকারি বলে। ইংরেজী বলতে পারিনা বলে কাজ পাইনা,তোমার তো অনেক সোর্স, কিছু জুটিয়ে দিতে পারো?কোনো কাজ? খুব কষ্ট হলেও করতাম। এইভাবে আর চলে না,সম্পাদক এসে লেখা না পেলেও তো বাড়ী থেকে বার করে দেবে,তখন বা কোথায় যাবো?" চোখে জল আসছিলো,দুশমনকে লুকিয়ে মুছে ফেললাম।কতদিন বাবামাকে দেখিনি। ওদের সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে না।

দুষ্মন্ত আমার হাতটা আলতো ধরে বললো,"চাকরি? চাকরি অনেক আছে। ইংরেজী বলা শিখে নে না, এমনি ইংরেজী তো জানিস, বলা প্র্যাকটিস করলেই হয়ে যাবে। ভর্তি হয়ে যা কোথাও,কালই। আমিই নিয়ে যাবো,কালকে সকালে। আর একবার ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যাবো,তোর মাড়ি থেকে রক্ত পড়ে,কিছু চিকিৎসা করাস না কিছু না,এমনি বসে আছিস।পরে কিছু একটা হয়ে গেলে?"

মরলে তো বাঁচি,কিন্তু সে তো আর এই ভালো ছেলেটার কাছে বলা যায় না।

ও আমায় দিয়ে কড়ার করিয়ে নিলো যে কালকে সকালে আমায় নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে প্রথমে,তারপরে যাবে ইংরেজী বলা শেখানোর ক্লাসে ভর্তি করতে। আমি কোনোমতে রাজী হয়ে মথা নীচু করে বাড়ী ফিরার রাস্তা ধরলাম। কিন্তু কিসে যেন একটা লাগলো পায়ে,হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম।তারপরে আর কিছু মনে নেই।

যখন চোখ মেললাম দেখি চোখে মুখে জল দিয়েছে দুশমন,পাশে বসে কাগজ দিয়ে হাওয়া করতে করতে কাঁদছে। আমায় চোখে মেলতে দেখে ও ভারী অপ্রস্তুত হয়ে গেলো আর আমিও খুব অপ্রস্তুত হয়ে উঠে বসলাম। "আরে দুশমন,কাঁদছো কেন?আমার কিছুই হয় নি,এই তো এখনি হেঁটে হেঁটে বাড়ী চলে যাবো।"

দুশমন চোখটোখ মুছে বললো,"মণিকাকীমা খুব দুঃখ করলো আমার কাছে,তুই এইভাবে বাড়ী ছেড়ে চলে এসেছিস দেখে। বলে,আমরা কিছুই কইনি বাবা ওকে,ও নিজেই অভিমানে বাড়ী ছেড়ে চলে গেলো। কেন রে এইরকম করে চলে এসেছিস?"

একি রে বাবা? এ আবার আমায় মাবাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে!কেন? কী উদ্দেশ্যে?

বললাম,"চলে যাবো না তো কী? কতকাল আর ওদের অন্নধ্বংস করবো? এত বুড়ী দামড়ী হয়েও ওদের খাবো,ওদের পরবো? কিন্তু তুমি আমার মাবাবার সঙ্গে দেখা করতে যাও নাকি? ওদের আবার বলে দাও নি তো আমি কোথায় থাকি?"

ও হাসলো,"না তা বলিনি।কিন্তু তুই এভাবে....উপোস করে,ছেঁড়া কাপড়ে...ওদের ভুল বুঝেছিস তুই। ওরা চান না তুই এত কষ্ট পাস। আমায় জিজ্ঞেস করছিলেন তোর খোঁজ পেলে যেন বলি,ওরা এসে তোকে নিয়ে যাবেন। ওরা ভয় পাচ্ছেন তোর কী হলো ভেবে। অবিশ্যি অনীশও ওদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, ও ওদের আশ্বস্ত করেছে আগেই যে তুই ভালো জায়গাতেই আছিস।"

আমার এইবারে আবার মাথা ঘুরতে লাগলো,সম্পাদক এইভাবে আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে? তাহলে কী করবো? কাল শেষরাতেই পালাবো? পুরীর গাড়ী ধরবো? তার জন্যেও তো ছাই টাকা দরকার। আর যদি হিমালয়ে যাই....

আমার হাতে নাড়া দিয়ে দুশমন বললো,"কী ভাবছিস রে? চল কালকে দুজনে মিলে তোর বাবামায়ের কাছে যাই।যাবি?"

আমি ছিটকে উঠে পড়লাম। নাহ,এর একটা বিহিত করা দরকার। সবাই আমার খিলাফে খেলছে।

"কী রে,রাগ কল্লি নাকি মিন্টি? কী রে?"

আমি মুখ না ফিরিয়ে খুব তেজের সঙ্গে বললাম,"যদি আমায় না খেয়ে মরতে হয়,যদি কাপড় সব ছিঁড়ে যায়,তবে শেষ কাপড়টা দিয়ে গাছের ডালে লটকে পড়বো।তবু কোনোদিন কোনোদিন কোনোদিন আর বাবামায়ের কাছে যাবোনা।"

অবাক হয়ে দুশমন বললো,"কী বলেছিলো ওরা? এত রেগে আছিস?কী করেছিলো? খারাপ কিছু বলেছিলো?মিন্টি?"

আমি আর কথা কওয়ার অবস্থায় নেই,চোখ মুছতে মুছতে কোনোক্রমে কইলাম,"কিছু না।কিছু বলেনি।কিছু করেনি।"

"তবে?মণিকাকীমা কিন্তু আমার কাছে কাঁদছিলেন।তুই ভুল বুঝছিস না তো?"

"আমায় কেউ ভালোবাসে না রে দুশমন,কেউ না। কেউ চায় না আমায়।আমি চলে যাবো।কবে থেকে মা আমায় মরতে কয়,সেই ছোট্টো থেকে।এইবারে মরে যাবো।বাপের অনেক খরচ করিয়ে গেলাম কিছু ফিরৎ দেওয়া হলোনা।ভেবেছিলাম কিছু ধারশোধ করে যাবো।হলো না।"

চলে আসছিলাম,দুশমন এসে আবার হাতটা ধরলো,আস্তে হাতে চাপ দিয়ে বললো,"মিন্টি,অভিমান করতে গিয়ে এতখানি বড়ো ভুল করিস না !তোকে ওঁরা সত্যি ভালোবাসেন,পল্টুকাকু তোর কথা কইতে গিয়ে কাঁদছিলেন। বলছিলেন কথাও তো কইতে পারে ফোনে, তাও কয় না।আমি কী করেছিলাম ওর? এইরকম করে বলেন আমায়।তুই ওদের নামে বলছিস যে ওরা ভালোবাসে না?"

ও তাহলে বেশ ভালোরকম যাতায়াত ওর আমাদের বাড়ীতে!এতদিন ধরে এত কান্নাকাটি শোনা তো অল্পের ব্যাপার নয়! উঃ,কোথায় পালাই আমি?

দুশমন বলছে, "মিন্টি শোন, তোর যদি আপত্তি থাকে বাড়ী যেতে হবে না। কিন্তু কালকে সকালে আগে তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো, তারপরে স্পোকেন ইংলিশ এর ক্লাসে নিয়ে ভর্তি করবো। আমি আটটার সময় তোর ওখানে যাবো। রেডি থাকবি তো? "

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, "আমার কাছে অত টাকা নেই রে। ডাক্তারের ভিজিট কী করে দেবো? আর স্পোকেন ইংলিশ এর ক্লাসেও ভর্তির সময়েই নিশ্চয় বেশ কিছু টাকা দিতে হয়। থাক ওসব। তোকে শুধু শুধু ডিস্টার্ব করলাম, মাফ করিস। তুই বিলেতে ফিরে যাচ্ছিস কবে? "

দুশমন এইবারে কেমন যেন রেগে গিয়ে বললো, "মিন্টি, আমি নিজে এখন তোর জন্য খরচ করি যদি, অসুবিধে কীসের? তুই পরে চাকরি পেলে শোধ করে দিস।"

আমি মাথা নাড়ি, তা হয় না।

দুশমন আরো রেগে যায়, বলে, "বন্ধু বলে মনেই করিস না বুঝতে পারলাম। ঠিক আছে। যা তাহলে চলে যা, তোর যা খুশি কর। আমারও যা খুশি তাই করবো। আমিও মণিকাকীমা আর পল্টুকাকুকে জানিয়ে দেবো তুই কোথায় আছিস কেমন আছিস। ওদেরও তো দায়িত্ব আছে একটা।"

আমি আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বললাম, "সেক্ষেত্রে ঝুলে পড়তে হবে সেই মুহূর্তেই। ওরা আসছে দেখলেই।"

ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে কী যেন পর্যবেক্ষণ করে দুশমন, তারপরে বলে, "কিছু একটা হয়েছিল, খুবই গুরুত্বপুর্ণ কিছু। নাহলে এইভাবে একেবারে কচ্ছপের মতন নিজের প্ল্যান কামড়ে আছিস কেন? যাক, নাহয় জানাবো না। কিন্তু এই ডেডলক তো কাটাতে হবে। কিছু একটা তো করা দরকার। তাই না?"

অদ্ভুত একটা অবসাদ-অবসাদ ভাব গ্রাস করতে থাকে আমাকে, আস্তে আস্তে বলি, "ঠিক আছে তাহলে নাহয় তোর থেকে ভিক্ষাই নিলাম। তোর টাকাতেই কর তবে। যদি কোনোদিন আমার সুদিন আসে, তোকে ফেরৎ দেবো, নাহলে টাকাটা তোর জলেই যাবে।"

দুশমনের মুখে হাসি ফোটে, বলে,"এই তো বেশ যুক্তির কথা বলছিস। ঠিক আছে তাহলে কালকে দেখা হচ্ছে। এখন চল তোকে একটু এগিয়ে দিই। "

দুশমন আমার সঙ্গে আসতে থাকে, এগিয়ে দেবার নাম করে একেবারে প্রায় দোরগোড়ায় এসে পড়ে। তারপরে আবার আমার হাত চেপে ধরে মিনতি করে বলে, "মিন্টি, তুই কিন্তু ভালো হয়ে থাকবি। কিছু ক্ষতি করবি না নিজের। কালকে সকালে রেডি হয়ে থাকবি কিন্তু, হ্যাঁ তো? "

আমি মাথা হেলিয়ে জানাই যে তাই থাকবো।

(চলছে)

Wednesday, November 27, 2013

উৎস-পৃথিবী(৪)

নীরার চোখের পাতা কেঁপে ওঠে, সত্যি তো কিভাবেই বা বলবে সে, এ কি অদ্ভুত পরিস্থিতি ! সময়ের ধাঁধা! নীরার ইতিহাস কি নীরার কাছে একদম শক্ত কঠিন দৃঢ়? সে যা জানে ইতিহাস বলে, তা কি ধোঁয়াচ্ছন্ন ও কাঁপা কাঁপা নয়?

কিভাবে সে বলবে সেইসব ঘটনা দুর্ঘটনার স্থান কাল ও পাত্র? নীরার মনে পড়ে ডক্টর কীর্তিকারের কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির ক্লাস। উনি সেই সব ক্লাসে যত্ন করে বুঝিয়েছেন একই ঘটনাকে কত বিভিন্নভাবে ইন্টার্প্রিট করা যায়, ঘটনা বলেও আসলে নাকি কিছু নেই,যা পড়ে আছে তা আসলে কতগুলো সম্ভাবনার যোগফল।

মহাসময়ের জটিল স্রোত নীরাকে কাঁপিয়ে তোলে যেন সে জল হাত ডুবিয়ে বুঝতে পারছে না জল কী? যেন সে জীবনযাপন করতে করতে ও কিছুতেই বুঝতে পারছে না জীবন কী? জলের ভিতরে মাছের মতো সাঁতার কাটতে কাটতেও কিছুতেই জলপান করতে পারছে না। আকন্ঠ তৃষ্ণায় গলা কাঠ হয়ে আসছে নীরার।

একি অদ্ভুত ধাঁধা! এমন হবে তা ভাবনাতেও ছিলো না নীরার। এ কী আশ্চর্য দুনিয়া! কেনই বা সে তাহলে এত কাঠখড় পুড়িয়ে এলো? কেনই বা দেখা করলো এই মানুষটির সঙ্গে যার মন নীরব নিশীথে ভাঙা দেউলে লুটিয়ে পড়ে কেবলই গাইছে " শূন্যহাতে ফিরি হে নাথ পথে পথে দ্বারে দ্বারে/ চিরভিখারী হৃদি মম নিশিদিন চাহে কারে....."

নীরার দূরমগ্ন চোখের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন গলায় রোহিতাশ্ব বলেন,"দেবী, আপনি ঠিক আছেন তো? কেমন অন্যমনস্ক লাগে আপনাকে! বলতে হবে না দেবী কিছু, ভবিষ্যৎ আমি জানতে চাই না, যা হবার তা হোক। আপনি এমনি এমনি অন্য কথা বলুন। "

নীরা হাসে, মাথা ঝাঁকিয়ে ভাবনা দূর করে দিয়ে বলে," আমি ঠিক আছি, কিন্তু আরো ভাবতে হবে, ব্যাপারটা যা ভেবেছিলাম তারচেয়ে বেশী জটিল। আজ আমি বিদায় নিই, পরে আসবো অন্যদিন। সেদিন হয়তো কোনো সমাধান পাবো। "

নীরা উঠে দাঁড়ায়, বলে, "আমাকে দেবী বলবেন না রোহিতাশ্ব, আমাকে নীরা বলুন। ঠিক আছে?"

রোহিতও উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, মাথা কাত করে সম্মতি প্রকাশ করলেন। নীরার তখনো তৃষ্ণার্ত লাগছিলো, তবু জল চাইতে পারছিলো না। একবার কি একটা বলতে গিয়ে ও বললো না, আস্তে করে মাথা অল্প ঝুঁকিয়ে বললো,"আজ আসি রোহিতাশ্ব।পরে আবার দেখা হবে।আপনি ভালো থাকবেন।"

রোহিতাশ্ব নীরাকে এগিয়ে দিলেন উঠানপ্রান্তের দরজা অবধি, আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে দূরে মিলিয়ে গেলো নীরা বাঁকা পথটি বেয়ে মিহিন কুয়াশার আড়ালে।

*******

"অদীন, উঠে পড়ো, সকাল হয়ে গেছে। " হিন্দোলের শান্ত ঠান্ডা গলা, প্রতিদিনের মতন ডাকতে এসেছে,হাতে গরম জলে ভেজানো সাদা তোয়ালে।অদীনা প্রতিদিনের মতন থ্যাংকু দিয়ে তোয়ালে নেয়, উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে। চারিদিক এত আলো দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলে,"অনেক বেলা হয়ে গেছে? হিন্দোল?"

"আরে তাতে কী? আজ তো উইকেন্ড আর কাল রাতে অতক্ষণ জেগে রইলে যে!"

অদীনা বলে,"আজকে আমি ব্রেকফাস্ট বানাই হিন্দোল? দেরি যখন হয়েই গেছে, আরেকটু অপেক্ষা করো, আমার তৈরী হয়ে আসতে মিনিট পনেরো মতো লাগবে।"

"থাক না অদীন, ভালো হয়ে গেলে তুমি তো তখন করবেই। এই কদিন আমিই করি।"

"আজকে ভালোই লাগছে হিন্দোল, ডক্টর হপকিন্স তো আমায় এসব করতে বারণ করেন নি,বলো,করেছেন?"

"না, তা করেন নি, তবে স্ট্রেস নিতে বারণ করেছেন।"

"এতে স্ট্রেস হবে না হিন্দোল, লক্ষ্মীটি আজকে করতে দাও।"

"ঠিক আছে, করো। আমি ততক্ষণ খবরের কাগজ পড়ি।"

স্নান সেরে এসে গুনগুন করতে করতে চা টোস্ট এগপোচ তৈরী করছিলো অদীনা, বেশ ভালো লাগছে। গল্পটা অনেক এগিয়ে গেছে, এইবারে একদিন লেখা শুরু করতে হবে। ঐ যে ভবিষ্যতের মেয়েটি অতীতের মানুষটির কাছে যায়,ওরা কীভাবে রিলেটেড হতে পারে অদীনার সঙ্গে? নাহ, সেতো দর্শক মাত্র, বাইরের থেকে দেখছে শুধু। ঐ ছোট্টো ছোট্টো ফুলের মতন মেয়েদুটি, যাদের ঘুমিয়ে থাকতেই শুধু দেখেছে অদীনা, তাদের জন্য এমন লাগছে কেন হঠাৎ ওর? অচেনা ব্যথায় ভরে উঠছে বুক মুখ তলপেট? সত্যি কি ওরা ওর ছিলো সেই বহু বহু জন্ম আগে? যাদের ছেড়ে সে চলে যেতে চায় নি কখনো? তবু আঁধার মৃত্যু জোর করে নিয়ে গেলো অসময়ে?

ব্রেকফাস্ট টেবিলে সব শুনতে শুনতে চোখ এতখানি হয়ে উঠলো হিন্দোলের। অদীনা কল্পনাপ্রবণ হিন্দোল জানতো, কিন্তু এইরকম আশ্চর্য কল্পনা ওর?

বিকেলে ডক্টর হপকিন্স সব মন দিয়ে শুনে হাল্কা খুশী ভঙ্গীতে মাথা দোলাচ্ছিলেন। তারপরে হেসে বললেন, অদীনা, এই তো আপনি অনেক ইম্প্রুভ করেছেন। অদীনা, হিন্দোল, আপনারা বিয়ে করে ফেলুন, এইটাই তো ঠিক সময়! আপনারা দেরিই বা করছেন কেন? দেখুন, কিছু মনে করবেন না,ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলছি বলে, কিন্তু আমার কাজটাই এমন যে অন্যের প্রাইভেসিতে হাত পড়ে যায়। মানুষের মন ভারী রহস্যময় ব্যাপার,আমরা এর সারফেসটুকু ও পুরো বুঝিনা, অথচ সেইটুকুর ভিত্তিতেই কাজ করতে হয়। একেবারে হাতবাঁধা অবস্থা। আশা করি কিছু মনে করলেন না?"

তাড়াতাড়ি অদীনা আশ্বস্ত করে ওনাকে, "না না কিছু মনে করবো কেন? আমাদের কালচারে বয়োজ্যেষ্ঠরা এমনিতেই এইসব উপদেশ দিতে পারেন, মনে করা দূরের কথা, সৌভাগ্য হিসাবে নেওয়া হয়।"

প্রৌঢ় ভদ্রলোক হাসছিলেন, হয়তো অদীনাকে ভালো হয়ে যেতে দেখে তাঁর সত্যি ভালো লাগছিলো, কদিন আগেও কী ক্লিষ্ট, ভয়ার্ত, দুঃখী লাগতো অদীনাকে। এই গভীরমনের যুবতী মেয়েটিকে তিনি অবসাদ ও ওষুধের খপ্পরে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছেন এই মানসিক শান্তি তাঁর।

চেম্বার থেকে বেরিয়ে হিন্দোল গাড়ী চালালো স্টেট পার্কের দিকে, চলো অদীন, স্টেট পার্কের ঐ সুন্দর লেকটা তুমি ভালোবাসতে। চলো আজকে বোটিং করবো।

সন্ধে গাঢ় হলে চাঁদের রুপোলি আলোয় ভরে যায় চরাচর।হিন্দোল অদীনার নৌকা আলতো হাওয়ায় ভাসছিলো, অদীনার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে ছিলো হিন্দোল, ওর চুলে আলতো বিলি দিতে দিতে অচেনা একটা সুর গুণগুণ করছিলো অদীনা, কোন্‌ গানের সুর তা কিছুতেই বোঝা যাচ্ছিলো না।

রাত বাড়লে ফিরে আসে দুজনে, রাতের খাবার হিন্দোল বানায়, খেয়ে দেয়ে যে যার ঘরে ঘুমোতে যায় গুড নাইট জানিয়ে। অদীনা ডাকে না বলে হিন্দোল আসে না ওর ঘরে, ঘুমিয়ে পড়ার আগে আশ্চর্য সুখে অদীনা ভরে ওঠে, রোহিতাশ্বের সঙ্গে দেখা হবে!

*******

আজকে নীরা অনেক ধীর স্থির গোছানো, শান্তভাবে এসে কুশাসনে বসে প্রদীপ উসকে দিলো। উন্মুখ হয়ে ওর দিকে চেয়ে ছিলো রোহিতাশ্ব, আগুনের শিখার ঐপাশে নীরাকে কাঁপা কাঁপা অলীক উপস্থিতির মতন লাগে।

নীরা বলেছে তাই সে ভুর্জপত্রের বাঁধন খোলে সাবধানে, হংসপালকের কলম দোয়াতে ডুবিয়ে প্রস্তুত হয় লিখতে, অদ্ভুত শিহরণে কেঁপে ওঠে রোহিতাশ্বের হাত, আঙুল। কেমন অদ্ভুত শীত ভাব সর্বাঙ্গ ছেয়ে ছড়িয়ে পড়ে।

এখুনি কি কোনো অলৌকিক আলো এসে পড়বে দুজনাকে ঘিরে? কোনো আশ্চর্য শব্দ ও সুর শোনা যাবে? কোনো অলৌকিক অনুভব? নীরার পারফিউমের হাল্কা মিষ্টি সৌরভ আচ্ছন্ন করে রোহিতাশ্বকে, জানালার বাইরে রাত্রির রহস্যময়তার দিকে কেন জানি একবার চোখ পড়ে রোহিতের, তারপরেই চোখ ফিরে আসে দীপশিখায়।

নীরার চোখের দিকে চেয়ে রোহিতাশ্ব স্থির নিস্তব্ধ হয়ে যায়, চোখের মণিতে অলৌকিক আলো। একবার নীল মনে হলো, পরক্ষণেই সবুজ, তারপরেই হাল্কা গোলাপী থেকে আকাশী, ফের নীল। মাথা ঝিমঝিম করে এলো রোহিতাশ্বের। সে দেখলো নীরা হাসছে, পাতলা তরমুজফালি ঠোঁট অল্প ফাঁক হয়ে মুক্তোরঙ দাঁতের সারি, আশ্চর্য যুথীগন্ধে ভরে গেছে ঘর, রোহিতাশ্ব দেখলো গ্রীষ্মবিকেলের আকাশ ভরে খুলে দেওয়া বিপুল কেশভারের মতন কৃষ্ণ মেঘমালা, চমকে চমকে উঠছে বিদ্যুৎ, একসার সাদা বক উড়ে গেলো মেঘের উপর দিয়ে। গোলাপী আকাশী বেগুনী অজস্র রঙ ছড়িয়ে পড়ছে, নোনতা মিষ্টি টক তেতো আবীরগুলাল, আজ কি দোল?

নীরা হাত বাড়াচ্ছে, ছুঁয়ে দিলো রোহিতাশ্বের কাঁধ, রোহিতের আকাশে মধ্যরাত্রিনীল ফুঁড়ে ঝলকে ঝলকে নামতে লাগলো নক্ষত্রের বর্ষণ। এলোমেলো বেণীর মতন কিসের ঢেউ ওর চারপাশ ঘিরে, ও ডুবে যাচ্ছে ও ভেসে উঠছে, ভয়ে ওর দমবন্ধ হয়ে আসে ওর, বুক কাঁপে দুরুদুরুদুরু করে, তারই সঙ্গে আনন্দের অলৌকিক শিহরণ। রোহিতাশ্ব দেখছে জ্বলন্ত তন্তুগুচ্ছ উড়তে উড়তে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে, নানারঙের আবীর ঝলসে উঠছে, পোড়ানো লোহার গন্ধ বদলে যাচ্ছে বৃষ্টিগন্ধে। তারপরেই টুপটাপ শিশিরের মধ্যে এসে সে হয়ে যাচ্ছে জলকমল।

শরতের বৃষ্টিশেষ সন্ধ্যার আকাশ, পশ্চিমদিকটা সোনার মতন ছলছল করছে, সেদিকে ভরা নদীর জল সোনার মতন, আকাশে কমলা মেঘ, বিরাটা হাল্কা কমলা পালকের মতন ভেসে আছে, আলোর ছটা পড়েছে রোহিতাশ্ব আর সদানীরার উপরে, তখন তাদের সদ্য বিয়ে হয়েছে, সেই কনেদেখা আলোয় কি কোনো যাদু ছিলো? হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারে না রোহিতাশ্ব, দুচোখে ঝাপসা বাদল, অথচ আকাশে বাদল তো ফুরিয়ে গেছে!

দমকা হাওয়ায় দক্ষিণ সমুদ্রের গন্ধ, রোহিতাশ্বের মুখচুল ছুঁয়ে উড়ে চলে যায় হাওয়া, রাত্রি ভরে জ্বলজ্বল করে ওঠে তারার দল, ছায়াপথের ওড়নায় স্পন্দন জাগে।

চোখের পাতা ফেলে সে দেখে নীরা একইভাবে চেয়ে আছে তার দিকে অল্প উদ্বিঘ্ন মুখ! হাতটি সরিয়ে নিয়েছে।নীরা বলে,"রোহিতাশ্ব, আপনার কি কোনো অসুবিধে হচ্ছে? আমি অনেকগুলো কথা বলে গেলাম, কিন্তু আপনি শুনতে পেলেন না!"

রোহিতাশ্ব কী বলবে, সে যে কত কী দেখছিলো,শুনছিলো,কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। সে এত জায়্গায় এত বিভিন্ন কালে একই সঙ্গে কী করে থাকবে, সেতো একটা মানুষ!

নীরা আবার স্পর্শ করে রোহিতাশ্বের হাত, অমনি সবুজ নীল ছটা ছড়িয়ে পড়ে চারধার ঘিরে, রোহিতের চেতনায় দ্রুতগামী অশ্বেরা আলোর তন্তুর মতন চতুর্দিকে ছুটে যাচ্ছে আর সে নিজে ছুটে যাচ্ছে আলোর চোখের কেন্দ্রের দিকে। মধ্যবিন্দু থেকে উৎসারিত অনন্ত আলোকমালা জলের ধারার মতন ওকে ঢেলে নিয়ে যাচ্ছে ওদিকে,অসহায় ও ভয়ার্ত রোহিত হাত বাড়িয়ে আটকে যেতে চাইছে কোথাও,অমনি একটি নিটোল সুন্দর শাঁখাপলায় সাজানো হাত ওর হাত ধরে ফেললো, সদানীরা!!!

দুখানা ঢেউ ঘুরে ঘুরে জলের মধ্যে নাচছে, গোলাপীকমলা সোনালী সবুজ হাজার হাজার রঙের আলো ঝলকে ঝলকে উঠছে, ঐ ঘূর্ণি আসলে রোহিতাশ্ব নিজেই।

সদানীরার হাত তো নয়, এতো এই আশ্চর্য ভবিষ্যতরুণীর হাত, নাকি স্বপ্নসম্ভবার হাত? রোহিতাশ্ব নিজের দুহাতে শক্ত করে ধরে নীরার দুহাত, তীব্র ঘূর্ণির মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে দুজনে ঐ রহস্যবিন্দু ভেদ করে চলে যায়, এইবারে সবকিছু আলোয় আলো, এইবারে নির্ভয়তা, এইবারে অভয়, এইবারে বীতশোক তারা!

********

মাঝরাত পার হয়ে গেছে কখন, ঘড়ির কাঁটা টিক টিক টিক টিক করে চলেছে শেষরাত্রির দিকে। অদীনা জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে রাত্রির নিবিড় রহস্যে ডুবে আছে। অবিরল জলধারা ওর গাল চিবুক গলা ভাসিয়ে দিচ্ছে,কিন্তু খুব ভালো লাগছে ওর,খুব ভালো। বহুদিনের কঠিন জমাট হিমপাথর গলে গিয়ে নদী হয়ে যাচ্ছে। এতদিনে কি সূর্যোদয়ের বেলা এলো? এইবারে কি এই ঘোর আঁধারে আলো ফুটবে?

এত কোটি কোটি তারা, তবু অন্ধকার! তবু ভালোবাসার উপরে ও কিসের কঠিন আস্তরণ! তবু কেন এত ভয়? এত সন্দেহ? এইবারে কি ঘুচবে সব বালাই? এতদিনে কি পথ দেখতে পেয়েছে অদীনা? এই বিঁধে থাকা কষ্টের বর্শা একে একে একটু একটু করে ওকে কি দিয়েছে মৃত্যু পার হয়ে অমৃতে যাবার দিশা?

আজকে স্বপ্ন-রোহিতাশ্ব তাকে বলে দিয়েছে পথ, আজকে সে দেখতে পেয়েছে এই গোলোকধাঁধা থেকে বেরিয়ে যাবার রাস্তা। সে একই বৃত্তে ঘুরছিলো আর ঘুরছিলো বলে দেখতে পায় নি উপরে নীচে খোলা খোলা এত খোলা বিপুল আকাশ, এই গন্ডীটুকুর বাহির হতে পারলেই আর কোথাও বাধা নেই, কান্না নেই, বৃথাদুঃখ নেই। তখন কে বা এই সামান্য অদীনা, কেই বা হিন্দোল, এই টুকরো টুকরো জীবন, সুখতুলো অশ্রুপালক আর দুঃখপাথর শিশিরগাঁথা মণিহার হয়ে দুলছে ঐ বিরাট আলোর গলায়।

দরোজা খুলে আলতো পায়ে উত্তরের ব্যালকনিতে আসে অদীনা, আকাশে সপ্তর্ষির দিকে তাকিয়ে অল্প মাথা নোয়ায় অদীনা, ধ্রুবতারার দিকে চেয়ে সে দেখতে পায় নীলকন্ঠ পাখিটাকে, একটি একটি করে পালক যে প্রতিদিন ফেলে গেছে অদীনার শিয়রে, কিন্তু এতদিন ওর ঘুম ভাঙে নি। দুয়ারটুকু পার হয়ে ও এসে দাঁড়াতে পারেনি সাগরসঙ্গমে। আজ খুলে গেছে সব, আজ পাথরের দুর্গ পাপড়ির মতন খুলে গেছে ওর চারপাশ থেকে।

দুপুরে সে ফোন করে অধ্যাপককে, বহুদূর মহাদেশ থেকে অধ্যাপকের গভীর সুন্দর কন্ঠস্বর ভেসে আসে, উনি একটু অবাক, অনেকটা খুশী। অদীনা সত্যি সত্যি একদিন ফিরতে চাইবে হয়তো উনি ভাবতেও পারেন নি। কিন্তু স্থিতধী গণিতজ্ঞ তিনি, গলায় আবেগ ফুটতে দেন না, শুধু পরপর অঙ্কের জট খোলার মতন ধাপে ধাপে বলে দেন কিসের পর কী করতে হবে অদীনার।

বিকেলে ফিরে হিন্দোল সব শুনে অত্যন্ত অবাক। হালকা ছায়া পড়ে ওর মুখে, অদীনা বুঝতে পারে। ওকে জড়িয়ে ধরে বলে," হিন্দোল, তুমি যদি "না" বলো, তাহলে আমি যাবো না। তোমাকে দুঃখ দিতে কখানো পারবো না, যখন সবাই আমায় ত্যাগ করেছিলো, তখন তুমি একা আশ্রয় দিয়েছিলে, এত সতর্ক যত্নে আমায় বিপদ পার করে এনেছ, বিনিময়ে কিছু চাও নি, সেই তোমাকে কিছুতেই আমি দুঃখ দিতে পারবো না। হিন্দোল, তুমি একবার শুধু বলো তুমি কী চাও, আমি তাহলে কালকেই ওঁকে জানিয়ে দেবো।"

হিন্দোল অদীনার ডানহাতের কব্জি নিজের হাতে আলতো করে ধরে আস্তে আস্তে বলে,"পাগলি কোথাকার, এমন করে বলছো কেন? আশ্রয় আবার কী ? আমি আশ্রয় দেবার কে? প্লীজ এভাবে বোলো না, কেমন লাগে। আমি কখনোই তোমাকে "না" বলবো না, বলতে পারি না, আমি জানি তুমি অন্যরকম, তোমার জীবন অন্যরকম, আমার জীবন যেন তার পথে বাধা না হয়, তারজন্য প্রার্থনা করি আমি, বিশ্বাস করো।" হিন্দোল এমন নরম এমন আশ্চর্য মগ্ন সুরে কথা বলছে যে অদীনা আর থাকতে পারে না, দুহাতে ওর মুখটা ধরে নিজের দুখানা ঠোঁট ...

এত বছর পরে এই প্রথম অদীনা হিন্দোল হাতধরাধরি করে পার হয়ে যায় নিষেধের ও বাধার গন্ডী, এতদিন পরে ছাড়া পারতো না অদীনা, যে বন্দী সে কী করে পূজা নিবেদন করতে পারে? একমাত্র যখন সে মুক্ত তখনি তো দিতে পারে পুষ্পাঞ্জলি! হিন্দোল আগে চাইলে সে কী করতো? মাঝপথে খেলা ভেঙে চলে যেতে হতো ওকে!

নিঘুম মাঝরাতে শুনতে শুনতে হেসে ফেললো হিন্দোল, বললো,"এই অদীন, তুমি আমাকে অমন মনে করতে? বিশ্বাস করো নি একেবারে, না? কী করবে বলো, আমার তোমার দোষ নয়, হাজার হাজার বছরের চিন্তা আর অভ্যাসের ব্যাপার কি রবার দিয়ে মুছে দেওয়া যায়?"

অদীনা লজ্জায় একটু কুঁকড়ে যায়, সত্যি পুরোপুরি বিশ্বাস তো সে করে নি করতে পারে নি হিন্দোলকে। কী করবে? সে কি তখন আজকের অদীনার মতন ছিল?

হিন্দোলই সব ব্যবস্থা করে ফেললো, একমাস পরে অধ্যাপকের কাছে হিন্দোলই পৌঁছে দিয়ে গেল অদীনাকে, দু'দিন অতিথিও রইল সেথায়। পাহাড়ের উপরে সাদা রঙের পাথরের বাড়ী, চারিপাশে সবুজ আর সবুজ, কত গাছ, কত পাখী! চন্দনগাছের সারি, গোলাপের সযত্নরচিত উদ্যান, নারকেল গাছগুলোর কান্ড বেয়ে গোলমরিচের লতা, নীলমণিলতায় ফুলের গুচ্ছ। চেনা-অচেনা পাখিরা খুনসুটি করছে, গান গাইছে। অদীনার মুখে অচেনা আলোর কারুকাজ, ময়ূরপঙ্খী ভাসানোর সুখ। হিন্দোল অতৃপ্তচোখে দেখছিলো।

উপরের গোল ঘরে অধ্যাপক কাজে মগ্ন থাকেন, ঐ জটিল গণিতের গোলকধাঁধা থেকেই টুকরো টুকরো সুতো এনে এনে অদীনা গাঁথবে ওর মেঘডম্বরু পালা। অনোরণীয়ান ও মহতোমহীয়ানের পালকের সূক্ষ্ম কারুকাজ, হাসিমুখ অধ্যাপকের নির্লিপ্ত অথচ জ্যোতিদীপ্ত চক্ষু দুটি, ইনিই কি পিতা নন, ইনিই তো নবজীবন দান করেছিলেন একদিন অদীনাকে! শান্ত আত্মসপর্ণে মগ্ন হয়ে যায় অদীনা, অধ্যাপক কখনো নীরবে কখনো সরবে আস্তে আস্তে অসীম ধৈর্যে ওর মনের প্রদীপে তৈলসঞ্চার করে যান।

হিন্দোল অপেক্ষায় থাকবে বলে গেছে, অদীনা জানে সে অপেক্ষায় থাকবে সত্যিই, দেশকালের বিপুল বাধা দূর হয়ে যাবে, যাবেই। দৃঢ় বিশ্বাসে চোখে নিঘুম আলো জ্বেলে ঐ সময়বিহীন স্বপ্নলোকের দিকে বইতে থাকে অদীনা।

"কালে বর্ষতু পর্জন্যং পৃথিবী শস্যশালিনী...", ঐ দিব্যধামবাসী মেঘ অমৃতজল বর্ষনে তৃষ্ণার্ত ধরিত্রীকে শান্ত করবে একদিন, করবেই। সপ্তর্ষির অনন্ত জিজ্ঞাসাচিহ্ন আকাশে জেগে থাকে অক্ষয় হয়ে, ধ্রুবতারার কাছে থেকে উড়ে আসে অলীক সে নীলপাখি....

অদীনা পূর্বাস্য হয়ে ভোরের ছাদে দাঁড়িয়ে মৃদুসুরে আবৃত্তি করে," অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্তা বিদ্যয়ামৃতমস্নুতে..."

সেই আকাঙ্খিত আলোর বর্ষণ ভরে যাক এই সুধাহীনা বসুধার হৃদয়, অদীনা ভিক্ষার অঞ্জলি পাতে একা একা।

(সমাপ্ত)

Monday, November 18, 2013

উৎস-পৃথিবী(৩)

স্নান সেরে হাল্কা গোলাপী নরম ড্রেসিং গাউন পরে বেরিয়ে আসে অদীনা, মাথায় ভেজা চুল জড়িয়ে প্যাঁচানো শুকনো তোয়ালে। ব্রেকফাস্ট টেবিলে তখন টোস্ট এগপোচ চা কফি এইসব সাজাচ্ছে হিন্দোল। একটু হেসে নিজের ঘরে চলে যায় অদীনা। হেয়ার-ড্রায়ার চালিয়ে দিয়ে চুল শুকনো করতে করতে অদীনা গুণগুণ করে কী একটা গানের কলি। সে কোনোদিন গান শেখেনি বটে, কিন্তু তবু কেন জানি প্রতি সকালেই একটা না একটা গানের সুর তাকে অধিকার করে।

সে পোশাক টোশাক সব পরে চুল টুল আঁচড়ে মুখে ক্রিম মেখে ডাইনিং রুমে এলে হিন্দোল ওর দিকে চেয়ে হাসে, বলে "আজকে তোমাকে অনেক ফ্রেশ দেখাচ্ছে অদীন। কাল রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল?"

হেসে হ্যাঁ বলে অদীনা, চেয়ারে বসে এগপোচের প্লেট নেয়, থ্যাংকু দিয়ে খেতে শুরু করে। বেশ খিদে পায় আজকাল অদীনার। আগে তো খিদেই পেত না বিশেষ, তবু খেয়ে নিতে হতো নিয়মিত সময়ে। এখন সত্যি সত্যি খিদে পায়, সকালে দুপুরে বিকেলে রাত্রে। ডক্টর হপকিন্স শুনে খুব খুশি হয়েছেন। অদীনা জানে হিন্দোল ও মনে মনে খুব খুশি, কিন্তু বাইরে প্রকাশ করে না, খুব চাপা স্বভাবের ছেলে হিন্দোল।

অদীনার মাঝে মাঝে ভিতরটা উথলে উথলে ওঠে। সে ভাবে এইভাবে যত্ন করছে হিন্দোল, এইভাবে নিঃশর্তে ভালোবাসছে, এত নিঃস্বার্থ ভালোবাসার যোগ্য কি সে? কে তুমি অলক্ষ্য ঈশ্বর, এই পার্থিব কন্যার জন্য পথে পথে ছড়িয়ে রেখেছ এমন আশ্চর্য অলৌকিক ঐশ্বর্য? এত কোমল বৃক্ষছায়া, এত শীত স্নিগ্ধ ঝর্ণাজল? সে কোথায় যেন শুনেছিল প্রার্থনা সঙ্গীত, "আমার হৃদয় বনহরিণী, তুমি তাকে নিয়ে যাও শীতল স্রোতের কাছে, তৃষ্ণার্ত তাকে তৃপ্ত করো সেই জলে। আমাকে নিয়ে যাও কচি ঘাসে ভরা সবুজ উপত্যকায়, সেখানে বিশ্রাম নিয়ে আমি ক্লান্তি দূর করি। তুমি আছো বলেই ভয় নেই, যখন আঁধারে বেরিয়ে আসে হিংস্র পশুরা, তখনো ভয় নেই, তুমি আমার সঙ্গে আছো বলে। তোমার ভালোবাসা ভরে দিল এই মাটির কলস, কানায় কানায়।" কোথায় শুনেছিল অদীনা? কোন্‌ অচিন একতারাওয়ালির গলায়?

সোনালি পাড়ওয়ালা সাদা চিনেমাটির কাপে চা ঢেলে এগিয়ে দেয় হিন্দোল। অদীনা আহ বলে ওঠে আরামের একটা চুমুক দিয়ে। খুব ভালো লাগছে তার। ক'দিন হলো পৃথিবীটাকে ভারী ভালো লাগছে অদীনার, সামান্য সামান্য প্রতিদিনের চেনা জিনিসগুলোকেই অসামান্য লাগছে। এককাপ চা, একটা ওমলেট, চাট্টি সাদা ভাত আর একটুখানি সব্জিভাজা-মনকে ভরিয়ে দিচ্ছে। ফুলদানিতে লম্বা সবুজ পাতা আর কোমল উজ্জ্বল নীল কয়েকটি ফুল-এইসব টুকরো টুকরো জিনিস মনকে ভরিয়ে তুলছে কানায় কানায়।

এতকাল যেন স্বেচ্ছানির্বাসনের গুহায় ঘুমিয়ে রয়েছিল অদীনা, এতদিনে জেগে উঠেছে সকালের নতুন আলোয়। এখন ওর সত্যি বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে অনে-এ-এক দিন, ইচ্ছে করছে বাগান ভরে গাছ লাগাতে, সে দেখবে তাদের বেড়ে ওঠা, দেখবে ফুলেফলে তাদের ভরে যেতে, দেখবে তাদের ডালে উড়ে এসে বসছে কত বিচিত্রবর্ণ পাখি। হিন্দোল আর ও গার্ডেন চেয়ারে বসে দেখবে শিশুরা খেলা করছে সবুজ ঘাসের উপরে। হিন্দোল আপিসে বেরিয়ে গেলে অদীনা চুপচাপ ছবি আঁকে সাদা কাগজে। বেশিরভাগই ল্যান্ডস্কেপ আঁকে অদীনা। আজ আঁকছে সন্ধ্যার রাঙা আভায় ভরে থাকা একটা নদী, পাড়ে ছোট্টো একটা কুটির, তালগাছ, আমগাছ, আতাগাছ। ছোটোবেলার ছড়া মনে পড়ে, "আতাগাছে তোতাপাখি/ ডালিমগাছে মৌ"

এক জীবনে কোথা থেকে কোথায় চলে এলো সে, তবু পথ তো শেষ হয় না! পথ কি কোনোদিন শেষ হয় আসলে? সব পথই তো অনন্তের দিকে চলে গেছে।

কেন সে এসেছে, কীসের জন্য সে জন্মেছিল আর কোথায় কাদের মধ্যে সে আছে? হঠাৎ সেই তীব্র অতৃপ্তি ফিরে আসে মনে, মুখে নিমপাতার মতন তেতো স্বাদ। রঙতুলি সব গুটিয়ে ফেলে অদীনা। হচ্ছে না, হচ্ছে না, বড় ক্লান্তি লাগে। বুকের ভিতরের কষ্টিপাথরে নিজের কাজগুলোকে ঘষা দিয়ে দিয়ে সে দ্যাখে, এসব কিছুই কি সে করতে চায়? ভালো করে পরখ করে দ্যাখে একটু কোনো সোনালি দাগ কি পড়লো কোনোটার থেকে?

শোবার ঘরে এসে সে আস্তে আস্তে বিছানায় গা ঢেলে দেয়, আজকে এখনি একবার সেই রিল্যাক্সেশন টেকনিক অভ্যাস করে নিলে কেমন হয়? হিন্দোল তো ফিরবে সেই বিকেল পাঁচটার পরে। এসে ওকে ডিনারে নিয়ে যাবে চাইনিজ বাফেতে। আজকে তাই ঘরে আর লাঞ্চও খাবে না অদীনা। এখন অনেক সময় আছে অদীনার।

বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে সিলিং এর দিকে তাকায় অদীনা, সোনালিরুপালি নকশাকাটা খুব বাহারী একটা ফ্যান সেখানে ঝুলছে, ডোমপরানো আলো চারখানা তার উপরে। সেখান থেকে ঝুলছে দুখানা ধাতব শিকল, একটা তানলে আলো জ্বলে, একটা টানলে পাখা। খুব কমই ব্যবহার হয় এই দুটো, এমনি ঘরে যে আলো আছে, দেওয়ালের গায়ে, সেইতেই কাজ চলে সব সময়। তবু এই বাহারী ফ্যান আর ডোমপরানো আলো খুলে ফেলা হয় নি, রয়েই গেছে, ডেকোরেশনের মতন। সেইদিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে চোখ বুজে ফ্যালে অদীনা, পায়ের পাতা থেকে জঞ্ঘা থেকে হাঁটু থেকে মন তুলে নিতে থাকে একে একে, সব পেরিয়ে মাথা পর্যন্ত এসে গেলে দেহ শিথিল হয়ে যায়, বাতাসে ভাসার মতন হাল্কা লাগে এখন। আহা, এইবার ঘুম, এইবার স্বপ্ন। এসো রোহিতাশ্ব, এসো।

*******

অচেতন রোহিতাশ্বের দিকে এগিয়ে আসে মেয়েটি, নীচু হয়ে পরখ করে দেখে। জল দেবার কথা হয়তো মনে হয় ওর, সে চারদিকে চোখ ফেলে দেখে। ঐ তো কাঠের বেদীর উপরে পিতলের কলস, নিশ্চয় জল আছে ওতে। পাশে কাঁসার একটি ভারী গেলাসও উপুড় করা! বাহ,ঐ গেলাসে জল নিয়েই ছেটানো যাবে।

জলের স্পর্শে আস্তে আস্তে চেতনা ফেরে রোহিতের, তালপাতার পাখায় মেয়েটি হাওয়া করছিলো। চোখ মেলে রোহিতাশ্ব আস্তে আস্তে ওঠেন,বসেন, এবারে আর চমকান না, ভয় পান না, কিন্তু কথাও বলতে পারেন না, বাক্যহীন হয়ে বসে থাকেন,মেয়েটি নীরবে পাখার বাতাস করে যায়। রাত্রি বয়ে যেতে থাকে।

রোহিতাশ্বের সবকিছু স্বপ্ন-স্বপ্ন লাগে, হয়তো এ মেয়েটিও স্বপ্ন,হয়তো এখুনি মিলিয়ে যাবে শরতের মেঘের মতন এই মেয়েটি। সদানীরার মুখের সঙ্গে এর মুখের কোথায় যেন খুব মিল! মনটা শান্ত জলের মতন স্থির হয়ে আসে রোহিতাশ্বের, মনে হয় সত্য হোক বা স্বপ্ন,মেয়েটি থাকুক আরো কিছুক্ষণ।কিন্তু মেয়েটি হাসে, বলে, "আমার তো এইবারে যেতে হবে রোহিতাশ্ব। কিন্তু আমি কালকে রাত্রে আবার আসবো। আপনি ভয় পাবেন না তো? "

নীরব রোহিত আস্তে আস্তে মাথা কাত করেন সম্মতি বোঝাতে যে আগামীকাল তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকবেন। পাখা রেখে দিয়ে মেয়েটি আস্তে আস্তে বাইরে যায়, মাঠের পায়ে চলা পথটির উপর ওর চলন্ত অবয়ব আস্তে আস্তে ছোটো হয়ে আসে, বাতায়নলগ্ন রোহিতাশ্বের উৎকন্ঠ চোখের সামনে কুয়াশার মতো মিলিয়ে যায় আগন্তুক যুবতী, চোখ কচলে আবার তাকান রোহিত, এই ছিলো আর তো নেই! চোখের ভুল? সত্যি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছেন রোহিতাশ্ব? ঘুম হয়নি ঠিকমতো তো সত্যিই, এতরাত জেগে জেগে কদিন লেখার কাজ করছেন, তাহলে কি সত্যি ভুল দেখছেন? জাগ্রৎস্বপ্নে আচ্ছন্ন হয়েছে ক্লান্ত মস্তিষ্ক?

ঘুমাতে হবে, ঘুমানো দরকার ভেবে মাটিতে শীতলপাটি বিছিয়ে এক ফুঁয়ে প্রদীপ নিভিয়ে পাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে গায়ে চাদর টেনে দিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যান রোহিতাশ্ব।

*******

ফোনটা বাজছে, ঘুম ভেঙে যায় অদীনার। ফোনটা ধরে কানে লাগায় অদীনা,"হ্যালো।" ওপাশ থেকে বহুকাল ভুলে যাওয়া গলা,"অদীনা, আমি সায়ন্তনী বলছি। চিনতে পারছিস আমায়? ইস্কুলে অতগুলো বছর একসঙ্গে,চিনতে পারছিস?"

অদীনার মনে পড়ে। সে অবাক গলায় বলে,"সায়ন্তনী? কতকাল পরে রে! অবাক কান্ড! তা তুই কেমন আছিস? কোথা থেকেই বা বলছিস?"

"আরে তোর ভাইয়ের থেকে তোর ফোন নাম্বার পেলাম। তোর ভাই তো এখন আমাদের শহরে! হঠাৎ ফোন করে খুব চমকে দিয়েছি, না?"

"তা সত্যি,চমকে দিয়েছিস সত্যিই। আমি ভাবিই নি তোর ফোন পাবো কোনোদিন! কেমন আছিস? "

অদীনার মনটা ছলছল করে,সেই কঠিন রুক্ষ কিশোরীবেলার দিনগুলিতে এই সায়ন্তনীই ছিলো একমাত্র প্রকৃত বন্ধু অদীনার,ওর কাছেই কিছুটা হলেও মনকে খুলে ধরতে পারতো অদীনা। অন্য আর কারু সঙ্গে এত কাছের বন্ধুত্ব ছিলো না ওর। সায়ন্তনী খুব ভালো গান গাইতো, ক্লাসিকাল শিখতো আর খুব ভালো রবীন্দ্রগানও গাইতো। অদীনা গান গাইতে পারতো না, ওকে গানের স্কুলে যেতে দেয় নি বাড়ীর থেকে, সায়ন্তনীর গান শুনে ওর কিছুটা সাধ পূরণ হতো। মধু খুব মন ঢেলে ওকে গান শোনাতো, ও জানতো গাইতে পারেনা বলে অদীনার মনে খুব কষ্ট। কেউ তা জানে না, কাউকে কোনোদিন বলে নি অদীনা,বললেও কেউ বুঝবে না এই ভয়ে। সায়ন্তনীকে ও বলে নি,ও এমনি ই বুঝে নিতো।খুব সংবেদনশীল আর সূক্ষ্ম অনুভূতির মেয়ে ছিলো সায়ন্তনী।

অদীনার এখনো মনে পড়ে, শরতের সন্ধ্যা, মহালয়ার আগের সন্ধ্যা। আকাশ স্বছ কালো, চাঁদ নেই, ফুটফুট করছে তারা, ছায়াপথের হাল্কা ওড়নায় চুমকি চুমকি তারা জ্বলজ্বল। সেই আশ্চর্য নক্ষত্রের রাতে ছাদে মাদুর পেতে বসে তারা দুটি কিশোরী, সায়ন্তনীর কোমল মিষ্টি কিশোরী গলায় কী সুর! ও গাইছিলো,"মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে/ আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে।..." এই গানটা বিশেষ প্রিয় ছিলো অদীনার,তাই সায়ন্তনী এই গানটাই বেশী গাইতো। এটা শেষ হলে ও গেয়েছিলো,"আকাশভরা সূর্যতারা, বিশ্বভরা প্রাণ/ তাহারই মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান/ বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান..."

সায়ন্তনীকে আকাশে দিকনির্দেশ করে অদীনা সেদিন চিনিয়েছিলো রাজহংসমন্ডল, সিগনাস। তার পুচ্ছের উজ্জ্বল তারাটি, ডেনেব, বাংলা নামটি ছায়াগ্নি। ছায়াপথের উত্তর প্রান্তে এই রাজহংসমন্ডল। দক্ষিণে তাকালো ওরা, ধনুরাশি চেনালো অদীনা, পাশেই বৃশ্চিকরাশি, তাতে জ্বলজ্বলে কমলা জ্যেষ্ঠা তারা, ধনুরাশির মধ্য দিয়ে দেখা ছায়াপথের কেন্দ্রটি, সেদিকে ঝাপসা আলোয় যেন তারার চূর্ণ ছড়ানো। মুগ্ধ হয়ে আকাশে তাকিয়েছিলো সায়ন্তনী,তারপরে চোখ ফিরিয়ে অদীনার দিকে চেয়ে ছিলো।

সব মনে পড়ছে অদীনার। এক এক করে সব মনে পড়ছে। কিছুই কি হারায় না? সবই রয়ে যায় কোথাও না কোথাও? অলক্ষ্য ক্যামেরায় তোলা গুপ্ত চিত্রমালা হয়ে? শুধু যে দেখতে চায়,কেবলমাত্র সে ই দেখতে পায়? অদীনা তো চায় না দেখতে, ভালো ভালো ছবির সঙ্গে ওখানে যে অনেক কঠিন কষ্টের ছবিও রয়ে গেছে, সেইসব বন্ধ ঘরের তালা খুলে ফেলতে তো সে চায় না, ঐসব বন্ধ ঘরের সামনে যেতেই যে তার বুক ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে কষ্টে! তবু কেন বার বার ফিরে আসে সব? ঐ হেমন্তগোধূলির ম্লান বিষন্ন আলো, ঐ ছায়া ছায়া বারান্দা, ঐ ম্লানমুখ দুঃখী শিশুটি, ওর আহত অবাক দৃষ্টি, ঐ শীত শীত হাওয়ায় ঝরে ঝরে পড়তে থাকা সাদা সাদা নরম ফুল! সব আজ কত দূরের, বিগত জন্ম যেন! তবু কেন ফিরে আসে? কেন এমনভাবে ফিরে আসে? এত রক্ত ঝরায়? কেন? নিষ্করুণ মুহূর্তমালা কী তীব্র উদাসীন! স্মৃতি এত অত্যাচারী কেন? মনে যদি পরেই বেছে বেছে ভালো ছবিগুলো মনে পড়ে না কেন? হায় অদীনা, তোর মন এত দীনহীনা কেন?

"কী হলো অদীনা, চুপ হয়ে গেলি যে!" ফোনে সায়ন্তনী উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে,"তোকে কি অসময়ে ফোন করে বিরক্ত করলাম? ব্যস্ত ছিলি, নারে? "

"না, না, সায়ন্তনী, কীসব বলছিস? আসলে পুরানো কথা ভাবছিলাম, তুই আমায় গান শোনাতিস, মনে পড়ে?"

"হ্যাঁ মনে পড়বে না? আর তুই আমায় তারা চেনাতিস।" ফোনের দুজনে দুপ্রান্তে হেসে ওঠে, মাঝখানে টলমল করে ওঠে মহাসমুদ্র, নদীসমূহ আর মহাদেশীয় বিস্তার। আর কি কোনোদিন সায়ন্তনীর সঙ্গে দেখা হবে? কথা বলতে বলতে অদীনা ভাবে।

অনেকক্ষণ কথা বলে তারপরে কথা সেদিনের মতন থামলো,কত তুচ্ছ ছোটোখাটো কথা উঠলো পড়লো, যা তখন এতটুকু গুরুত্বপূর্ন মনে হয় নি! দেশ্কালের দূরত্বে তা কত না রঙীন,কত না উজ্জ্বল!

হিন্দোল ফিরলো সাড়ে পাঁচটায়, অদীনা তৈরী হয়েই ছিলো। হিন্দোল হাতমুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়েই ওকে নিয়ে চললো চাইনিজ-বাফেতে। প্রায়ই ওরা এই চাইনিজ রেস্তরাঁতে খায় সন্ধ্যায়। হেসে ওয়েটার মেয়েটি অভ্যর্থনা করে,নরম প্রাচ্যদেশীয় মুখে হসিটা ভরী মিষ্টি লাগে। এটি ছোটো একটি বাফে, পারিবারিক। বেশী ভীড় নেই, পরিবেশটি খুব শান্ত। অদীনা এখানে আসতেই ভালোবাসে। অ্যাকোয়ারিয়ামের কাছে টেবিলটিতে নিয়ে যত্ন করে বসিয়ে ওদের ঠান্ডা পানীয় দিয়ে যায় ওয়েট্রেস।

বাফেতে কত রকমের সুন্দর সুন্দর চাইনিজ খাবার,চিকেনের আর চিংড়ির দুখানা পদ আর একটু ফ্রায়েড রাইস নিজের প্লেটে তুলে নিয়ে অদীনা নিজের জায়গায় এসে বসে। অ্যাকোয়ারিয়ামটির মধ্যে লাল সোনালী মাছেরা আর হরেক সবুজ লতাপাতা, কৃত্রিম পাহাড় ইত্যাদি,জলবুদ্বুদ উঠছে আর উঠছে। দেয়ালে চাইনিজ উপকথার বাড়ীঘর,বাগান,গাছপালা,নৌকা,পাখি,রাজকুমারীর দল আঁকা। ভারী সুন্দর সব।

খেতে খেতে আস্তে আস্তে কথা বলে হিন্দোল,অদীনা আস্তে আস্তে জবাব দিয়ে যায়। প্রতিটি মুহূর্ত হাত থেকে ঝরে ঝরে পড়ে যাচ্ছে,বুকের মধ্যে ব্যথা করে অদীনার। কেজানে কেন! ওকে সুখী করতে হিন্দোল এত করছে,আর ও শুধু মনের মধ্যে কুঁকড়ে যাচ্ছে। কেবলই মনে হয় কী যেন করার ছিলো! কে যেন ডেকেছিলো ওকে! কী যেন করা হচ্ছে না? আবছা আবছা এমন মনে পড়ে কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা, কী সেই আরব্ধ কাজ যা তার তনুমনপ্রাণহৃদয় এমন করে ভরে দেবে যে আর এতটুকু শূন্যতা কোথাও থাকবে না, এতটুকু সময়ের ফাঁক থাকবে না, যেখানে বসে উতলা হাওয়ার বাদল দিনের কথা মনে পড়ে বা দখিন হাওয়ায় আকুল ভুলে যাওয়া বসন্তদিন মনে পড়ে।

বাড়ী ফিরে অনেকক্ষণ অদীনা হিন্দোল একসাথে। টিভিতে ভালো একটা ডকুমেন্টারি দেখাচ্ছিলো মিশরের পিরামিডের উপরে। দেখতে দেখতে রাত বাড়ে। ক্লান্ত অদীনা ক্লান্ত হিন্দোলকে শুভরাত্রি জানিয়ে নিজের ঘরে এসে পড়ে।

*******

রোহিতাশ্ব আজ আগন্তুক যুবতীকে দেখে এতটুকু বিচলিত হন নি, তিনি প্রস্তুত ছিলেন, উন্মুখ ছিলেন দেখা হবার জন্য। রোহিতাশ্ব আর আগন্তুক যুবতী মুখোমুখি দুখানা কুশাসনে বসে গল্প করেন, মাঝখানে জ্বলে শান্ত প্রদীপশিখাটি। রোহিতাশ্ব জানতে পারেন যুবতীর নাম নীরা, সে এসেছে অন্য সময়ের পৃথিবী থেকে। অন্য সময়ের পৃথিবী কথাটা অত্যন্ত অদ্ভুত শোনালেও এই নিয়ে প্রশ্ন তুলে স্বপ্নজাত মুহূর্তের মতন আশ্চর্য এই দেখাশোনা বন্ধ করে দিতে চান না রোহিতাশ্ব, তাই এই বিষয়ে কিছুই প্রশ্ন করেন না।

নীরা কথাটার সঙ্গে সদানীরার এত মিল, সদানীরাকে জনান্তিকে মাঝে মাঝে নীরা বলেই তো ডাকতেন রোহিত! রোহিতের মনে হয় তার তীব্র ইচ্ছাশক্তি ও সদানীরাকে ফিরে পাবার আকাংখা এই স্বপ্নসম্ভবাকে সৃষ্টি করেছে, অন্য সময় বা অন্য জগৎ যা বলছে মেয়েটি, তা হয়তো এই স্বপ্নজগৎ। মুগ্ধ ও আচ্ছন্ন হয়ে কথা বলে যান রোহিতাশ্ব, সদানীরার কথা, শ্রুতি স্মৃতির কথা, ভেষজগ্রন্থের কথা, কালান্তক মহামারীর কাহিনি, সেই মহামারী থেকে মানুষকে বাঁচানোর কাহিনি---এইসব বলতে বলতেই তীব্র আকুল আত্মগ্লানিতে ভরে যায় রোহিতাশ্বের মন, ভেঙে পড়েন বলতে বলতে। নীরাকে বলেন, নিজে চিকিৎসক হয়েও সদানীরাকে আরোগ্য করতে পারেন নি বলে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবেন না। নীরা সান্ত্বনা দেয়, কিন্তু রোহিতাশ্ব বিমর্ষ হয়ে থাকেন।

নীরা রোহিতের হাত ধরে বাতায়নের কাছে নিয়ে গিয়ে বলে, "রোহিতাশ্ব, বাইরে যাবেন? আকাশের নীচে দাঁড়ালে মন অনেক হাল্কা লাগে, দুঃখ চলে যায়। যাবেন?"

রোহিত মন্ত্রমুগ্ধের মতন মাথা নাড়েন, নীরা তার হাত ধরে বাইরে নিয়ে যায়। আকাশভরা তারা ফুটফুট করছে, বিশাল এ দিগন্তকিনারে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত নক্ষত্রালোকে অলৌকিক তরুণীর আশ্চর্য উপস্থিতির দিকে তাকিয়ে রোহিতের মনটা আশায় একুল ওকুল ভরে টলটল করতে থাকে।মনে হয় ঊর্ধের ঐ ঈশ্বর যদি করুণা করে এই স্বপ্নমানবীকে বাস্তব করে দেন! যদি এই নীরা সদানীরা হয়ে রোহিতের আর্ত শুষ্ক দগ্ধ জীবনকে প্লাবিত করে!

অদ্ভুত গলায় নীরা এইসময় বলে ওঠে,"রোহিতাশ্ব, আমি ভবিষ্যতের মানুষ। আমার কাছে যা অতীত ইতিহাস, আপনার কাছে তা এখনো ঘটেনি। আপনি এই আশ্চর্য ঘটনার সুযোগ নিতে চান না? জানতে চান না কী ঘটবে ভবিষ্যতে?"

রোহিত অবাক কিছুক্ষণ। চুপ করে চেয়ে থাকেন নীরার মুখের দিকে।কী বলবেন ভেবে পান না। উদগ্র আগ্রহী গলায় নীরা বলে,"বলুন রোহিতাশ্ব। জানতে চান না কেমন করে নানা যুদ্ধ-হত্যা-মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানুষ একদিন ঊর্ধের ঐ শূন্যলোক বিজয় করবে? তারা থেকে তারায় ছুটে যাবে শূন্যযানে? জানতে চান না? ঐ চাঁদ,যা আকাশে দেখে মুগ্ধ হন,সেই চাঁদে একদিন গিয়ে দাঁড়াবে এই পৃথিবীর মানুষ? জানতে চান না সমুদ্রের জলের তলা দিয়ে চলবে মানুষের জাহাজ? জানতে চান না মুহূর্তে যোগাযোগ হবে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে? বলুন,জানতে চান আপনি রোহিত?"

অবাক রোহিত ক্ষীণ দুর্বল গলায় আস্তে আস্তে আস্তে বলেন,"এইটুকু জীবন আমার, সামান্য, ক্ষণায়ুশাসিত। ক্লান্ত, ক্লিষ্ট, ভাগ্যবিপর্যয়ে ন্যুব্জ। নিকট অতীত আর নিকট ভবিষ্যতে মোড়া বর্তমানের চলিষ্ণু পল অনুপল শুধু ধরতে পারি এই আর্ত হৃদয়ে। এর বাইরে মহাপৃথিবী আর মহাসময়কে ধরতে পারি এমন শক্তি কোথায় আমার?"

নীরার গলায় অচেনা সম্ভ্রম ফুটে ওঠে, বলে "আপনি কবি।এমন সুন্দর করে কথা বলেন! আপনিই যোগ্যতম ভবিষ্যতের ঘটনাবলী লিখনে। বলুন, আপনি লিখবেন?"

রোহিতাশ্ব ভাবেন, কী অদ্ভুৎ! তিনি যোগ্যতম মহাসময়ের পদচিহ্ন আঁকতে? এই তিনি এই সামান্য মানব, যার নিজেরই হৃদয় ভেঙে গেছে একটিমাত্র প্রিয়জনের অকাল বিদায়ে? এ তার নিজের স্বপ্ন নয় তো কি? স্বপ্নে ছাড়া এরকম কেউ সত্যি শুনতে পায় নাকি?

কিন্তু আপত্তিও করেন না, নীরার সঙ্গে ঘরে ফিরে আসেন, কুশাসানে বসে ভুর্জপত্র খুলে হংসপালকের কলম দোয়াতে ডুবিয়ে তুলে মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাকান রোহিতাশ্ব, বলেন, "বলুন দেবী, কী লিখবো?"

(চলবে)

Monday, November 11, 2013

উৎস-পৃথিবী(2)

রাত্রিশেষের হাওয়ায় কেঁপে উঠলেন রোহিতাশ্ব। বাতায়নপথে চেয়ে দেখলেন অরণ্যশীর্ষে ঢলে পড়েছে কৃষ্ণপক্ষের ক্ষীণ চাঁদ। হেমন্ত শেষ হয়ে এলো, রিক্ত ধানক্ষেতে হু হু করে বেড়ায় হাওয়া।

রোহিতাশ্ব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁসের পালকের কলমটি নামালেন। উঠে দাঁড়ালেন, উত্তরীয়টা একটু ভালো করে জড়ালেন। বাতায়নবর্তী হয়ে দৃষ্টি মেলে দিলেন দূরে। ক্ষীণ জ্যোৎস্না আর কুয়াশা মিশে আদিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত অদ্ভুত অলীক দেখাচ্ছে। যেন অপার্থিব!

পাঁচ বছর হয়ে গেল। এইরকম এক হেমন্তে সদানীরা ছেড়ে গেছে তাকে। শ্রুতি আর স্মৃতি --এই দুই যমজ কন্যাকে রেখে। ওরা তখন তিন বছরের শিশু। কে ভেবেছিল ঐভাবে মাত্র তিনদিনের অসুখে পূর্ণযুবতী সদানীরা এই অনেক ভালোবাসার সংসার সন্তান স্বপ্ন -সব ছেড়ে চলে যাবে? এই সন্তান দুটি জখন গর্ভে এলো তখন কী তীব্র আনন্দে জ্বলজ্বলে হয়ে উঠছিল সদানীরা, এরা যখন জন্মালো তখন তাদের কী সুখ, কী অনাস্বাদিত বাৎসল্যের প্রথম অমৃত অনুভূতি! এইসব হঠাৎ করে ছেড়ে দিয়ে তাকে এত নির্মমভাবে একা করে দিয়ে চলে গেল নীরা!

রোহিতাশ্ব পাশের ঘরে ভেজানো দরজাটার দিকে তাকান, তারপরে আস্তে আস্তে সেদিকে যান, দরজা আস্তে করে ঠেলা দিতেই খুলে যায়। ঘরে ঢোকেন। মেয়ে দুটি ওদের ঠাকুমার পাশ ঘেঁষে শুয়ে আছে বিছানায়। তিনজনেই ওরা গভীর ঘুমে মগ্ন, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দোময় শব্দ শোনা যায়। ঘুমের মধ্যে শ্রুতি পাশ ফেরে, গায়ের চাদর খানিকটা সরে যায়, এলোমেলো ফুরফুরে রেশমীচুলে ঘেরা কচিমুখটি দেখা যায়, পাতলা রাঙা ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁক, কচি দু'খানা দাঁত দেখা যাচ্ছে। রোহিতাশ্বের বুকের ভিতরে ছলছল করে, আস্তে করে পাশে বসে মেয়ের গায়ের চাদর ঠিক করে দেন। ঘুমের মধ্যে আদর করতে নেই, নইলে ওর কপালে একটা চুমু খেতে খুব ইচ্ছে করছিল রোহিতাশ্বের। মেয়ের কপালের থেকে চুলগুলো যত্ন করে সরিয়ে মাথায় হাত হাল্কা করে বুলিয়ে সরে এলেন তিনি। লোকে বলে শ্রুতি আর স্মৃতি ওদের মায়ের মুখ পেয়েছে, মায়ের চেহারা পেয়েছে।

রোহিতাশ্বকে নতুন স্ত্রী গ্রহণ করতে অনেকেই পরামর্শ দেন, এমনকি রোহিতাশ্বের মা ও। কিন্তু তিনি মনস্থির করতে পারেন না। হয়তো আর কিছু বছর পরে সত্যি করেই নতুন বিবাহ করতে হবে তাকে, কিন্তু এখন এই কচি মেয়ে দুটি সৎমায়ের হাতে পড়ুক, এ তিনি চান না। অনেকে বলে যে সব সৎ মা যে খারাপ হয়, তা কে বললো? কোনো কোনো সৎ মা এত ভালো হয় যে সতীনের সন্তানদের যত্ন করে নিজের সন্তানের মতন। কিন্তু রোহিতাশ্ব জানেন তেমন সৎ মা বিরল ব্যাপার।

মেয়েদের ঘর থেকে নিজের লেখার ঘরে ফিরে এলেন রোহিতাশ্ব, ফিরেই চমকে উঠে থমকে গেলেন। কুশাসনটির কাছে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবতী, আগে কখনো একে দেখেছেন বলে মনে করতে পারলেন না তিনি। এর পোষাক ও মুখ অদৃষ্টপূর্ব। মেয়েটি শান্ত মুখে কৌতূহলী দৃষ্টি তুলে চেয়ে আছে রোহিতাশ্বের দিকে। এ কী আশ্চর্য কান্ড! জাদু নাকি অন্যকিছু? ইনি কে? কোথা থেকে এলেন? স্বর্গ থেকে আসা কোনো দেবদূতী?

রোহিতাশ্ব নিজের জায়্গায় অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, গলা শুকিয়ে আসছে তৃষ্ণা। চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে। যুবতী এক পা এগিয়ে এসে খুব কষ্ট করে করে শব্দ মনে করে করে কথা বলার মতন করে বলল, "আপনি রোহিতাশ্ব, না? প্রসিদ্ধ ভিষক? বর্তমানে আয়ুর্বেদ সম্পর্কে গ্রন্থ লিখছেন? "

রোহিতাশ্ব কিছু বলতে পারলেন না, দেখলেন মেয়েটির মুখে সদানীরার মুখ জ্বলজ্বল করছে। তিনি অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন ভূমিতে।

স্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠে অদীনা। এই স্বপন সে দেখছে বেশ কিছুদিন। ডক্টর হপকিন্সের কাছে সে গিয়েছিল হিন্দোলের সঙ্গে, ডাক্তার ভদ্রলোক আগেও ওর চিকিৎসা করেছেন। নতুন নতুন সমস্যাগুলো সব শুনে তিনি কিছু ওষুধ দিলেন আর রিল্যাক্স করার কিছু টেকনিক শেখালেন। দিনে একবার আর রাত্রে আরেকবার মনকে সম্পূর্ণ চিন্তাশূন্য করে দেহকে শিথিল করে ফেলতে হবে। এখন হিন্দোল আর অদীনার শোবার ঘর আলাদা, অদীনাকে কোনোভাবে ডিস্ট্র্যাক্ট করা চলবে না বলে ডাক্তারের পরামর্শেই হিন্দোল এই ব্যবস্থা করেছে।

দেহমন শিথিল করে মনকে চিন্তামুক্ত করার চেষ্টায় প্রথম কিছুদিন একেবারেই সাফল্য পায়নি অদীনা। যত মনকে চিন্তাশূন্য করতে যায় তত দেওয়ালির সময়ের শ্যামাপোকার মতন পিল পিল করে চিন্তাভাবনা, সুখ দুঃখের স্মৃতি সব উড়ে আসে। জটলা পাকায়, সব ঘুলিয়ে দেয়। বেশ কিছুদিনের প্রবল চেষ্টার পরে এখন অদীনা মনকে চিন্তাশূন্য করে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। আর ঘুমোলে সে ধারাবাহিকভাবে রোহিতাশ্বের জীবনের ঘটনাক্রম দেখতে পায়, একদম জীবন্ত স্বপ্ন, স্পষ্ট সব দেখতে পায় সে।

ঘুম ভেঙে সে খুব অবাক হয় প্রতিবারই। কে রোহিতাশ্ব? কেন সে তাকে স্বপ্নে দেখে? গতজন্ম সে বিশ্বাস করে না সচেতনভাবে, তাই এটাকে বিগত কোনো জন্মের কথাও সে ভাবতে পারছে না। তাহলে এর ব্যখ্যা কী? হয়তো ডক্টর হপকিন্স কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। কিন্তু অদীনা ঠিক করতে পারছে না সে কীভাবে ডাক্তারকে এসব বলবে অথবা আদৌ বলবে কিনা! ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়ে অদীনা।

সকালে ওকে ডেকে তোলে হিন্দোল, হাতে গরম ধোঁয়াওঠা সাদা টার্কিশ তোয়ালে। অদীনার হাতে সেটা দেয় হিন্দোল, অদীনা গরম তোয়ালে মুখের উপরে হাল্কা চেপে ধরে ঘুম থেকে বেরিয়ে আসে, এই গরম ভাপটুকু আর কোমল স্পর্শটুকু ভারী আরামদায়ক। তারপরে মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে একেবারে স্নান সেরে বেরোবে অদীনা। হিন্দোলের আগেই সেসব হয়ে গেছে, সে তখন ব্রেকফাস্ট বানায়।

অদীনার ভালো লাগে এই যত্ন, আবার মাঝে মাঝে কেমন অপরাধী অপরাধী মনে হয় নিজেকে। যেন দাম না দিয়ে এত যত্ন চুরি করে নিচ্ছে সে। অদীনার এমন কী আছে যে এইভাবে জীবনপাত করে ওকে যত্ন করছে হিন্দোল? নিজের সম্পর্কে উদাসীন অদীনার চোখে পড়ে না আয়নার ভিতরের সুন্দরী যুবতীর দিকে, তার বুদ্ধিদীপ্ত জ্বলজ্বলে চোখের দিকে, সুন্দর পদ্মকলির মতন আঙুলগুলোর দিকে, রেশমের ঝর্ণার মতন একঢাল সুন্দর চুলের দিকে। আনমনে গুনগুন করতে করতে স্নান করে অদীনা, ফেনা করে সাবান মাখে, চুলে শ্যাম্পু ঘষে আস্তে আস্তে, শাওয়ারের জলধারার নিচে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে ভারী আরামে ভাবতে থাকে স্বপ্নে দেখা যমজ মেয়ে দুটির কথা। আহা, মাত্র তিন বছর বয়স থেকে ওরা মা ছাড়া। কী হলো ওদের তারপরে? ঠিক যেন একটা ধারাবাহিক গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়েছে অদীনা।

(চলবে)

Friday, November 8, 2013

উৎস-পৃথিবী(1)

অদীনা চুপ করে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে থাকে। বাইরে রোদ-ঝকমকে নিঃশব্দ দুপুর। চেয়ে থাকতে থাকতে তার মনে পড়ে অনেক অনেক আগের এমন এক দুপুরবেলা। মনে পড়ে নানা শব্দ। দুপুরজাগা রোদ্দুরের মধ্যে মিশে থাকতো সেইসব প্রিয় শব্দমালা। "হরে-এ-এ- ক মাল পাঁচসিকা"র ফেরিওয়ালা, "শিল খোটাও" ওলা, টিন আর লোহা ওয়ালার শব্দ। আরো থাকতো নিঃশব্দ কাগজকুড়ানি মেয়ে, যার রুখু বাদামীচুলে খেলা করতো শুকনো শীতহাওয়া।

উলের ডিজাইনের মতন গালওলা সাদা থান পরা বুড়ী, চুলগুলো পাকা, সঙ্গে কচি একটি পুঁচকে মেয়ে,সজনে গাছের ছায়ায় মাদুর--বুড়ী আর কুচোয় পাশাপাশি শুয়ে আছে। বুড়ী গল্প করে টুয়াইয়ের, সাতভাই আর তাদের একমাত্র বোন টুয়াই। সাতভাই বাণিজ্যে যায়, টুয়াই কী করে? সত্যি তো, টুয়াই তারপরে কী করলো?

হারিয়ে গেছে শব্দেরা,ফেরিওয়ালার ম্যাজিকঝুড়ি। রুখু দুপুরে বুড়ী ফেরিওয়ালা ডাকলে ঐ ঢাকনিটা সরালেই যে ঝুড়ির ভিতর থেকে উঁকি দিতো টিপ,মালা, চুড়ি,পুতুল, খেলনা কত কী। সে ফেরিওয়ালা একা একা একা একা মিশে গেছে কুয়াশায়। হয়তো সে এখনো কোনো দূরের গ্রহে অমনি আমকাঁঠালের ছায়ার পাশ দিয়ে হাঁক দেয় "হরে-এ-এ-এক মাল পাঁচসিকা।" গোলাপীমুখ বাচ্চারা ছুটে আসে, সঙ্গে আসে বুড়ী দিদা। এপারে মেয়েটির ঠোঁট ফুলে ওঠে, অভিমানে।

এইখানে দৃশ্য বদলে যায়। স্মৃতির পর্দায় অদীনা দেখতে পায় ভূপেনকে। ভূপেন তখন সদ্য কলেজ পাশ করা ছোকরাটি, নিজের গ্রামে ফিরে খুবই স্মৃতিকাতর। সে গ্রাম তখন অন্য দেশ, তবু সব চেনাজানা জায়গা,অনেক চেনামুখ। ভূপেন তার পুরানো স্কুলে দেখা করতে গেল। তাকে পেয়ে পুরানো শিক্ষক খুব খুশি, বললেন, "দ্যাখো ভূপেন, ধর্মের ক্লাস হয় এখন এখানে, সকলকে পরস্পরের ধর্ম জানানোর জন্য, তো ইসলাম ধর্মের ক্লাস তো আরেকজন নেয়,তুমি বরং কদিন হিন্দু ধর্মের ক্লাস নাও।"

ভূপেনের দিব্যি লাগলো, হিন্দুমুসলিম পাশাপাশিই ছিলো, কিন্তু পরস্পরের ধর্ম সম্পর্কে বিশেষ জানতো না। এরকম একটা মিউচুয়াল ব্যাপার হলে খুবই ভালো। ভূপেন মহাভারতের গল্প পড়াতে আরম্ভ করলো। তো একদিন প্রশ্ন করেছে, "বলো তো মহাভারতের সেই বিরাট যুদ্ধ কোথায় হয়েছিলো?"

একজন ছাত্র পড়িমড়ি করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে " জানি সার জানি সার। ক্রুদ্ধক্ষেত্রের যুদ্ধ! " ক্লাসজুড়ে তুমুল হাসির হররা।

সব গুলিয়ে যাচ্ছে অদীনার, কেন যে গুলিয়ে যাচ্ছে কে জানে। কোথা থেকে কোথায়,কোন্‌ শুকনো দুপুর থেকে কোন্‌ নদীতীরের জল-ছলছল কাহিনিতে!

টেবিলজুড়ে রোল খুলে মেলে দেওয়া ম্যাপের দাগগুলোর উপরে হাত বোলায় অদীনা, হাতে আলাদা লাগে না তো,দাগও লাগে না,কিন্তু চোখে দেখা যায় দাগ,তেড়াবেঁকা সোজা লম্বা পাথালি লাইন আর লাইন। সীমান্ত। কাঁটাতার। কই? হাতে ফুটে গেলো? অনেকদিন আগের সূচ ফুটে যাওয়া চিহ্নে এখনো বাদামী দাগ,শুকিয়ে গেছে কবে,তবু দাগখানা রয়ে গেছে। মিছিমিছি দাগ,মিছিমিছি। টেবিল ছেড়ে সে চলে যায় খাটে,সেলাই করতে বসে ছেঁড়া কামিজ, খচাং করে সূচ বেঁধে,রক্তবিন্দুটা ঠিক জ্বলজ্বলে একটা ক্ষুদ্র চুনীর মতো লাগে ল্যাম্পের নীচে। ব্যথা। আগুনলাগার মতন জ্বালাকরে আঙুলটায়, চুনীসমেত আঙুলডগা মুখে ঢুকিয়ে দেয় অদীনা।

ভর সন্ধেবেলার বুড়ীর গল্প, তাদের ছেড়ে আসা দেশের গল্প, নদী, মাঠ, ভাঁটফুল,পানের বরজ, বরজে বাঘ, নদীতে জোয়ারভাঁটা, খলখল করে স্রোতের জলে স্নান। কুমীরে ধরার আগেই উঠে বৌ দুটির উঠে পড়া ঘাট থেকে,পিছে কুমীরের জল তোলপাড়, এক বৌ আরেককে কয়, "ভাগ্যে তোমার তাড়াতাড়ি ছিলো হইরার মা, না হইলে আজ কী হইতো!"

এমনি সব গল্প, ঝাঁকে ঝাঁকে চারামাছ নদীতে বর্ষায়,লোকে গোটা দলটাকে ধরে ফেলছে, ছোটো মেয়েটির কি কান্না,ওদের মায়ের কষ্ট হবে ওদের মায়ের কষ্ট হবে। জেলে জেলেনীরা শুনে হাসে, তাদের চকচকে কালো চোখে আর রোদেপোড়ামুখে সস্নেহ হাসি, পৃথিবীর সুখ ও দুঃখ তাদের চেনা, অভিঘাতগুলো পুরানো হয়ে গেছে। নতুন কুঁড়িটি এখনো চেনে না সেসব, তারা ব্যস্ত হয় না, একদিন ঠিক হয়ে যাবে সবই।

দু'খানা অদ্ভুৎ শব্দ করা মাছ সারারাত ক্যাঁকর ক্যাঁকর করছে ডুলায়, বালিকা পা টিপে টিপে ওঠে উঁকি মেরে দ্যাখে। কচ্ছপের বিরাট খোলায় রাখা জল,যেন চৌবাচ্চা,সেই জলে পা ধুয়ে ছেলেপুলে দাওয়ায় উঠলো।

নদীপারের গাঁটিতে ফিরেছে গাঁয়ের মেয়ে, নাইয়র এসেছে, সঙ্গে ছোট্টো তার বছর চারেকের মেয়েটি। বিকালে যাত্রাপালা হচ্ছে, প্রহ্লাদের গল্প। দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর ছেলে প্রহলাদ। দৈত্যরাজ হরির নাম শুনলে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন, এদিকে তার ছেলে প্রহলাদ দারুণ হরিভক্ত। রাজা বহু চেষ্টায় ছেলেকে বাগে আনতে না পেরে অবশেষে তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছেন। বিষ খাওয়ানো, হাতী দিয়ে মাড়ানোর চেষ্টা, জলে ফেলা, আগুনে দেয়া কিছুতেই কিছু হয় না! ভীষণ উত্তেজক গল্প, অভিনয় চলছে, চোখ বড়ো বড়ো করে কচি মেয়েটা দেখছে। যখন রাজার নির্দেশে রাজপুত্তুর প্রহ্লাদকে কাটতে গেছে জল্লাদ , মেয়েটা তখন আর থাকতে না পেরে চিৎকার করে উঠেছে," টুনিমামাগো, দাওডা( দা'টা ) ধরেন।" দর্শকের মধ্যে হাসির হররা পড়ে গেলো।

তারপর? সময় বয়ে যায় নদীর ধারা যেন। ছলছলে নদীটির পারের গ্রামটি থেকে দল বেঁধে মানুষ চলে যাচ্ছে, পাড়া কে পাড়া ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। জামাকাপড়ের গাঁটরি তাদের কাঁধে, শিশুদের হাত ধরা বড়োদের শিরাতোলা কেজো হাতে। কোথায় যেন কোন্‌ স্টীমার ঘাটা, কোন্‌ চেনা স্রোত ছেড়ে কোন্‌ অচেনা ঘাটের দিকে যাযাবর মানুষের দলের চলে যাওয়া।

সোনালী রূপালী মেঘালী রোদালী এমনি সব গল্প,ছিন্নমূল মানুষের দেশ খুঁজে বেড়াবার গল্প, স্বপ্নের মধ্যে নীলকন্ঠ পাখিটি ওড়ে আর ওড়ে!

গল্পের মধ্যে বারে বারে অদ্ভুৎ এক ঝড়ের গন্ধ এসে পড়ে,আশ্বিনের ঝড়, যেই ঝড়ে বাড়ীঘর পড়ে গেছিলো ওদের, গোটা গ্রামে একটি দুটি ছাড়া খাড়া বাড়ী ছিলো না। বাড়ীর তিনজন লোক,কাকা আর দুই দাদা নদীতে, গ্রামের আরো কত লোক নদীতে, নৌকায়, কখন ওরা ফিরবে, কি হলো ওদের,ঘাটে দাঁড়িয়ে গলা উঁচু করে করে দ্যাখে বৌরামায়েরামেয়েরা--- গোটা গ্রামে অজস্র গাছ উৎপাটিত, রাস্তা গাছে ভর্তি।

লোকে ধারালো দা হাতে গাছ কাটতে কাটতে পথ করে নিয়ে যাচ্ছে ঘাটে, পরদিন ঝকমকে রোদ,লোকে ভেজা সব শুকিয়ে নিচ্ছে, গ্রামের একটিমাত্র খাড়া বাড়ীটিতে,বাড়ীটি ধনীবাড়ী,পাকা দালান, সেখান থেকে সকলের জন্য খাবার দেওয়া হচ্ছে। বেলায় খবর এলো দাদারা আর কাকা ফিরছে। বাড়ীঘর পড়ে গেছে দেখে কাকার কি আফশোস, "আমি থাকলে দাঁতে কামড়াইয়া বাড়ী খাড়া রাখতাম!"

তারপরে ওরা তাদের নদীতে ঝড়ের অভিজ্ঞতার কথা বলে, কেমন একটা ছোটো সরু খাঁড়ির মধ্যে নৌকা ঢুকিয়ে খোলা নদীতে ঝড়ের হাতে পড়া থেকে বেঁচেছিলো, কেমন হাতের কাছে যা পেয়েছে যে তাই দিয়ে জল সেঁচেছে।

কাগজপত্র বের করে সবার বয়স হিসেব করা হলো, যাতে মনে থাকে ছাব্বিশ সনের ঝড়ের সময় বয়স কতো ছিলো। সার্টিফিকেট ইত্যাদির তো বালাই নেই কারুর,ঐভাবেই লোকে হিসেব রাখে। অদীনার মনে পড়ে যায় সেই মঙ্গোপার্কের আফ্রিকা ভ্রমণ, সেখানে লোকে বছরের হিসাব রাখে বড়ো বড়ো ঘটনা দিয়ে, অমুক যুদ্ধের বছর,তমুক ঝড়ের বছর। সাদা লোক আসবার বছর।

দেশকালের তুমুল দূরত্বে, নির্জন কোনো এক গ্রীষ্মসন্ধ্যার বিরল অবসরে, রক্তলাল আকাশের দিকে চেয়ে মনে হয় এই এত সাংঘাতিক যান্ত্রিক সমাজেও হয়তো ঐভাবে ছাড়া আসলে অন্য কোনোভাবেই সময়ের হিসেব রাখা যায় না। সহস্র বিস্মৃতির ঘোলা জলের একাকারতার মধ্যে হঠাৎ বিঁধে যাওয়া অন্যরকমের কিছু মোচড় না থাকলে কেমন করে আলাদা করা যায় কোন্‌টা আগে, কোন্‌টা পরে? আজ থেকে সহস্র বৎসর পরে আমাদের এই সময়কে এই বিরাট বিরাট গোটা গোটা দশ কি কুড়ি কি তিরিশ প্রজন্মকে হয়তো তারা বলবে অ্যাটম ভাঙার যুগ!!! বা অন্য কিছু! ক'জন মানুষের মুখ বেঁচে থাকবে ইতিহাসে,এই কোটি কোটি মানুষের মধ্যে? যার মুখ বেঁচে থাকবে সেও কি সত্যি সত্যি একটা মানুষ? অনেক মানুষের সুপারইম্পোজিশান নয়? একজন করে কি কোনোদিন থাকতে পারে?

যে আর্কিমিদিসকে আমরা চিনি ইতিহাসের ধূলা সরিয়ে,সেই বৃদ্ধ জ্ঞানী কি আসলে সত্যি সত্যি সমুদ্রতীরে বালিখেলা সেই মানুষটি? যে ইমহোটেপকে আমরা চিনি আরো আরো অনেক গভীর দূরে,ইজিপ্টের অনেক গপ্পোকথা লেজেন্ড মিথের ধূলা সরিয়ে, সে কি একটা মানুষ? যে সলোমনকে খুঁজে পাই বাইবেলে, সেও কি একজন মাত্র? যে গৌতমবুদ্ধকে পাই, সেই কি মাত্র একজন?

আফ্রিকার গ্রামের সেই সরল শিশুবৃদ্ধযুবকদের সহজ বিশ্বাসে চমকে ওঠে অদীনা বিস্ময়ে ,কোথায় কতদূরের বাংলার গ্রামের বিশ্বাসের সঙ্গে তার মিল দেখে চমকে ওঠে এই অর্বাচীন অতিথিবিশ্বে, এইখানেও হয়তো অমনি বিশ্বাস ছিলো, অমনি সহজ সরল প্রকৃতিসাযুজ্যে এই কালোবাদামীপৃথুলশীর্ণেরা হয়তো মিলে ছিলো একদিন। কিন্তু কে বলবে সেসব? তারা তো আর নেই। ধবল কুয়াশার মতো মিলিয়ে গেছে কোথায়। মিলিয়ে গেছে তাঁদের স্মৃতি গল্পকথা বিশ্বাস ধর্ম ভালোবাসা ঘৃণা সব সব। একদিন ইতিহসের চক্রাবর্তে হয়তো স্বপ্নের মতো দেখা দেবে আবার, খুঁড়ে খুঁড়ে ধূলা সরিয়ে তাদের উদ্ধার করবে পুনর্জাতরা।

জলে ভেজা শ্রান্ত পথিক শ্বেতাঙ্গ লোকটি আশ্রয় পেয়েছিলো গ্রামের কালো মা ও মেয়ের কুটিরে। তারা তাঁকে শুকনো কাপড় দিয়ে,খাবার তৈরী করতে করতে গান গাইছিলো,"ঝড় বইছে বৃষ্টি পড়ছে আর বেচারা সাদা লোকটি শ্রান্ত অবশ হয়ে আমাদের উঠানের গাছতলায় বসেছে। ওর যে মা নেই, ওকে দুধ এনে দেবে কে? ওর যে স্ত্রী নেই,ওকে ময়দা পিষে দেবে কে? আহা বেচারা সাদা লোকটিকে দয়া করো।"

ঐ আদিম গ্রামের আদিবাসীরা এই প্রেমধর্ম কোথা থেকে পেলো? এমন সহজ সরল নিঃশ্বাসের মতন?

ঘূর্নীধূলির মতন এরপরে এসে পড়লো সভ্যতা,মেরে কেটে শেষ করলো সব, এ কেমন সভ্যতা? যারা মরে গেলো,তারা কি গেলোই ? এক্কেবারেই গেলো? কোথাও কি রইলো না আর? কোনো সন্ধেবেলার ভুতের গল্পে? কোনো জনারের ক্ষেতের গল্পে? কোনো উপকথায়?

কোথায় তারা? মরুপার হয়ে চলে যাচ্ছে জলের কলসী কাঁখে ঠোঁট ফোলানো গাঢ় বাদামী ঐ তরুণী,কে সে? ও ই কি ওর সবল বাদামী হাতে গড়েছিলো উচ্চশীর্ষ প্রস্তরমন্দির? ঐ কি ছিলো বিদেশী জাহাজে উঠে পড়া অ্যাডভেঞ্চারেস? ও ই নিজের হাতে নিজের শিশুদের গলা টিপে মুক্তি দিয়েছিলো? ও ই কি শরবনের মধ্যে পাওয়া অন্য বিদেশী জাতের শিশুটিকে প্রতিপালন করেছিলো যে কথা বলতে শিখে ওকে মা বলতো?

ও ই কি অমরত্বের বাসনায় নীল সাপটি তুলে নিলো উষ্ণবুকের উপরে? হৃদপিন্ডের এত কাছে যে কিছুতেই যাতে মিস না হয়ে যায় বিষ! মরুকুয়াশায় বিলীন হয়ে যাওয়া হাজার হাজার স্মৃতির মধ্য থেকে অকলঙ্ক অক্ষয় হয়ে চক্রাবর্তের মতন ফিরে ফিরে এলো সেই মন্দিরের অলীক মুহূর্ত?

ওরই চিকন শ্যামলবরণ রাজা কি একদিন হারিয়ে গেলো মরুতে? সঙ্গে হারিয়ে গেলো সব গান, সব সুর, সব আলো? ছিঁড়ে যাওয়া নদী, কুটি কুটি ভূমিখন্ড, আটকে পড়া জল, পানা শ্যাওলা, দাম দলঘাস--- সে কোথায় খুঁজে পাবে সেই প্রিয়কে আবার? কোন্‌ কলার মান্দাসে ভেসে ভেসে সে আবার যাবে কোন্‌ নেতাধোপানীর ঘাটে? যেখান থেকে পাওয়া গেল স্বর্গপথের খোঁজ? সেই পথ দিয়ে ফিরে আসে কি ভুলে যাওয়া প্রিয়তম? কিন্তু, কোথায়? কই? সে তো কবে থেকে ভেলা বেয়ে চলছেই চলছেই ! কোথাও গিয়ে তো পৌঁছায় না!

"অদীনা, অদীনা " হিন্দোল ডাকছে ওর কাঁধে হাত রেখে, সে মুখে তুললো। উদ্বিগ্ন হয়ে চেয়ে আছে হিন্দোল, "কী হয়েছে অদীনা? কতক্ষণ ধরে ডাকছিলাম ওঘর থেকে,শুনতে পাও নি?"

অদীনা ঘোর কাটিয়ে বর্তমানে ল্যান্ড করার প্রবল চেষ্টায় অস্থির বোধ করে, কী করে হিন্দোলকে বলবে? কী করে বোঝাবে? এ কি কথায় বোঝাবার মতন কিছু? মুহূর্তে কি করে পার হয়ে আসবে এত এত সময়খন্ড,এত বিপুল দেশ, এত বিরাট ঢেউ?

হিন্দোল অদীনাকে জড়িয়ে ধরে টেনে তোলে, বলে,"চলো, যাবে না? রেডি হও নি কেন এখনো? আজকে যে বিতান-বৃতি রা নেমন্তন্ন করেছে,যাবে না? "

ভুলে যাওয়া ভাষা মনে করার মতন ঠোক্কর খেয়ে খেয়ে অদীনা বলে,"হ্যাঁ হ্যাঁ, চুড়িদারটা ...একজায়গায় একটু সেলাই খুলে গেছে... ঐখানটা রিফু করছিলাম... হাতে সূচ ফুটে গেল।" হাসে অদীনা, লাল ছোটো ক্ষতবিন্দু হাতের আঙুলের ডগায়,হিন্দোল নিজের হাতে ওর হাত নিয়ে দেখে।

হিন্দোল বলে, "শাড়ী পরো না! চুড়িদার তো পরোই। আজকে শাড়ী পরো, চন্দন রঙের সিল্ক শাড়ী, জড়িপাড়, ঐটা।"

অদীনা সম্মত হয়ে চলে যায়।

******



"বাতাসের পাতলা স্তর সরাতে সরাতে / বেরিয়ে পড়ে জল আর জল/ তারও নীচে, অনেক নীচে মাটি।

আকাশের ময়দানে নীল তুলো ফুঁড়ে,/সোনালী স্বপ্ন ঘষা দূরে /হোমা পাখি-ছানাদের পা হাঁটি হাঁটি।

মেঘ তুলো জল হাওয়া পার হতে হতে/ম্যাজিকের দেশ জুড়ে রাত/রূপশালী ধান আর কুশ কুটিকাটি।"

শীতল ভয়ের একটা স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নীচ থেকে উপরে উঠে আসে অদীনার। মনে হয় অসংখ্য আরশোলা শুঁড় নেড়ে ঘুরছে সারা মেঝে জুড়ে, উড়তে শুরু করলো, একটা, দুটো তারপরে অসংখ্য। সব ঢেকে যাচ্ছে বাদামী রঙে। আরশোলা নাকি পঙ্গপাল? পঙ্গপাল এসেছিলো একবার অদীনার ছোটোবেলা তাদের গাঁয়ে, সূর্য ঢেকে গেছিলো তাদের পাখায়,বিরাট মেঘের মতন এসে পড়েছিলো ক্ষেতের উপরে,সব সবুজ সাফ করে দিয়েছিলো কয়েক ঘন্টায়।

স্বপ্নঘুমজল ছিঁড়ে ঘামে ভিজে উঠে পড়ে অদীনা। বসে থাকে বিছানায় উঠে,গলা শুকিয়ে কাঠ,ঘামে ভিজে যাচ্ছে সর্বাঙ্গ, ঘামে রাতপোশাক সেঁটে গেছে গলায় পিঠে। স্বপ্নে ও চিৎকার করেছিলো গলা চিরে, কিন্তু একটুও শব্দ হয় নি, পাশে হিন্দোল এখনো গভীর সুষুপ্তিতে। ঐ আর্ত চিৎকারের শব্দ বাইরে এলে এই রাত্রির শান্তি ছিঁড়ে খুঁড়ে একাকার হয়ে যেতো।

কাঁচের জানলার বাইরে আকাশ, ঝিমুনো চাঁদ, হাল্কা হাওয়া, গাছের ডাল,সাদা প্যাঁচা সব একই আছে।

অদীনা চুপ করে বসে থাকে বিছানায়, নামতেও পারবে না এখন। আরেকটু ধাতস্থ না হয়ে। এখনো মনে হচ্ছে মেঝে জুড়ে কিলবিল করছে অসংখ্য আরশোলা। সেই অল্প ফাট ধরা সিমেন্টের মেঝে তাদের, সেই পুরানো বাড়ী, বারান্দার বাইরে কমলজবার ঝাড়। আরেকটু দূরে সন্ধ্যামলতী,লাল সাদা হলদে রঙের। একটা বুলবুলি বাসা করেছিলো সেই ঝাড়ে।

ওহ, সেতো বহুকাল আগের গল্প, তখন অদীনা সাত কি আট। কেন মেঝেটাকে বর্তমানে দেখতে পায় না অদীনা? পুরো শোবার ঘরটাই নরম গোলাপী কার্পেটে ঢাকা, হিন্দোলের এই রঙ পছন্দ বলে ওরা ঐ হাল্কা গোলাপী রঙের কাগজ নিয়ে গেছিলো বাজারে,রঙ মিলিয়ে কিনেছিলো। আগে এখানে হাল্কা ক্রীম রঙের কার্পেট ছিলো ঘরগুলোতে,সে রঙও তো ভালোই লাগতো অদীনার, কিন্তু হিন্দোল ছেলেমানুষের মতন বায়না করে বললো গোলাপী করতে হবে। তাই গোলাপী।

হিন্দোলের মাথার চুলগুলোর উপরে আলতো হাত রাখে অদীনা, কী ছেলেমানুষ, কী ভালো, কী সরল ছেলেটা! অদীনার চোখে জল আসে, ও কি ঠকাচ্ছে হিন্দোলকে? কতকিছুই তো হিন্দোলকে বলেনি, এখনো বলে না। অথচ হিন্দোল ওকে সবটুকু দিয়ে ভালোবাসে। সত্যি কি? কতদিনই বা চেনে ও হিন্দোলকে? মাত্র বছর খানেকের প্রেমের পরেই একসঙ্গে থাকতে শুরু করেছিলো, সেও হয়ে গেলো দু'বছর প্রায়। বিয়ে করার কথা ভাবে নি, বিয়ে তো শুধু রিচুয়াল, আসল তো মন!

সেই মন কি পুরোটা খুলে দেখাতে পেরেছে ও? এত জল এত জল, খুলে দিলে ভেসে যাবে হিন্দোল, ডুবে যাবে।ভয় হয় অদীনার। তাই ঐ অশ্রুসমুদ্র গোপণ করে রেখেছে বুকের ভিতরে। সঙ্গে গোপণ করেছে সব কাঁটাগুলিও। কিন্তু আজকে বড্ড কাঁদতে ইচ্ছে করছে অদীনার, সব চেপে রাখা কান্না, শৈশবের ভয় পাওয়া কান্না, প্রথম কিশোরীবেলার অভিমান,শত শত দুঃখের বুটি বুটি জল উঠে আসে,সব কিছু ভাসিয়ে দিয়ে, ডুবিয়ে দিয়ে শেষ কান্না প্রাণ ভরে কেঁদে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু হিন্দোল? ওকে ও ছেড়ে যাবে?

উপুড় হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে দেয় অদীনা, না না, জয় করতে হবে এই দুর্বলতা, দুর্লভ মানবজীবন, একে মাঝপথে শেষ করে দেওয়া অপরাধ, এতখানি পথ পার হয়ে এসে এখন এভাবে .... ঐ তো দুয়ারে মলিনমুখ রাজভিখারী, সেতো শুধু এসে দাঁড়িয়ে থাকে,কিছু বলে না, হাতও বাড়ায় না,পাতে না অঞ্জলি, শুধু ঐ অপরূপ করুণ দু'খানা চোখ মেলে অদীনার দিকে তাকিয়ে থাকে।

অদীনা জানে,ও কী চায়।ও চায় সর্বস্বধন। ও চায় সেই স্বপ্ন যা তিলে তিলে অসহ্য বেদনার পুলকে রূপ পায়।যার কিছু থাকে সম্মুখে বাস্তবে আঁকা, কিছু থাকে অনুভবে, যার কিছুটা বোঝা যায় কিছুটা যায় না। ওকে তো কবেই অদীনা বলেছিলো পণ তার জীবনসর্বস্ব। কিন্তু সে বলেছে জীবন তুচ্ছ,সবাই দিতে পারে। হায়, আর কী আছে ওগো রাজা? আর কী তুমি চাও এই দীনহীনা ভিখারিনীর কাছে?

আকাশ জুড়ে ফুটে ওঠে সোনালী ধূমকেতু, বিশাল তার উজ্জ্বল লেজ কালো আকাশে ছড়ানো, হাল্কা লেজের মধ্য দিয়ে ওপাশের তারাদের দেখা যায়। অদীনার স্বপ্নেই শুধু আছে এই ধূমকেতু, আলোক দূষণ পার হয়ে ওর চোখ সেদিন খুঁজে পায় নি ভবঘুরে জ্যোতিষ্কটিকে। তবু সে চোখ বুজে দেখতে পায় দীর্ঘকেশ এক পুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন আকাশের পটভূমিতে, বাইরে নীলপ্রভ আকাশের ব্যাকগ্রাউন্ডে শুধু সুগঠন সিলুয়েটটি দেখা যায়। মুখ দেখা যায় না,চোখ দেখা যায় না। শুধু দেখা যায় তাঁর অলক্ষ্য হাতে তারার রাখী।

হাল্কা ভয়ের সঙ্গে অচেনা সুখে কাঁপতে কাঁপতে নিজে মুখ হিন্দোলের রেশমী চুলের মধ্যে গুঁজে দেয় অদীনা। ঘুমের ঘোরে পাশ ফেরে হিন্দোল, হাত বাড়িয়ে অদীনারা গলা কোমল করে জড়িয়ে ধরে ঘুমের থেকে বেরিয়ে আসে। আস্তে করে বলে, "অদীন, কী হলো? ভয় লাগছে নাকি? আবার ভয়ে স্বপ্ন দেখেছ?"

অদীনা বলে, "না না, সেরকম কিছু না। হঠাৎ কেন জানি ঘুমে ভেঙে গেল। কেমন অসোয়াস্তি হল।"

চোখ পুরো খুলে হিন্দোল বলে, "কালকে তোমায় ডক্টর হপকিন্সের কাছে নিয়ে যাবোই। বুঝলে? আর কোনো অজুহাত শুনছি না। এখনো তোমার আরশোলা ভয় যায় নি। এটা না সারালে হবে না, শুধু শুধু রোগ পুষে রাখা কোনো কাজের কথা না। "

অদীনা কুঁকড়ে যায় হিন্দোলের হাতের নিচে, হিন্দোল তাহলে ওকে সত্যি করেই অসুস্থ মনে করে? আজকে ঘুমের মধ্যে কন্ট্রোল নেই, মুখ ফসকে বলে ফেলেছে। অন্যসময় তো বলে মেডিকেল কন্ডিশন, পার্সোনালিটি ট্রেইট! আজকে জানা গেল সত্যিটা।

বুকের মধ্যেটায় তীক্ষ্ণ ব্যথা টের পায় অদীনা, দু'চোখে উষ্ণ জল ভরে ওঠে। কিন্তু সে সেই জল ঝরতে দেয় না, চোখের জল চোখের ভিতরে ফিরে দেয়। খুব সাবধানে হিন্দোলের হাত ছাড়িয়ে নিজের মাথা নিয়ে আসে নিজের বালিশের উপরে, আহ, কেন সে শুধু শু ওকে বিরক্ত করতে গেল! এখন তো সত্যিই আর ভয় করছে না! এখন তো মেঝেটা গোলাপী কার্পেটে মোড়াই লাগছে। তাহলে তখন কেন--

না, এই মিছিমিছি ভয়কে জয় করতেই হবে, ঠিকই বলে হিন্দোল, ভালো ভেবেই বলে। নাহ, কাল সে যাবে ডক্টর হপকিন্সের কাছে, সব খুলে বলবে।

চোখে বোজে অদীনা, আহ, শিথিল হয়ে আসছে দেহ, এখন ঘন ঘুমের আঠায় জুড়ে যাবে সব। শান্তি শান্তি শান্তি।

আধোঘুমে হিন্দোলের মুখ সে অনুভব করে সিঁথির উপরে, সে বলছে, "রাগ করলে অদীন? উঁ? রাগ করলে? আমি কিছু ভেবে বলিনি, এমনি বলেছি। অসুখ না, অসুখ কেন হবে? কিন্তু তুমি কষ্ট পাচ্ছ, তা থেকে সেরে উঠবে।"

অদীনা সায় দিয়ে বলে, "হ্যাঁ, যাবো কালকে। এখন ঘুমাই? এখন আর ভয় করছে না, এখন ঘুম পাচ্ছে। ঘুমাই, হিন্দোল?"

আস্তে আস্তে হিন্দোল বিলি কেটে দেয় অদীনার মাথার রেশমী নরম চুলে। অদীনা ডুবে যেতে থাকে ঘুমের জলে। ডুবে যেতে থাকে অবর্ণনীয় সুখের অনুভূতির মধ্যেও।

(চলবে)

Saturday, November 2, 2013

উৎস-সমুদ্র

১। সমুদ্রের তীর ধরে হেঁটে যাই, গভীর নীল ঢেউয়ে জ্বলজ্বল করে কীসের যেন দীপ্তি। আর, আবহসঙ্গীতের মতন অবিরল ঢেউপতনের শব্দ। আসে আর যায়, ওঠে আর পড়ে। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতন, বিরতি নেই, ক্লান্তি নেই, অনন্ত কাল উঠছে আর পড়ছে।

বাতিঘরের আলো এসে পড়ে চোখে, দূরে বাঁকের কাছে মিনারের মতন বাতিঘর। নগ্ন নির্জন একটি উত্তোলিত হাতের মতন আকাশে উঁচিয়ে আছে, মুঠোতে আলো। আলো ঘুরে যায়, দূর সমুদ্রের জল আলোকিত হয়ে উঠে, চকমকে আলো দূর থেকে দূরে কুয়াশা হয়ে মিলিয়ে যায়। কাছের ডুবো পাহাড়টি কালচে স্তূপের মতন দেখায় রাত্রির রহস্যভরা আলোয়। অথচ এই শিলাটি দিনের বেলায় কত অন্যরকম। সবুজ একটি পাহাড়, বর্ষার জলে সবুজতর। ছোটো কুন্ডে খেলা করে রঙীন মাছেরা। কত লতাপল্লব, কত শঙ্খকঙ্কণ।

বাতিঘরের আলো আরো ঘোরে আরো দূরের দিকে আলো ফেলে, এইবারে এদিকে শুধু নক্ষত্রের আলো। আবিল আলোর চেয়ে একদম অন্যরকম, শুদ্ধ পরমজ্যোতির মতন, তিরতিরে রহস্যময়।

অগভীর জলে নেমে পড়ে হেঁটে যাই সবুজে ঢাকা শিলাটির দিকে, ওখানে যেন কিছু আছে, কিছু আহ্বান, কিছু নির্দেশ। খালি পা জলের ছোঁয়া পেয়ে খুশী হয়ে ওঠে, সে খুশী উঠে আসে মেরুশিরা বেয়ে উপরে। সালোয়ারের পায়ের গোছের কাছটা ভিজে গেলো। আহা, ও তো কত তৃষ্ণার্ত ছিলো এতক্ষণ! শিরশিরে জল শ্যাওলা জলজলতা সাবধানে পেরিয়ে আসি। এইবারে চড়াই বেয়ে উপরে উঠতে হবে।

উঠতে উঠতে একটু হাঁপ ধরে, নিঃশ্বাস ঘনতর হয়, ঢালে গা এলিয়ে বসে পড়ি। তাড়া তো নেই কিছু। অদ্ভুত একটা অনুভূতি উঠে আসে তলপেট থেকে। সেখানে হাত রাখি, তিরতিরে কম্পন। সে এখন ঐ জলের মাছেদের মতন ছোট্টো, অমনই প্রায় দেখতেও। ওর লেজের ছোট্টো ছোট্টো খুশি-খুশি ঝাপটা আমাকে বিস্মৃত বহু বহু পূর্ব জন্মে নিয়ে যায়।

তীক্ষ্ণ শিসধ্বনির মতন সজোর শক্তিশালী শব্দ তরঙ্গের আহবান এসে লাগতো মহাসমুদ্রের বিশাল বিস্তার পেরিয়ে। পৃথিবীজোড়া যোগাযোগব্যবস্থা ছিলো আমাদের, এইসব ছোট্টো ছোট্টো চিপভরা সেলফোন আর মস্ত মস্ত উঁচু টাওয়ার তৈরীর বহু বহু যুগ আগেই। হাতডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে সাঁতরে যেতাম, ঠিক ও যেদিক থেকে আসতো তার উল্টোদিকে। এ খেলাটা আমাদের খুব পছন্দের ছিলো। ওর মসৃণ সুন্দর গা আর মিটমিটে দু'খানা চোখ...

আমরা সাঁতরাতে সাঁতরাতে পার হয়ে যাচ্ছিলাম ছায়াবৃত্ত, দিন থেকে রাত্রির মধ্যে ঢুকে পড়ছিলাম। সন্ধ্যার সমুদ্রজোড়া অগণিত তিমিদের গান। অদ্ভুৎ সংকেতধ্বনির মতন। তীক্ষ্ণ অথচ কী সুরময়!

সে কাছিয়ে এসেছিলো আরেকটু, ঘন হয়ে সাঁতরাতে সাঁতরাতে সহসা ঠোক্কর লাগিয়েছিলো হাতডানার নীচে। আরো ঘন রাত্রির মধ্যে ঢুকে যেতে যেতে সন্ধ্যাভ্রচ্ছটা মিলিয়ে এলো, আকাশ জুড়ে তারাদের জ্যোতি আবেষ্টনীর মধ্যে অর্ধনিদ্রামগ্ন দুখানা জলচর জীব আমরা সাঁতরাচ্ছিলাম, ক্রমে আমাদের গতি ধীর থেকে ধীরতর হয়ে গেছিলো।

ঘুমেলা রাত্রি সমুদ্র কিন্তু অক্লান্ত গান গেয়ে যাচ্ছিলো, যেমন গায়। তীব্র আবেশে আমরা ঘন হচ্ছিলাম, ভেসে যেতে যেতে।

২। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম এবারে, বিশ্রাম নেওয়া হয়ে গেছে। এইবারে উঠতে পারবো মনে হচ্ছে। উঠতে উঠতে আরো আরো দূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি। ঘূর্ণমান বাতিঘরের আলো এসে পড়ছে চোখ মুখ ও চুলের অন্ধকারে।

পায়ের গোছের কাছ থেকে শিরশিরে একটা পুলকবেদনা উঠে আসে। সামনে অল্প ঝুঁকে পড়ে উঠতে থাকি আস্তে আস্তে। উপমের গলা শুনতে পাই, অল্প রাগী অল্প খুশি বেশ কিছুটা উদ্ধত গলার স্বর উপমের। শেষ কবে শুনেছিলাম? মাসখানেক আগে? ও ফোন করেছিলো ওর নেভাল বেস থেকে। খুব সকাল ছিলো তখন। সারা পাড়া ঘুমিয়ে। আমিও বিছানা ছাড়িনি তখনো। বালিশের পাশে সেলফোনটা সুন্দর সুরে ডেকেছিলো। ঐ রিঙ-টোন উপমেরই পছন্দ।

আহ, কেন এখানে এসেছি এই এত রাতে? কেন রাতসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে? আমি নিজে নাকি ঐ ভেতরের ও আমাকে টেনে আনে এখানে? উপম যখন কাছে ছিলো, দু'জনে আসতাম প্রত্যেক বিকেলে। হাত ধরাধরি করে উঠতাম বাচ্চা বাচ্চা দু'খানা ছেলেমেয়ের মতন। উপরে পৌঁছে আমাদের খোলা গলার হাসি সমুদ্রবাতাসে উড়ে যেতো সূর্যাস্তলোকের দিকে, ঐ দূর পশ্চিমে যেখানে সমুদ্র রাঙা হয়ে থাকতো সন্ধ্যারঙে।

সহসা উপমের জন্য মনকেমন করতে থাকে। কিন্তু ওকে ফোন করা যাবে না, বারণ। কেবল ওই ফোন করতে পারে আমায়। কী করছে এখন উপম? প্রচন্ড রোদে ছোটাছুটি করে কাজ করছে? কাজের ফাঁকে কফি খাচ্ছে? আমার কথা ভাবছে? ওর সময়ের সঙ্গে আমার সময়ের প্রায় ঘন্টা এগারোর তফাৎ।

সময়ের কথা ভাবতেই আবার বসে পড়ি, এবারে একটা অবশ করা ক্লান্তি আমার দেহ ঢেকে দিতে থাকে। খুব ঘুম পাচ্ছে, প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। হঠাৎ কী হলো?

ঘুরে যায় দিন ও রাত্রি, গ্রীষ্ম শীত, নক্ষত্ররাশি পাক খায় খগোলকে। প্রতিদিন প্রতিরাতে একটু একটু করে সরে যায়।বদলে যায় ঋতু।কাল মাপার পথ দেখিয়ে দেয়। নইলে ... নইলে কেমন করেই বা বুঝতাম পেরিয়ে গেলো মাস, যদি না ভরভরন্ত চাঁদ বারে বারে ক্ষয়ে গিয়ে বারে বারে পূর্ণ হতো? সূর্য সরে না যেতো রাশি থেকে রাশিতে? প্রচেতা নক্ষত্রধারা কল্প থেকে কল্পান্তে নতুন ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলে না উঠতো? পর্যাবৃত্ত গতি না থাকলে সময়ের কী অর্থ হতো?

কেমন করে, কোন্‌ পথে এলাম এখানে? চোখ মেলে দেখেছিলাম এই আশ্চর্য অচেনা উপত্যকা! চারিদিকে সবুজনীলসাদা পাহাড়ের দল ঘিরে রেখেছে গোল উপত্যকাটি। একদিকে শুধু একটু ফাঁকা, ঘোর কালো গভীর গিরিখাত সেদিকে। বইছে ঘূর্ণীজল, আর রয়েছে প্রায় চিরস্থায়ী কুয়াশা সেখানে। ওদিকেই নাকি পৃথিবীর শেষ, তারপরে স্বর্গের দেবতাদের দেশ। উপত্যকাবাসী উপজাতিটির বাদামী রঙের মানুষগুলোর ঘোর বিশ্বাস এই। প্রতি বছর সুদিনের শুরুতে তাই দেবতাকে পশু উৎসর্গ করা হয় ঐ গিরিখাতে পশুগুলিকে ছেড়ে দিয়ে। ঘূর্ণীজল আর কুয়াশা পেরিয়ে একদিন নাকি ওরা পৌঁছে যাবে দেবতাদের কাছে।

উপজাতির মধ্যে মড়ক লেগেছে, শিশু-পুরুষ-মেয়েদের সংখ্যা কমে গেছে, বৃদ্ধা যাদুকরী দিলারা তাই খুব চিন্তিত। সে রোজ একটানা ক্লান্ত সাপখেলানো সুরে সমস্ত সন্ধ্যা ও রাত্রির অর্ধেক জুড়ে অদৃশ্য দেবতার কাছে প্রার্থনা জানায় যেন তিনি অনেক মানুষ পাঠান, জন্ম যেন মৃত্যুকে ছাপিয়ে যায়। মহামারীর কোনো ওষুধ কি পাওয়া যাবে না অরণ্যে? সে নিজে মরে যাবার আগেই কি কোনোভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে না? বহুকাল আগেও তো একবার লেগেছিলো মড়ক, কিন্তু পাওয়া গেলো জরিবুটি খুঁজে। নিজের নির্জন গিরিবাস থেকে উল্টোদিকের সবুজ পাহাড়টির দিকে তাকায় দিলারা, ওখানে সর্পযাদুকর তিহুক...

দিলারার জরাজীর্ণ জরায়ুতে নিঃশব্দে কেঁদে ওঠে না ফোঁটা কুঁড়িরা, দিলারা আর তিহুকের না জন্মানো শিশুরা... তারা হয়তো নিয়ে আসতে পারতো প্রতিষেধক, ঐ বোকা যাদুকর কিছুতেই হারিয়ে দিতে পারলো না দিলারাকে। এখন অর সময় নেই, তিহুক হয়তো এখন সত্যি সত্যি হারিয়ে দেবে দিলারাকে, কিন্তু দিলারা... তার প্লাবনজল শুকিয়ে গেছে কবে, পড়ে অছে ফুটিফাটা মাটি শুধু।

বড়ো হয়ে গেছে তার বেঁচে থাকা সন্তানেরা, গুনতি করা যায় না এত ছেলেমেয়ে, তাদের নিজেদের এখন ছেলেমেয়েভরা সংসার। হঠাৎ সেইসব কলকাকলিভরা সুখসংসারে কোথা থেকে এসে পড়েছে মৃত্যুর করাল ডানার অমোঘ ছায়া।

তিহুক কিন্তু একা, এত অজস্র বৎসর ধরে একা একা, কঠোর কুমার। কেন? কেন তিহুক আর কাউকে নিলো না?

দিলারা লঘু হস্তস্পর্শে চমকে ওঠে, পিছনে ফেরে, তারার আলোয় স্পষ্ট দেখতে পায় তীক্ষ্ণচক্ষু যাদুকরী, তার অগ্নিহীন গুহার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তিহুক। দিলারা উঠে দাঁড়ায়, বলে, " যাদুকর! কী বললো তোমার গণনা? পাওয়া যাবে জরিবুটি? ঠেকানো যাবে মড়ক?"

তিহুকের চোখ দু'খানা জ্বলজ্বল করে অন্ধকারে, লুব্ধক তারার আলোয়- ফিসফিস করে সে বলে, "কেন জিজ্ঞেস করছো দিলারা? এ জাত মরবে। নিঃশেষ হয়ে যাবে। পাপে ভরে গেছে এই দুনিয়া, এদের মরে যাওয়াই ভালো। তারপরে ফের নতুন সৃষ্টি..."

দিলারার গলা কাঁপে, "তিহুক! এসব কী বলছো? এরা সব মরে যাবে? আমার ছেলেমেয়েরা..."

তিহুক অত্যন্ত তিক্ত গলায় বলে, "স্বার্থপর মানুষ কেবল নিজেরটা বাঁচাতে চায়। কিন্তু ঈশ্বর সেকথা ভাবেন না। তার কী এসে যায় ক'টা মানুষ মরলে? "

"তিহুক! তুমি জানো ওষুধ। এই মহামারীর ওষুধ। জেনেও বলবে না কেন? "

দিলারা দু'হাতে মুখ ঢাকে। তিহুক এগিয়ে গিয়ে ওর বাহু চেপে ধরে নির্মম ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, "প্রতিশোধ! দিলারা, প্রতিশোধ!"

দিলারা শিথিল হয়ে গেছে তিহুকের স্পর্শে, এই প্রথম তিহুক ওকে সত্যি সত্যি স্পর্শ করেছে। তিহুকের বলিষ্ঠ দুটো হাতের মধ্যে নিষ্পেষিত হয়ে যাচ্ছে দিলারার শীর্ণ বাহুদ্বয়। দু'হাতে মুখ ঢেকে তিরতির করে কাঁপছে সে। সে শিহরিত হচ্ছে নিবিড় বেদনার পুলকে, বুকে তীব্র ব্যথা, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ও ফিরে যেতে চায় ওর তারুণ্যে ওর, প্রথম পুষ্পাঞ্জলি হারিয়ে গেছে সময়ের কোন্‌ আড়ালে, স্মৃতিতেও নেই কে প্রথম নিয়েছিলো ওকে। অথবা ও নিয়েছিলো কাকে। কিন্তু কেউ কেউ কেউ দিতে পারেনি এই অনুভূতি, কেউ না। মনে হলো যেন এতকাল পশুর মতন সঙ্গম করে গেছে সে, আরো অসংখ্য পশুর মতন অনুভূতিহীন। অথচ সে জানতো মানুষটি আছে কোথাও, কাছে অথবা দূরে। বড়ো দেরি হয়ে গেলো।

কম্পিত দু'হাতে তিহুকের গলা জড়িয়ে ধরে ওর মুখের কাছে মুখ এনে কাঁদতে কাঁদতে দিলারা বলে, "বোকা বোকা বোকা। প্রকান্ড একটা বোকা তুমি তিহুক। কেন কেন কেন তুমি সেদিন পরাজয় মেনে নিয়ে চলে গেলে? কেন ফিরে এলে না? কেন আর একবার বললে না?"

তৃষ্ণার্তের মতন দিলারার মুখে মুখ রাখে তিহুক। চোখ বন্ধ করে সুখের প্রতিটি পলাতক মুহূর্তকে স্মৃতিতে গেঁথে গেঁথে রাখে দিলারা। দু'হাতে শক্ত করে জড়িয়ে রাখে তিহুককে। তারপরে মুখ গুঁজে দেয় ওর বুকে, আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে ভিজিয়ে দিতে থাকে ওর বুক।

উপত্যকাঘেরা পাহাড়ের গিরিখাতে তখন প্রবেশ করছিলো বহিরাগতেরা। নতুন দেশের নতুন মানুষেরা। তাদের পরনে পশুচর্ম বা গাছের ছাল নয়, কাপড়! তাদের মুখ নরম, তাদের রঙ হাল্কা বাদামী, তাদের চুলে আলো ঠিকরে পড়ে।

সেই অদ্ভুত কালরাত্রির শেষে তিহুক পর্বতশৃঙ্গ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছিলো। ওর শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়ে যাবার পরে আর ওর একবিন্দু বাঁচার ইচ্ছে ছিলো না মৃত্যুভয়ভীত সেই উপত্যকায়।

দিলারা কিন্তু পারেনি, আশা তাকে সবলে পিছনে টেনে রাখলো। উড়ে যাওয়া শরীরের উপরে-নীচে নীল শূন্যতার সঙ্গমের অসহ্য রতিসুখের অতি কাছ থেকে ফিরে এলো দিলারা। দৃঢ়হস্ত আশা তার দুই কানে ফিসফিসিয়ে বলছিলো তখনো তার বাকী আছে জীবনের কিছু ঋণ।

চোখে মেললাম, ঘুমিয়ে গেছিলাম এই সমুদ্রশিলায়। দূরের বাতিঘর দূর সমুদ্রে আলো ফেলছে, ঐ পুবে কৃষ্ণপক্ষের খন্ডচন্দ্র উঠে আসছে। এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম? শিরশিরে নোনা সমুদ্রবাতাস মুখে ছোঁয়া দিয়ে গেলো।

উঠে এলাম চূড়ায়, অনেক দূর পর্যন্ত দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলাম, ঐ দিগন্তের আড়ালে কোথায় কতদূরে ফটফটে দিনের আলোয় হয়তো কাজে ব্যস্ত আমার উপম।

নোনতা অশ্রুতে ভরে গেলো চোখ। কেন ওকে কাছে পেতে এত ইচ্ছে করছে? আমার দু'খানা হাত অবলম্বহীন শ্বেতকপোতীর মতন খুঁজছে ওর হাতের উষ্ণ আশ্রয়নীড়!

উপরে তাকালাম, মাথার উপরে জ্বলজ্বল করছে চিত্রা তারা। এই তারাকে নাকি চীনদেশে বলে দীর্ঘ আয়ুর দেবতা। শাউ শিং। বনের মতন সবুজ পোশাক পরা একমুখ মেঘের মতন সাদা দাড়ি শাউশিংএর। মুখে লেগে আছে হাসি। ওঁর গল্পটি ভারী সুন্দর। জীবনদেবতা শাউশিং আর রাত্রিনীল পোশাক পরা মৃত্যুদেবতা পিতাউ পৃথিবীর সমস্ত জাতকজাতিকাদের জীবন নিয়ে দাবা খেলেন।সেই খেলার ফলাফল অনুযায়ী মানুষের আয়ু ঠিক হয়। একজন স্বল্পায়ু তরুণ একবার মৃত্যুর মাত্র কিছু দিন আগে বনে শিকার করতে গিয়ে পথ হারিয়ে গভীর অরণ্যে ক্রীড়ারত দুই বৃদ্ধের দেখা পান। তাঁরাই ছিলেন শাউশিং আর পিতাউ।তরুণের কাকুতি মিনতিতে গলে গিয়ে এনারা ওর আয়ু ১৯ থেকে উল্টিয়ে ৯১ করে দেন !

হঠাৎ একটা অদ্ভুত প্রশ্ন মনে জাগলো। আচ্ছা, যে আসছে সে কেমন হবে? সুন্দর? সুস্থসবল? দীর্ঘায়ু?

৩। গ্রীষ্মের চাঁদের আলোয় চকচক করছিলো আগন্তুকদের মুখ। চুল আর চোখ। বহুদূরের গ্রীষ্মদগ্ধ অনাবৃষ্টিপীড়িত তৃণভূমি থেকে সবুজতর ভূমির সন্ধানে ওরা এসে ঢুকেছিলো ঐ পাহাড়ের মালায় ঘেরা উপত্যকাটিতে। সঙ্গে ওদের অনেক পশু ছিলো, তৃণভোজী পালিত পশু,যারা ওদের খাদ্য ও আবরণ জোগায়। আর ছিলো পালিত কিছু মাংসাশী পশু যারা পাহারা দিয়ে রক্ষা করে পশুধন। হাতে ছিলো দীর্ঘ বর্শা, কাঁধে তীরভরা তূণ ও ধনুক। পরনে হাল্কা কাপড়।ওরা ছিলো সতর্ক ও সদাপ্রস্তুত। নিজেদের তাঁবু টাবু খাটিয়ে চারিদিকে আগুন জ্বেলে পাহারা বন্দোবস্ত করে তবে ওরা নিদ্রা গেল।

উপত্যকার মড়কলাগা হতাবশিষ্ট উপজাতিটি ওদের তেমন কোনো বাধাই দিতে পারেনি। ওদের কাছে ভালো ভালো ভেষজ ছিলো, মহামারীর প্রতিষেধক। ওরা রোগগ্রস্ত এই অসহায় মানুষদেরও চিকিৎসা করলো, ক্রীতদাস পাবে বলে।

উপত্যকাবাসী এদের বিশ্বাস ছিলো হাল্কা বাদামী উজ্জ্বলচক্ষু ঐ মানুষেরা আকাশ থেকে আসা মানুষ। নইলে ওদের মুখ এত নরম কেন? ওদের রঙ এত ফর্সা কেন? কেন ওদের কারু কারু চোখে আকাশের রঙ?

তাই মহামারী দূর করে ওরা যখন পুরোপুরি দখল নিয়ে বসেছে, শিশু পরিণতবয়স্ক নির্বিশেষে এদের প্রায় সকলকেই দাসদাসীতে পরিণত করেছে, অত্যাচার করে তীব্র জয়ের আনন্দ পয়েছে, তখনো এই সরল বিশ্বাসীরা ওদের আকাশের মানুষ ভেবে গেছে। চাবুক খেয়েও বিশ্বাসে চিড় ধরেনি, দু'হাত দিয়ে রক্ত মুছতে মুছতে নীরবে চলে গেছে কাজ করতে।

প্রথম স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিলো এক তীব্র গ্রীষ্মবেলায়, উপত্যকার গাঢ় বাদামী একটি তরুণ এক শীর্ণ বৃদ্ধকে প্রহারোদ্যত প্রভুর হাতের চাবুক কেড়ে নিয়ে বলেছিলো, "কেন মারছো বুড়ো মানুষকে? ও মরে যাবে মারলে। ওর বদলে আমায় মারো।"

কেড়ে নেওয়া চাবুকটা প্রভুর হাতে দিয়ে নিজের পিঠের অল্পছিন্ন আবরণ মুক্ত করে দিয়ে বলেছিলো, " এসো, শুরু করো। ও বেচারাকে ছেড়ে দাও।" ছেলেটার পিঠ শুকনো চাবুকদাগে ভর্তি ছিলো, কোনো কোনোটা আধাশুকনো।

অত্যন্ত অবাক হয়ে প্রভু জিজ্ঞেস করেছিলো," এই বুড়ো তোমার কেউ হয়, তোমার আত্মীয়? ওকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে মার খেতে চাইছো?"

ছেলেটা মাথা নেড়ে বললো, " না, আমার আত্মীয় না। না, তাই বা কীকরে বলি? আমাদেরই তো একজন।"

আর, বুড়ো মানুষটি যে শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে গেল, সে এত অবাক হয়েছিলো যে কোনো কথাই বলতে পারেনি, খুব অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো শুধু।

প্রভুর হাত থেকে খসে পড়ে গেছিলো চাবুকটা, ছেলেটার হাত ধরে সে বলেছিলো," তোমাকে রোজ দেখি কাজ করতে, কিন্তু তোমার নাম তো জানিনা। কী বলে ডাকবো?"

তরুণ এরকম আশাই করেনি, অবাক হয়ে বলেছিলো," আমার নাম? আমার নাম তিন্দুক। কিন্তু ফেলে দিলে যে ওটা! মারবে না?"

"না,না, তোমায়...কেন শুধু শুধু... কিছু দোষ নেই তো তোমার... কিছু মনে না করো যদি, আমার ঘরে আসবে? এই এত দুপুর, এত গরম, নিশ্চয় তেষ্টা পেয়েছে তোমার। জল আর একটু খাবার দেবো তোমায়। তোমার কথা একটু শুনবো, আসবে?"

তিন্দুক একটু হাসলো, বললো," চলো। আমার কথা কী আর শুনবে? কিছুই তেমন নেই। তবু চলো। সত্যি বড্ড তেষ্টা পেয়েছিলো।"

তিন্দুকের হাত ধরে প্রভু নিজের তাঁবুতে নিয়ে যান। জল আর মিষ্টি দেন। তিন্দুক আগে জলটুকু খেয়ে এমন করে ধন্যবাদ দেয় যে প্রভু বিস্মিত, এতটা সভ্য ব্যবহার যেন তিনি ক্রীতদাসের কাছ থেকে আশাই করেননি!

শান্তমুখ দুঃখী ছেলেটি তার ক্রীতদাস, এটা মনে হতেই কেমন যেন লাগে ওনার। "তিন্দুক, কে কে আছে তোমার বাড়ীতে?"

তিন্দুক মাথা নীচু করে থাকে, কিছু বলে না। হঠাৎ প্রভুর ঘাড়ের রোঁয়া খাড়া হয়ে ওঠে, এই ছেলেটা তার অধীনস্থ, একে তিনি এইবারে যা খুশী করতে পারেন এটা মনে হতেই।

তিনি ওর বাহুর কাছটা জোরে চেপে ধরে বলেন,"কথার উত্তর দাও না কেন? শাস্তি পেতে চাও?" অন্য হাতে চাবুক উঠে আসে।

চাবুক খেতে খেতে শিথিল হয়ে গড়িয়ে পড়ে যায় তিন্দুক, দুর্বল বিষন্ন গলায় বলে, "আমার কেউ নেই, একলা থাকি, তাই কিছু বলিনি। কী বলবো? মাঝে মাঝে তোমার লোকেরা খুব মারে, খুব বেশী কেটে গেলে বুড়ী দিলারার কাছে যাই। ও দয়া করে ওষুধ দেয়। তাড়াতাড়ি ঘা সেরে যায়, ওর ওষুধ ভালো।"

প্রভু ওকে ধরে তোলেন, "তোমার কেউ নেই? তোমার মা বাবা ভাই বোন?"

শুকনো গলায় তিন্দুক খাবি খেয়ে খেয়ে বলে," কেউ নেই। বাড়ীতে একলা গিয়ে পড়ে থাকি মেঝেতে, অন্যেরা বাড়ীতে গিয়ে খাবার পায়, আমি বাইরে থেকেই খেয়ে দেয়ে বাড়ী গিয়ে শুধু ঘুমাই। কতদিন কিছু খাইও না। এখানে মহামারী অসুখের সময় আমি অরণ্যে শিকারে গেছিলাম, ফিরে এসে ... ফিরে এসে দেখি সবাই .... ঘুমিয়ে গেছে একদম চিরদিনের জন্য।মাটি খুঁড়ে সমাধি দিয়েছিলাম।" তিন্দুক ডানহাত তুলে চোখ মোছে।

অত্যাচারী লোকটি তিন্দুকের কপালে হাত বুলিয়ে বলেন," আমি জানতাম না। তোমার কষ্ট হলো। মাফ করো। উত্তর দিচ্ছ না দেখে রাগ হলো। "

"না, ঠিক আছে। তাতে কী হয়েছে? " তিন্দুক কেমন অদ্ভুত অভিমানী গলায় বলে।

লোকটি তিন্দুককে জড়িয়ে ধরেন। বলেন, "আমার এখানে থাকো। কেউ নেই বললে তোমার। আমার এই এত তাঁবু, এত পশু, এত দাসদাসী, স্ত্রী আছেন বেশ ক'জন, কন্যারা আছে,কিন্তু কোনো ছেলে নেই আমার। তুমি থাকবে আমার সঙ্গে? তোমায় খুব ভালো লেগেছে আমার, তোমার খুব সাহস আর অনেক শক্তি। তোমার মনটি অতুলনীয়। এর আগে আমি কাউকে দেখিনি অন্যকে বাঁচানোর জন্য নিজেকে বিপন্ন করে। তুমি প্রথম।"

তিন্দুক কিন্তু কুঁকড়ে যায়, বলে," আমার আচার-বিচার যে অন্যরকম। তোমার এখানে থাকলে হয়তো তা পালন করা সম্ভব হবে না। তুমি হয়তো রেগে যাবে, ব্যঙ্গ করবে। আমি যে অসভ্য ক্রীতদাস, তাই আমার দূরে থাকাই তো ভালো।"

খুব ব্যথিত হয়ে প্রভু বললেন, "কেন ব্যঙ্গ করবো? তুমি স্বাধীনভাবে তোমার আচার-বিচার পালন করবে। "

কুঁকড়ে গিয়ে তিন্দুক বলে," তুমি যদি চাও, আমি কাজের পরে এসে তোমার সেবা করবো। কিন্তু সারারাত থাকতে বোলো না। জানি, তোমরা আমাদের অসভ্য বলো, আমাদের ভালো চোখে দেখো না। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমরা আর কারুর ক্ষতি করিনা।"

তিন্দুক কিছুতেই রাতে থাকতে রাজী হয় না। প্রভুও জোর করতে পারেন না, ভালোবেসে ফেলেছেন যে! তাকে কি আর জোর করা যায়?

৪। ঘুম ভেঙে গেল। সকালের নরম রাঙা আলো পড়েছে জানালা দিয়ে দেয়ালে। চৌকো আলোকিত অংশটায় কী যে খুশী!

টুং টুং করে বেজে ওঠে বালিশের পাশে রাখা মুঠাফোন, কানে তুলে নিই চট করে। ওপারে উপম! ও কীকরে জানলো কাল রাতে মনখারাপ করেছিলো ওর জন্য?

বেশ অনেকক্ষণ কথা হলো। ওর ছুটি পেতে আরো মাস পাঁচেক। ততদিনে নতুন মানুষটির পৃথিবীর আলো দেখার সময় হয়ে যাবে।

নদীর ধারার মতন বয়ে যায় কাল। আমাদের ঘড়িতে অবিরত টিকটিকটিক টিক.... ক্যালেন্ডারের পাতা উড়ে উড়ে ঋতু বদলে যেতে থাকে।

এখন অতদূর হাঁটতে রীতিমতন কষ্ট হয় এতখানি ভার নিয়ে। তবু প্রত্যেক বিকেলে না গিয়ে পারিনে। ছোট্টো ছোট্টো ধাক্কায় ভেতরের সে ঠেলতে থাকে আমায়। ও কী করে বোঝে? ও কি দেখতে পায় সমুদ্র? ওর অন্যরকম বিশ্বে ? কেমন সমুদ্রগর্জন শোনে ও?

কাপড় সরিয়ে হাত রাখি সাবধানে। তিরতির করছে। ওটা কি ওর হৃদপিন্ড? মুখ? হাতের মুঠি?

উপম এলো অবশেষে। এতদিনের তৃষ্ণায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমরা পরস্পরের উপরে। ওষ্ঠাধর ছিঁড়ে যেতে লাগলো তীব্র আগ্রাসী চুম্বনে, তীব্র কান্নার ঝড়ে বেসমাল হয়ে পড়লাম, বুকের উপরে ওর হাত চেপে রেখে কাঁদতে লাগলাম।

পেটের উপরে কান রেখে ঘুমিয়ে পড়লো বেচারা উপম। খুব খুব ক্লান্তি এসে গ্রাস করে ফেললো আমাকেও। গাঢ়তর পর্দার মতন ঢেকে দিলো চেতনা।

তিন্দুক আর রুশার বিবাহ। সে এক অদ্ভুত বিবাহ। তিন্দুক রুশাকে নিয়ে পালাচ্ছিলো। রুশা ওর বস্ত্রের মধ্যে লুকানো লৌহ অস্ত্র দিয়ে আঘাত করলো তিন্দুকের বুকে। রক্তে ভেসে যেতে যেতেও তিন্দুকের দৌড়ের গতি কমলো না।

অবশেষে পাহাড়ে পৌঁছে রুশাকে নামিয়ে তিন্দুক দু'হাত ভরে গোলা আবীরের মতন রক্ত রুশার সোনালী চুলে মাখিয়ে দিয়ে অচেতন হয়ে পড়ে গেলো। বাকশক্তিহীন হয়ে বসে রইলো রুশা। অস্তগামী চাঁদের আলোয় ওর নীল চোখে জল চকচক করে উঠলো।

সমুদ্রের ভীমকল্লোলে জেগে উঠলাম আমি আর উপম একই সঙ্গে। এমন ভয়াবহ গর্জন আগে আর শুনিনি। উপম আমাকে দুইবাহুতে তুলে নিয়ে বললো, "উর্বী, পালাতে হবে, সমুদ্র ছুটে আসছে। উঁচু জায়গায় ছুটে পালাতে হবে। এসব ডুবে যাবে এখনি।"

অর্ধ চেতনায় সমুদ্রদুলুনির মধ্যে ওর গলা জড়িয়ে রাখি দুই হাতে। ভেতরে অনুভব করি তীব্র ধাক্কা, সে ছটফট করছে। ভয়ে নাকি উত্তেজনায়?

আমরা উঁচু পাথুরে টিলায় এসে পৌঁছই। প্রলয় তরঙ্গ আছড়ে পড়ছে পাড়ে পাড়ে, দূর থেকে অদ্ভুত শব্দ সমষ্টি এসে পৌঁছচ্ছে ক্লান্ত চেতনায়।

টিলার সবচেয়ে উঁচু অংশে একটি শক্ত গুল্মের নীচে উপম শুইয়ে দিলো আমায়। নিজেও ক্লান্ত হয়ে এলিয়ে পড়লো পাশে।

দিলারার গুহায় সকাল হচ্ছে। রুশা আর তিন্দুক সেখানে পৌঁছেছে হাত ধরাধরি করে। তিন্দুকের চোখেমুখে ঝর্ণার জলের ঝাপটা দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছিলো রুশা। উদয়োন্মুখ ঊষার আলোয় গুহার বাইরে বেরিয়ে এসে দিলারা দেখলো রুশার টলটলে চোখে আকাশ। আকাশের কন্যা সে, ঐ দিগন্তকুহেলীর পারে একদিন নেমেছিলো পৃথিবীকে ভালোবেসে।

দু'জনকে বিবাহ দেবার সময় দিলারা রুশার মুখখানি দুইহাতে ধরে বলে, "তুমি সত্যি আকাশ থেকে এসেছ?"

রুশা মাথা নাড়ে, বলে, "না,না, দূরের দেশ থেকে।"

দিলারা বলে, "তাহলে তোমার চোখে কেন আকাশ? আমার চোখে তো নেই?"

রুশা অস্ফুটে কী যেন বললো, দিলারা শুনতে পায় না।

ঘুম ভেঙে গেলো। উপম নারকেল পেড়ে এনেছে টিলার ওধারের গাছ থেকে। পাথরের ফলা দিয়ে খোসা ছাড়িয়ে পাথরে ঠুকে ঠুকে ভেঙে জল দিলো মুখে। আহ, শান্তি। এত তৃষ্ণার্ত ছিলাম বুঝতে পারিনি।

চারিদিক জলে জলময়। মাঝেখানে দ্বীপের মতন একটু জায়গার উপরে আমরা দু'জন। পৃথিবী জুড়ে কী অবস্থা? কিছুই জানিনা, কোনো খবরই নেই।

পরস্পরের হাতে হাত রেখে শুয়ে থাকি দু'জন। সহসা জল ভাঙার শব্দ, সে বাইরে আসতে চাইছে। তীব্র যন্ত্রনায় দেহ ছিঁড়ে যেতে থাকে, দু'হাতে এত শক্ত করে উপমের হাত ধরি যে ওর হাত নীল হয়ে ওঠে। "উর্বী উর্বী, প্লীজ, বি স্টেডি। কোনো ভয় নেই। "

দিনের আলো মিলিয়ে আসে যন্ত্রনার প্রহরগুলির মধ্য দিয়ে যেতে যেতে। নিশ্চেতনার পর্দা এসে সন্ধ্যার মতো অবশ করে দেয়।

নদীর কিনারে দিলারার জটাবাঁধা চুল পলি মেখে জলে দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছে রুশা। ঝিনুক দিয়ে কেটে দিচ্ছে নখ। অবাক হয়ে দেখছে দিলারা, তার সম্মুখে আকাশের কন্যা! এত আলো ঐ আকাশনীল দু'চোখে।

"কেন আমায় সত্যি করে বলো না রুশা, তুমি কি আকাশ থেকে এসেছ? কেমন সে জায়গা?"

রুশা হাসে, সে দিলারাকে বিশ্বাস করাতে পারেনা।

"দিলারা তোমার চোখেও তো আকাশ! তুমি কি আকাশ থেকে এসেছ?"

বিষন্ন দুঃখীর মতন দিলারা বলে, "কই আমার চোখে আকাশ? আমার চোখ তো কালো, তোমার মতন নীল তো নয়!"

দৃশ্যটা মিলিয়ে যায়। তারপরে দেখি শেষরাত্রের অন্ধকারে ঘুমন্ত দিলারাকে ঠেলে তুলছে রুশা, "দিলারা, দিলারা, ওঠো ওঠো। "

-"কী হলো?" চমকে জেগে ওঠে দিলারা।

রুশা ওকে গুহার বাইরে এনে কোটি তারায় ভরা আকাশের নীচে দাঁড় করিয়ে বলে, "কে বলেছে তোমার চোখে আকাশ নেই? এবারে বলো তুমি কোথা থেকে এসেছ।"

দিলারা তারার আলোয় স্বপ্নকন্যার সম্মুখে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট অনুভব করে তার ও তিহুকের অনাগত শিশুরা খিলখিল করে খেলে বেড়াচ্ছে তিন্দুক রুশার উঠানে, তাদের চোখে টলটলে আকাশ।

মন্ত্র পড়ে রুশাকে সর্বস্ব সমর্পণ করে দিলারা ঘুমিয়ে পড়ে, তার কাজ শেষ হয়ে গেছে।

ভোররাত্রে নিশ্চেতনা কেটে যায়। তীব্র চিৎকারে আঁধার ভেদ করে বেরিয়ে আসে ভবিষ্যতের পৃথিবী, তার চোখে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে ওঠে আকাশ। ধবল দুগ্ধধারে ঢেকে যেতে থাকে পাথর, গুল্মকান্ড ও মাটি। সন্তানের তৃষ্ণার্ত মুখ এসে থামে দুগ্ধধারায়।

প্রলয় পরের পৃথিবীতে হে উপম, বহন করে নিয়ে যাও এই আত্মা, এই যুগাতীত রহস্য, এই কাল ভেদ করে আসা মৃত্যুঞ্জয়ী ধারা। উর্বীর ব্যবহৃত জড়দেহ শুয়ে থাক এখানেই, এই গুল্মছায়ায়, সমুদ্রকিনারের পাহাড়ে।

মধুর বাতাস প্রবাহিত হোক, সমুদ্র মধুক্ষরণ করুক, মধুর হোক পৃথিবীর ধূলি। রাত্রি মধুর হোক, মধুময়ী হোক সন্ধ্যা উষা.....

(শেষ)

Saturday, October 26, 2013

হেমন্তদিনের পথযাত্রা

সে অনেকদিন আগের কথা। আমাদের দীর্ঘ পথযাত্রা শুরু হয়েছিলো এক অক্টোবরের শেষদিনের দুপুরে। মোবাইলে আবার সব সবক'জনে মিলে "রোড ট্রিইইইইপ" বলে একজনকে শোনানো হচ্ছিলো আর উনি মোবাইলের মধ্য থেকে অভূতপূর্ব শব্দ শুনে হাসছিলেন।

যাইহোক, পালা করে চালানো হবে ঠিক হয়েছিলো আর যদ্দূর যাওয়া যায় গিয়ে গভীর রাতে কোনো সরাইয়ে ওঠার কথা ছিলো। হাজার মাইলের পথযাত্রা, একটানা তো সম্ভব না। থামতেই হবে। কিন্তু প্ল্যান অনুযায়ী কিছু হলো না, বিকালে এক ইটালিয়ান রেস্তরাঁয় খেতে থামা হলো, সেখানে বেশ অনেকটা সময় লেগে গেলো এক সঙ্গী একটু অসুস্থ হয়ে পড়ায়।

পরে রাত্রে গাড়ী চলছে, যিনি চালাচ্ছেন তার ঘুম এসে যাচ্ছে, পাশ দিয়ে দৈত্যের মতন সব ট্রাক... ভয়ে উদ্বেগে বাকীরা অস্থির। রাত একটায় থামা হলো পথের ধারের কম্ফর্ট ইন এ। দোতলায় দুই ঘর মিললো,সব কজনে দুই ঘরে ভাগ হয়ে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া, সকালে উঠে ফের নতুন করে পথে, হিট দ্য রোড এগেইন...

এসব দীর্ঘ যাত্রায় অডিও-বই খুব ভালো জিনিস, যন্ত্রের মধ্য থেকে শান্ত ধীরগতি গলাটি পড়ে যায় গল্প, শুনতে শুনতে চালাতে থাকে চালক, শুনতে থাকে অরোহীরা, পথের একঘেয়েমি কেটে যায়। সেই বেতালের গপ্পো শুনতে শুনতে রাজা বিক্রমের পথচলার মতন, তবে গল্পের শেষে প্রশ্ন নেই, এইটা অনেক সুবিধে।

বনপাহাড়ের ভিতর দিয়ে কেটে বেরিয়ে গেছে আন্তঃরাজ্যমহাসড়ক। চারিপাশে ছড়ানো হেমন্ত সৌন্দর্য্য। পাহাড়ের গা ভরে সমস্ত গাছপালার পাতাগুলো রঙীন হয়ে গেছে-লাল, বাদামী, কমলা, হলুদ-ঝরে যাবার আগে ওরা এত রঙীন হয়ে যায়, তারপরে গাছেরা ন্যাড়া বৈরাগী হয়ে যাবে গোটা শীতকালের জন্য, এ ক্ষণিক রাঙাবাস খসে যাবে ধারালো শীতবাতাসে, তারপরে নামবে তুষার। এখন এই অপূর্ব ফল-কালারের উপরে ঝলমল করছে হেমন্তের সোনালী রোদ,নেশা ধরানো সৌন্দর্য্য। মনে পড়ে যায় এই সময়েই তো আমার দেশে ধানের উপরে কোমল উজল রোদ ছড়িয়ে গেছে দূর কতদূর...

এরপরে তো ধান পাকবে, ধানকাটা হবে, তুলে আঁটি বেধে নিয়ে যাবে, গাঁয়ের পথ ভরে যাবে ধান্যসুবাসে...

দেখতে দেখতে পাহাড়নদীর পাশ দিয়ে ভুটাক্ষেতের দেশে চলে আসি আমরা। যে ছোট্টো শান্ত শহরটিতে আমরা অতিথি, সেখানে গিয়ে মুগ্ধ। বিশাল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সমস্ত গাছেরা ফল কালারে সেজেছে, অবর্ণনীয় সৌন্দর্য্য। ছবিতে এর শতাংশে একাংশও ফুটবে না, তবু ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক। বহমান সময়ধরাকে দু'হাতের অঞ্জলিতে একটুখানি ধরে রাখার চেষ্টা। চিরবৃদ্ধ অথচ চিরতরুণ কাল হাসে মানবশিশুদের ব্যর্থ এ চেষ্টা দেখে।

গিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেছিলো, হোস্ট ভদ্রলোক নিয়ে গেলেন ডিনারে। এঁরই ষাটতম জন্মদিন উপলক্ষ্যে কনফারেন্স, আয়োজন করছেন প্রাক্তন ছাত্রশিষ্যেরা।

ডিনারের জন্য বুক করা ছিলো ঝর্ণাধারার কাছ ঘেঁষে হোটেল, ঝর্ণার উপরে মুখ বাড়ানো একটি ঘর, চারিধারে স্বচ্ছ কাঁচ আবরণী ঘেরা, সেখানেই আয়েশ করে বসে অতিথিদের খাদ্যপানীয়ের ব্যবস্থা।তখন সূর্য পশ্চিমে একদম দিগন্তে ঢলে গেছে, আলো আঁধারি জলধারার উঁচু পাড়ির উপরে একটি গাছ হেমন্তে সোনালী হয়ে যাওয়া পত্রসম্ভার নিয়ে ঝরঝর করে কাঁপছে সন্ধ্যার বাতাসে---কী অপূর্ব অনুভবী দৃশ্য। পৃথিবী কী আশ্চর্য সুন্দরী! ঋতুতে ঋতুতে প্রহরে প্রহরে কী অপরূপ তার সাজবদল রঙবদল সুরভিবদল সুরবদল। অবন ঠাকুরের ছবিকলমখানি থাকলে হয়তো বর্ণনা করতে পারতাম, কিন্তু আমার ছবিহীন এই রুখু কলমে সে বর্ণনা অসম্ভব।

তবু কেন লিখি? কেন এই অস্থির আকাঙ্ক্ষা? মনে হয় আকাশ-বাতাস জল-পাহাড়-গাছপালা-মানুষজন সব কিছু নিয়ে সমস্ত দৃশ্যখানি নকশীকাঁথার মতন মুড়ে উপহার পাঠিয়ে দিই সেই প্রিয়জনকে যে প্রান্তটুকু ছুঁয়েই বুঝে ফেলবে গোটাগুটি সবটাই, যা দেখা যায় তাও যা না দেখা যায় তাও-যা কিছু রয়েছে আঁকা আর যা কিছু পাওয়া গেলো অনুভবে-তার এতটুকুও বাদ যাবে না ওর বুঝতে। কিন্তু সেতো হবার নয়, এ যে জলচারী মীনের আকাশ ছোঁয়ার সাধ! তাই বুঝি দেখতে গিয়ে সব ঝাপসা হয়ে যায় নোনতা অশ্রুতে?

দু'দিন থাকা হলো সেখানে, সদ্যপরিচিত মানুষগুলোর আন্তরিক আতিথেয়তা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। পৃথিবীতে কত ঋণ থেকে যায়, কোনো কোনো ঋণে ঋণী থেকেই সুখ। "তুমি যে তুমিই ওগো, সেই তব ঋণ..."

ফেরার পথ আবার সেই অপরূপ সৌন্দর্য্যের মধ্য দিয়ে-পথে বেরুলেই কেমন একটা লাগে, বোধহয় সেই বিস্মৃত পূর্বজদের যাযাবর রক্ত বুকের মধ্যে কোলাহল করে ওঠে, সেই যে এক কবি বলেছিলো- "তারাই যথার্থ যাত্রী যারা চলে যায়

কেবল যাবারই জন্য-

হাল্কা মন, বেলুনের মতন

নিশিত নিয়তি ফেলে একবার ফিরে না তাকায়

কেন তা জানে না,তবু চলো চলো বলে অবিরত

তাদের বাসনা পায় মেঘপুঞ্জে উজ্জ্বল বিন্যাস

স্বপ্নে হানা দিয়ে যায় সৈনিকেরে যেমন কামান

অপরিবর্তনীয় দেশ, মহাশূন্যে ইন্দ্রিয়বিলাস

যার নাম কখনো জানে নি কোনো মানবসন্তান..."

বনপাহাড়ীর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ যাত্রায় বারে বারে ফিরে আসে কবেকার এই লাইনগুলো, উড়ন্ত রঙীন পালকের মতন ভেসে যায় যেন, আকাশে তখন রঙীন মেঘ, বেলা ঢলে এলো, আরেকটু পরেই রাতবাতিরা জ্বলে জ্বলে উঠবে। রাত্রির সরাই এ বিশ্রামের পরে আবার পরদিন সকালে চলা শুরু, একসময় এসে গেল চেনা শহর, ক্লান্ত আমরা ফিরে যাবো যে যার নীড়ে।

কিন্তু পথ ফুরাবে না, সে অনিঃশেষ বয়ে গেছে, এক সূর্যোদয় থেকে নতুন সূর্যোদয়ের দিকে, দেশ থেকে দেশান্তরে, কাল থেকে কালান্তরে ... সেই পথযাত্রার আনন্দতিলক কি পড়বে এসে এই কপালে, পরিব্রজনপ্রিয় পা দু'টি যে পথের ডাকে খুশী হয়ে ওঠে?

"এই পথ যদি না শেষ হয়..."