Saturday, October 10, 2009

আকাশপরী

প্রথম ওকে দেখেছিলাম খুব ছোটোবেলা। একদিন যখন দুষ্টুমীর শাস্তি দিতে মা গুমগুম করে আমার পিঠে জোরে জোরে কিল মেরে অন্ধকার ঘরে বন্ধ করে রাখলো, তখন ভয়ে আর ব্যথায় ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে আকাশপরীকে ফুটে উঠতে দেখেছিলাম, পরীর আকাশীনীল রঙের পাখা দুখানা কি নরম, আমার কাঁধের কাছে ওর পাখার ছোঁয়া লাগছিলো। পরী আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলো, "এই রিখু, এই বোকা, কেন কাঁদছিস? অন্ধকার বলে ভয় পাচ্ছিস? কই অন্ধকার, এই দ্যাখ কেমন আলো।"
মাখনের মতন নরম গাল, গভীর দু'খানা কালো চোখ, নরম পাতলা ঠোঁটে স্নিগ্ধ কোমল হাসি, মিষ্টি এক মেয়ে, আকাশপরী। আমি কান্নাটান্না সব ভুলে চোখ বড়ো বড়ো করে দেখেছিলাম পরীর ডানা দু'খানা থেকে কোমল নীল আলো বেরিয়ে আসছে। পরী বলেছিলো, "কাঁদিস না, আয় আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিই, তুই ঘুমিয়ে পড়।" আমি সেদিন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম পরীর ঘুমপাড়ানি গানে আর নরম হাতবুলানোয়। পরে মা বলেছিলো আধাঘন্টা পরে দরজা খুলে মা নাকি দেখেছিলো আমি মেঝেতে শুয়ে ঘুমাচ্ছি আরামে। ঐ ঘটনার উল্লেখ করে মা পরে সবাইকে বলতো," রিখুর খুব সাহস, অন্ধকারে ভয় পায় না। একদিন ওকে শাস্তি দিতে অন্ধকার ঘরে ... " বলে সেই গল্প শুরু করতো। আমার কেমন একটা মজা লাগতো,ও গল্পের আসল অংশটাই তো মা জানে না!
আমি কখনো মাকে আকাশপরীর কথা বলিনি, বাবাকেও না, অন্য কাউকে না, এমনকি খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাউকেও না। অবশ্য সেরকম ঘনিষ্ট বন্ধুই বা কোথায় ছিলো আমার! শুধু মোহর ... থাক, মোহরের কথা পরে।
যখনই কোনো ভয়ের বা দু:খকষ্টের মুহূর্ত এসেছে, তখনি আকাশপরীকে দেখতাম। পড়া না পেরে বাবার হাতে মার খেয়ে যখন নিজের ঘরে গিয়ে মনখারাপ করে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকতাম, তখন পরী এসে নরম হাত বুলিয়ে দিতো। একবার অঙ্কে খুব কম নম্বর পাওয়ায় বাবা আমায় খুব মেরেছিলো। পিঠে বেতের পর বেত মেরে ডোরা ডোরা করে দিয়েছিলো, সেই রাত্রে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো। আমি নিজের ঘরে ব্যথায় আর খিদেয় কাঁদতে কাঁদতে দেখতে পেয়েছিলাম পরী এসে শিয়রের কাছে বসেছে, হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আমার ব্যথাদাগগুলোয়, বলছে,"ঈশ, এমন করে কেউ মারে নাকি? ছি ছি ছি।" আমি শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
"ঋজুরেখ বসু"---নাম ঘোষনা হতেই দিবাস্বপ্ন কেটে যায়, এগিয়ে গেলাম, আবৃত্তি প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ হচ্ছে আজ, আমি প্রথম পুরস্কার পাবো। মঞ্চে ওঠার সময় পা কাঁপে আমার, মুখ ফিরিয়ে একবার পিছনে দেখি, পরী হাসছে। হাতের অভয়-ভঙ্গী করে এগিয়ে যেতে বলছে। আবৃত্তি প্রতিযোগিতার দিনও ছিলো পরী, এমনি করেই সাহস দিয়েছিলো।


***
সে বড়ো গরম দেশ, আমাদের দেশের বাড়ীর গাঁ। রোদ্দুর চড়ে উঠতো ফাল্গুনের শেষেই, মাঘের শেষ থেকেই রাগী হয়ে উঠতো, তারপরে চৈত্র বৈশাখে একেবারে তপতপে অবস্থা। গ্রীষ্ম কত দীর্ঘ হয়ে গেছিলো, বর্ষা গড়িয়ে যেতো শরতের বুকের উপর দিয়ে হেমন্ত ছেয়ে। তারপরে খুব সংক্ষিপ্ত শীত আর বসন্তের এক ঝলক শেষেই আবার চড়া গ্রীষ্ম।
শীতে মোড়া বিভুঁইয়ে এখনো কত ঠান্ডা, কত বরফ, তুলোর মতন তুষার ঝরে ঠান্ডা ধূসর আকাশ থেকে, আমাদের বিস্মৃত শ্বেতপ্রভুদের দ্বীপে বিষন্ন সকাল সন্ধ্যা বয়ে যায়,এখন উল্টোযাত্রায় আমরাই সেখানে গিয়ে থাকি, কাজ করি, সুতো জড়াই আর সুতো খুলি আর ভুলে যাওয়া শিশুকালের কথায় দু:খবিলাস করি।
শুকিয়ে আসা খালের পারে ক্ষীর-কাঁঠালের গুঁড়িতে বাঁধা নৌকার কাছি খুলে ফেলি, পার থেকে লাফ দিয়ে নৌকার খোলে নামে মোহর, খিল খিল করে হাসে। বলে, " রিখু, আজকে বংশীকাকা জানতে পারলে তোর রক্ষা থাকবে না।" কাকার মুখ মনে পড়ে, রাগী রাগী চোয়াড়ে মুখ, শক্ত শক্ত হাত, কালকে চড় খেয়ে ঘুরে পড়ে গেছিলো নুটুদা, কাকার ছেলে। গালে কাকার পাঁচ আঙুলের ছাপ পড়ে গেছিলো নুটুদার। অথচ একটু পরেই কাকা বেরিয়ে যেতে দিব্যি গিয়ে পেয়ারা গাছে চড়লো, এরকম মারধোর খাওয়া নাকি অভ্যেস আছে এদের।
কাকার কথায় কেন জানি বাবার মুখ মনে পড়ে, এমনি সময়ের মুখ না, শুক্কুরবারের সন্ধ্যেবেলার গুমোট মুখ, লাল লাল চোখ, উস্কো চুল, ভয় লাগে ঐরকম মুখ দেখলে। সেদিন ওদের ঘরে যাই না আমি, শুধু একদিন মায়ের কান্না শুনে ছুটে গিয়ে বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে দেখেছিলাম ... থাক, সে না বলাই ভালো।
মোহরের দিকে চেয়ে হাসি, তারপরে শক্ত গলায় বলি, " কিছু হবে না, চল। মোহর, তুই যে বলেছিলি আমায় ইন্দিরবিলের কচুরিপানাফুল দেখাবি?"
মোহর লগি নিয়ে জলে টান দেয়, নৌকা দুলে ওঠে, জলের উপর দিয়ে এই ছোট্টো ডিঙি এগিয়ে চলে। ডিঙা বায় মোহর, ওর চুলে খেলা করে হাওয়া, ওর চোখের তারায় পশ্চিমের রাঙামেঘগুলোর ছায়া পড়ে, ওর গলায় অচেনা মোচড় লাগে যখন ও বলে, "রিখু, কদিনের জন্য দেশের বাড়ী বেড়াতে আসিস, আবার চলে যাস, অনেক বড়ো হয়ে গেলে হয়তো আর আসবিই না, নারে?"
কি অপূর্ব রঙ কচুরিপানা ফুলের! সাদার উপরে অতি হাল্কা বেগুনী একটা আভা। বাঁশের লগি জলের নীচে মাটিতে ঠক করে ঠেকিয়ে নাও থামাই, হাত বাড়িয়ে ফুল তুলে নিই বেশ কয়েক থোকা। মোহরের বেণীর গোড়ায় গুঁজে দেবার সময় দুষ্টু মেয়েটা চুপ করে বড়ো বড়ো চোখ মেলে চেয়ে থাকে দূরে, কেন এত উদাস হয়ে গেলো? দূরে অনেক দূরে ঐ পশ্চিমদিগন্তে রাঙা সূর্যাস্তের দিকে চেয়ে থাকে,ওর কালো চোখের মণিতে জ্বলজ্বল করে লাল রঙ। শুভ্র ও হাল্কা বেগুনী মেশানো ফুলগুলি কি দারুণ মানিয়েছে ওর গোছা ধরা কালো চুলে।
আমার বুকের ভিতরে কেমন মোচড় লাগে, মনটা কেমন আনচান করে ওঠে, কেজানে কি হবে ভবিষ্যতে। ভাসা-ভাসা আলগা আলগা মেঘের ছায়ার মতন দূর দূর দূর কোনো দেশের গল্প মনে পড়ে, বাড়ী থেকে পালিয়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে, ওখানে পরিচিত কেউ নেই, কোনো শাসন নেই, অত্যাচার নেই, ওখানে খুব মিঠা হাওয়া, ওখানে খুব নরম অমলতাসের ফুলের মতন দিন, ওখানে আমি আর মোহর ...
জোর করে দিবাস্বপ্ন থেকে মন ছাড়িয়ে আনি, মোহরের কালো চোখের তারায় আকাশের বিচিত্র আলো ... গরম রক্ত আমার মুখচোখকান হাত ভরিয়ে তোলে, ডিঙা এসেছে হিজলের ছায়ায়, আমি মোহরের দিকে তাকাই, দেখতে পাই আকাশপরীকে, ওর দু'খানা ডানা থেকে নীল আলো বেরিয়ে আসছে, ওর ঠোঁটে অভয়হাসি, সেই হাসিতে কাছে যাবার আহ্বান, আমি এগিয়ে যাই, ঝুঁকে পড়ি পরীর দিকে, আমার দুখানা বাহু পরীর শরীর ঘিরে ধরে নিবিড় করে, আমার মুখ নেমে আসে পরীর হাসির উপরে ...
কতক্ষণ কেটেছিলো জানিনা, সম্বিত ফিরে পাই মোহরের ফুঁপিয়ে কান্নায়, পোশাক গোছাতে গোছাতে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মোহর , কিছু বলছে না। নাড়া লাগা ফুলের ভেতর থেকে ঝরঝর করে জল পড়ে যেমন, তেমনি করে ওর চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে থাকে। পরী কোথায় গেলো, আমার আকাশপরী? উত্তরে দক্ষিণে পুবে পশ্চিমে তাকাই অস্থির হয়ে, নেই, নেই, আকাশপরী নেই। কোত্থাও নেই, কোথাও না। দূরে দূরে যতদূর পারি দূরে চেয়ে দেখি, নেই কেউ কোথাও নেই, নেই সেই আকাশীনীল ডানার আলো, নেই সেই স্বপ্নভরা চোখের সস্নেহ প্রশ্রয়, পরী উড়ে গেছে আমাকে কাদায় ফেলে রেখে।
এলোমেলো চুল, এলোমেলো ওড়না ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদা মোহরের দিকে তাকাই, ঝড়বৃষ্টির পরের ফুলবাগানের মতন বিধস্ত লাগে ওকে। কখন এমন হলো? কেন হলো? কেমন করে হলো?
আমরা ফিরে আসি, সন্ধ্যে হয়ে গেছিলো বেশ, ভয়ে ভয়ে বাড়ী ফিরি। খুড়তুতো দাদা নুটুর সঙ্গে দেখা, সে পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে নিয়ে গেলো, বললো সামলে দেবে। সামলে দিলো সত্যি, রাতের খাওয়াদাওয়া নির্বিঘ্নে হয়ে যাবার পরে নুটুদার ঘরেই শুয়ে পড়লাম যেমন শুতাম। ক্লান্তি চোখের পাতা আঠার মতন জুড়ে দেয় কিন্তু কেন জানি ভালো করে ঘুম আসে না। ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম, ছেঁড়া ছেঁড়া জাগরণ। একবার উঠে কলসী থেকে গেলাসে জল গড়িয়ে খাই, ভিতরে কী যে বালি বালি তৃষ্ণা!
অবশ করা বেদনা শরীরে, ঘুমের তৃষ্ণা চোখেমুখে। মনে হলো জলের মধ্যে ডুবে যাচ্ছি, নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হলো যেন আকাশ দিয়ে শত শত কালো কালো ডানা উড়ে যাচ্ছে, আলো ঢেকে যাচ্ছে। অচেনা একটা ভয়ের ছমছমি আমাকে আমূল কাঁপিয়ে তুলছে। গলা চিরে চিৎকার করতে চাইছি কিন্তু কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না গলা দিয়ে।
"কি হয়েছে রিখু, কি হয়েছে? বোবায় ধরলো নাকি? উঠে বস রিখু, উঠে বস।" চোখ মেলি, নুটুদা আমার হাতে নাড়া দিয়ে ডাকছে। স্বপ্ন ছিলো সব। আমি উঠে বসি, ঘামে মাথা গলা পিঠ বালিশ বিছানা ভিজে গেছে।
বিছানা থেকে নামি, নুটুদা গামছা এগিয়ে দেয়। ঘাম মুছে ফেলি। জলভরা গেলাস দেয়, জল খাই। তারপরে দরজা খুলে বাইরে খোলা হাওয়ায় দাড়াই দু'জনে।
"কি হয়েছে তোর, রিখু?" নরম গলায় জিজ্ঞেস করে নুটুদা।
আমি দু'দিকে নাড়াই মাথা, না কিছু তো হয় নি!
পরদিন ওবাড়ী থেকে চলে আসি, যদিও গ্রীষ্মের ছুটি তখনো অনেকদিন বাকী ছিলো। বিদায় নেবার সময় মোহরের সঙ্গেও দেখা হয় নি আর। তারপর কেটে গেছে কতকাল, সে যে কতকাল ...
আকাশপরীকে আর দেখতে পাই নি। আর কোনোদিন না। কাউকে কিছুই বলা হয় নি কোনোদিন, দেশের বাড়ীতে আর যাওয়াও হয়নি। পরের বছর থেকে পড়াশোনার চাপ বেড়ে গেলো যে! মাধ্যমিক কাছিয়ে এলো। বাবামায়ের সঙ্গেও দূরত্ব বেড়েই চললো, কিসের যে এক না বলতে পারা অভিমান ছিল! কোনোদিন আর ঘুচলো না আমাদের ব্যবধান!
যে দিন ভিন দেশে পাড়ি দিতে হলো পড়ার জন্যে, সেদিন ও তেমন কোনো বেদনা ছিল না আমার নিজের দিক থেকে। এক চাবড়া ঘাস যেমন সহজে উঠে আসে, তেমনি সহজ সাবলীল চলে যাওয়া আমার। যেন কিছুদিন অতিথি ছিলাম, ফিরে যাচ্ছি। এই বেদনাহীনতার দু:খ ও একধরনের ভোঁতা বেদনা তৈরী করে মনের ভিতরে। চলে যাবার আগের রাতে সবকিছু গোছানো হয়ে যাবার পরে খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করতে করতে ভাবছিলাম আমার শৈশব-কৈশোরের কথাই। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে যাদের আপন বলে পেয়েছি ঘরের মাঝে, তাদের সঙ্গে কোথায় যেন একটা সংযোগহীনতা! এ কি আমারই ত্রুটি? আমারই তীব্র অভিমান ছুরি দিয়ে কেটে দিয়েছে বাঁধন? নাকি ওদের দিক থেকেও ছিলো অবহেলা আর অত্যাচার? আমার স্নেহ-আকাঙ্ক্ষী মন কি ওরাও বুঝতে চায় নি?
আমি যা আশাই করিনি, সেই রাতে তাও হলো। আমার ঘরে একলা এসে অপ্রত্যাশিত কোমল গলায় বাবা বলেছিলো, "রিখু, তোর উপরে হয়তো অনেক অন্যায় করেছি, যদি পারিস, মাফ করে দিস। আর .. আর যদি কোনোদিন ইচ্ছে করে কোনো সুখদু:খের কথা শেয়ার করতে, বলিস আমায় খোকা। আমায় বলিস। "
আগে কোনোদিন খোকা বলে নি, সেদিন বললো, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলো, আমার একেবার ইচ্ছে হচ্ছিলো ওঁর কোলে মুখ গুঁজে দিয়ে খুব কাঁদি, অনেক কেঁদে বুকের পাথর সবটুকু গলে গেলে তারপরে বলে দিই সব। আমার সমস্ত দু:খকষ্ট আমার ভুল ঠিক, আমার সমস্ত পাপপুণ্য সব। আকাশপরীর কথাও, আকাশপরী যে আর আসে না, সে কথাও। কিন্তু পারলাম না। কঠিন অভিমান আমার দু:খকে আগলে দাঁড়িয়ে রইলো প্রহরীর মতন।


***
ঠান্ডা ধূসর আকাশ থেকে অদ্ভুত বিষন্ন বৃষ্টি পড়ছে, অবিচ্ছিন্ন অশ্রুর মতন, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমে আসে, জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আমি দেখতে থাকি পথবাতিগুলির জ্বলে ওঠা, একের পর এক। এইখানে কয়েক মাস হলো এসেছি, এই দ্বীপরাজ্যের আবহাওয়া নাকি প্রায় সারাবছরই এমন ছিঁচকাদুনে বৃষ্টি আর বৃষ্টি। বন্ধুবান্ধব যারা থেকেছে সকলেই এই নিয়ে বিতৃষ্ণ। কী জানি আমার থাকতে হয় কতবছর।
মনে পড়ে রৌদ্রতপ্ত দিনের শেষে কালবৈশাখী, জটামেলা মেঘেভরা আশ্চর্য আকাশ, সেখান থেকে নেমে আসা ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। আমি আর মোহর ... মোহর..... এখন কোথায় সে? কোনো খোঁজ আর রাখা হয় নি, দেশের বাড়ীতেই তো আর যাই নি সেই ক্লাস এইটের পরে।
তারপরে কোথা দিয়ে কেটে গেছে কত কত বছর-সময়ের ঘূর্ণীজল সরিয়ে দেখতে চাই, মোহরকে। দেখতে চাই সেই কবে যেন চিরকালের মতন হারিয়ে ফেলা আমার সেই আকাশপরীকে! ওর সেই দুখানা আকাশীনীল রঙের নরম ডানা ... আর কি কোনোদিন সে আসবে না?
কোনো রূপবতী বৃষ্টির বিকেলে আমি আর মোহর যদি একসঙ্গে ভিজতে পারি ...
চোখ বন্ধ করে ধূসর আকাশের বিষন্ন বৃষ্টি থেকে আলাদা হয়ে যাই, মনে পড়ে দীর্ঘ এক উড়ান। হাওয়াই জাহাজ রানওয়ে দিয়ে ছুটছে আর ছুটছে ... একসময় মাটি ছেড়ে উঠে পড়লো। পাশের সীটে মোহর, মোহরের নরম হাতখানা শ্বেতকপোতীর মতন আমার কোলে আশ্রয় নিলো ... চোখ মেলে দীর্ঘশ্বাস মুক্ত করে দিই। কোথায় বা মোহর ? হয়তো দূরে কোনো শান্ত জনপদে একটি সুলক্ষণ সুন্দর ঘরকন্যা পেতেছে-হয়তো উঠোনে খেলা করে বেড়ায় চুন্নিমণি শিশুরা।
ক্যারোলিন এসে কাঁধে টোকা দেয়, "রিখু, কি হলো ডিনারে যাবে না? নাকি আজকে বাড়ী যাবে?"
আমি বলি, "চলো তবে যাই। বাড়ীতে তো যাবো সেই মাঝরাতে।"
ক্যারোলিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়াটাও বেশ আশ্চর্য। আমার মতন স্বল্পভাষী, অন্তর্মুখী, লাজুক মানুষের এত তাড়াতাড়ি বিদেশিনী বান্ধবী হয়ে যাবার কথা নয়, ক্যারোলিন নিজে উদ্যোগী হয়েই বলা যায় বন্ধুত্বটার সূচনা ও প্রস্ফুটন দুইই করে চলেছে।
একদিনের কথা মনে হয়। তখন আমি নতুনই বলতে গেলে। ক্যারোলিনের সঙ্গে ক্লাসে আলাপ হয়েছে, কিছুদিন কথাবার্তাও হয়েছে। একদিন ওকে দেখলাম বাইরে পাথরের বেদীতে বসে আছে। ওর কোমল তরুণীমুখের পাশে লতিয়ে আছে ভেলভেট ফুলের লতাটি, নরম সুখস্পর্শ ফুলগুলি ওর গালের ওপরে এসে পড়ছে হাওয়ায়। হাওয়ায় ওর সোনালী চুলের গোছাও উড়ছে আলতো আলতো করে।
ক্যারোলিনকে ছেঁড়া পুরানো পোশাকে এলোমেলো চুলে কল্পনা করতে চেষ্টা করি, কিন্তু তাতেও ওর রূপ এতটুকু কমে না। এমন সাদাতে গোলাপীতে মেশানো মুখের রঙ! এমন নিঁখুত করে গড়া নাক মুখ চোখ! নীল চোখের ভিতরে আলো জ্বলছে। ওকে ক্লান্ত ক্ষুধার্ত তৃষ্ঞার্ত কল্পনা করি, তাতেও রূপ কমে না ওর। ও বলেছিলো একসময় নাকি খুব কঠিন অবস্থা গেছে ওর, রোজ খেতে পেতো না, ছেঁড়া পোশাক পরতে হোতো। কিন্তু এই আকাশচ্যুত বিদ্যুতের মতন সুন্দরী কি তাতে ম্লান হয়? আমার দু:স্বপ্ন যত দূর যেতে পারে, চেষ্টা করি ততদূর খারাপ অবস্থায় ওকে কল্পনা করতে, কিন্তু সামনে ফুলে ছাওয়া শ্বেতপাথরের বেদীটিতে এলিয়ে বসা হাসিমুখ তরুণীটির চেয়ে কোনো মতেই বেশী ম্লান হয় না আমার কষ্টকল্পনার ক্যারোলিন। এত সৌন্দর্য দর্শকের বুকের ভিতরে একধরনের কষ্ট তৈরী করে। অচেনা কষ্ট। পৌষের ফিনিক ফোটা জ্যোৎস্নায় জেগে উঠে পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ি পড়ি করেও যখন পড়ে না, তখনকার মতন কষ্ট।

আমরা চলতে থাকি, ক্যারোলিন কথা বলতে থাকে, আমি চুপ করে শুনতে থাকি। ক্যারোলিন ওর নিজের কত কথা আমাকে বলেছে, আমি নিজের কিছুই বলতে পারিনি। ক্যারোলিনের মা ওকে আর ওর ভাইকে একা-একা মানুষ করেছেন অমানুষিক পরিশ্রম করে। দিনেরবেলা একখানা কাজ আর সন্ধ্যাবেলা আরেকখানা কাজ করতেন উনি। ওদের বাবা নাকি ছিলেন খুব অদ্ভুত চরিত্রের লোক, আগে হাসিখুশী ছিলেন, ছেলেমেয়ে জন্মাতেই মেজাজ তিরিক্কি হয়ে গেল ভদ্রলোকের। ডিভোর্স করে ছেলেমেয়েকে ফেলে সবরকম দায়িত্ব এড়িয়ে একদিন চলে গেলেন দূরদেশে, আরেক মহিলাকে তার পূর্বতন সন্তানসমেত বিবাহ করে। সে বিয়েও টিঁকলো না অবশ্য বেশীদিন, পরে এক ধনী নি:সন্তান বিধবাকে বিবাহ করে এখন তাতেই নাকি সুখে আছেন।
অচেনা দূরের সংস্কৃতির গল্প সব, এদেরই মধ্যে থাকি কিন্তু বুঝতে পারি না, চিনতে পারি না। হয়তো সারাজীবন থাকলেও চিনতে পারবো না। ক্যারোলিন কত অনায়াসে বলে যায় তার মায়ের নতুন স্বামীর কথা, অনেক কষ্টের পরে এখন সুখে আছেন মা। "ডেভিড খুব চমৎকার লোক", সৎ বাবা সম্পর্কে বলে ক্যারোলিন।
আমি প্রথম শুনে আঁতকে উঠেছিলাম, "স্টেপড্যাডকে নাম ধরে বলছো?"
ক্যারোলিন বিশুদ্ধ অবাক হয়ে বলেছিল, " আরে নাম ধরে ছাড়া কিভাবে বলবো? নাম তো ডাকার জন্যই, তাই না?"
ওর ছোটোবেলার আর কৈশোরের গল্প শুনি, আমাকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে আমার কথা, আমি একটা দুটো কথা বলে চুপ করে যাই, তেমন কিছু বলতে পারি না। একদিন হয়তো আমিও -- বুকের ভিতরের কষ্টপাথরটা নড়ি নড়ি করে ওঠে যেন।
***
ধূসর আকাশ থেকে একটানা তুষার ঝরছে, রাস্তাগুলো সাদা হয়ে গেছে। গাছগুলো সব ন্যাড়া, কঙ্কালের মতন দাঁড়িয়ে আছে। প্রাণহীন প্রত্নপ্রস্তর যেন। অদ্ভুত বিষন্নতা বর্ণহীন চাদরের মতন ছড়িয়ে আছে সবটুকু জুড়ে, বাইরে আর ভেতরে। সূর্যহীন ধূসর মেটে তুষারাচ্ছন্ন দিন যে কি প্রচন্ড বিষাদের! আহ,উষ্ণতা যে কি ভীষণ আকাঙ্ক্ষার, সে কী এই অবস্থায় না পড়লে কোনোদিন বুঝতে পারতাম?
প্রবল সূর্যের দাবদাহের দেশ থেকে আসা আমি, আগুন আবিষ্কার নিয়ে এদের এই আদিখ্যেতার অর্থ অস্পষ্টভাবে বুঝতে শুরু করি। মস্ত মস্ত গাম্বাট পোশাকে সর্বাঙ্গ আবৃত লোকেরা পথ চলেছে,আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কিছুতেই ঠিক করতে পারছি না কখন বাসায় ফিরবো, এখন না আরো অনেক পরে?
হুতুমথুমের মতন দিন, ধোঁয়া ধোঁয়া সব কিছু। জোর করে পিছিয়ে যাই সময়ের মধ্যে, স্মৃতির সরণী ধরে অতীতের উদ্যানে ঢুকে পড়ি। মোহর, মোহর, মোহর। ওকে দেখবো, ওকে দেখতে চাই। থুতনি ঠেকাই মোহরের গালে, বলি," কিরে, কেন কাঁদছিস ছিঁচকাঁদুনির মতন?" মোহর দু'হাত দিয়ে গাল চোখ মুছতে মুছতে হাসে, বলে, " চোখে আঞ্জনি না খঞ্জনি কি হয়েছে কে জানে।"
প্রবল হাওয়ায় উড়ছে মোহরের চুল, সন্ধ্যার রঙ গড়িয়ে পড়ছে আকাশ বেয়ে, কাকেরা দল বেঁধে উড়ে চলে আসছে পুবের দিকে, ওরা সর্বদা বাসায় ফেরার সময় পুবে উড়ে আসে। সকালে বেরোবার সময় সূর্যের বিপরীতে ওড়ে আবার ফেরার সময়ও। আচ্ছা, ওরাও কি জানে জ্যামিতি, অংক, গোল জ্যামিতি? ওরা নিশ্চয় আমাদের থেকে অন্যরকম জানে, কত উপরে ওড়ে ওরা, জন্মকাল থেকে।
সারি বেঁধে ওড়া কাকের দল থেকে পিছিয়ে পড়েছে একটি কাক, তাছাড়া অন্য কাকেরা উড়ে যাচ্ছে নিঁখুত একটি গতিময় প্যাটার্নের মতন, ওদের ডানায় আলো থেকে ছায়া পড়ে আসছে। পিছিয়ে পড়া কাকটিকে মোহর বললো,"তাড়াতাড়ি যা,এই তাড়াতাড়ি যা। হারিয়ে যাবি নইলে।"
মোহরের মুখের দিকে চেয়ে হেসে উঠলাম আমি, "তুই একটা পাগলি রে মোহর।"
দুধসাদা ক্যারোলিনের মুখের পাশে লতিয়ে আছে ভেলভেট ফুলের লতাটি, নরম সুখস্পর্শ ফুলগুলি ওর গালের ওপরে এসে পড়ছে হাওয়ায়। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো ও, বললো," হ্যালো রিখু, কোথায় চললে? "
"ক্যারোলিন, চলো, লাইব্রেরী যাবে না?" আমি ওর হাত ধরতে হাত বাড়িয়ে দিই। ক্যারোলিন ওঠে, একটি আলোর হিল্লোলের মতন এগিয়ে আসে। কোথা থেকে খিলখিল একটা হাসি শুনতে পাই, একদম মোহরের গলা।
আহ, যতবার ক্যারোলিনের দিকে তাকাই, কেন মোহরকেই শুধু মনে পড়ে? তবু কিছুতেই মন খুলতে পারিনা কেন? ত্রুটি কি তবে আমারই মধ্যে? আমারই ভুল অভিমানে হারিয়ে ফেলছি সব? আকাশপরীকে কি তাই আর দেখতে পাই না?


***
শীত শেষ হয়ে বসন্ত এসে গেল। বসন্ত ও চলে গেল, এখন গ্রীষ্ম। আমাদের কাজ পড়লো অনেক দূরে, ক্যারোলিনকে আর আমাকে পাড়ি দিতে হলো আরেকটা মহাসাগর। ক্যারোলিন আগেও বেশ কয়েকবার গেছে সে পথে, একটুও নার্ভাস না। আমার তো টেনশনে আধাসেঁকা অবস্থা। সে বারেবারে আমায় সাহস দেয়, খুব ভালো সময় কাটবে আমাদের।
এখন আমরা আবার এক গরম দেশে, ধোঁয়াটে আকাশ আবারও নীল। বদলে যেতে থাকা সবকিছু, এই যে আকাশ, স্ফটিকের মত স্বচ্ছ নীল, ঝকঝকে সূর্য বুকে নিয়ে-আবার জোরালো দক্ষিণের হাওয়ায় এই উড়ে এলো সাদা তুলো-তুলো মেঘেরা, ধূসর ভারী মেঘেরা এলো তার পরে। ছায়া পড়ে এলো, হয়তো বৃষ্টি নামবে।
বাড়ীতে ফোন করি, জিজ্ঞেস করি কেমন আছে ওরা। মা বলে, ওরা ভালোই আছে, খুব গরম, লোডশেডিং চলছে লাগাতার, আকাশভরা মেঘ, গুমোট হয়ে আছে সকালবেলা, খুব বৃষ্টি হয়ে গেছে গত সন্ধ্যায়-আশ্চর্য, সেই সন্ধ্যাটা এখনো চলছে এখানে! দুনিয়া এত অবাক করা জায়গা!
জন্মান্তরের মতন বিচ্ছিন্ন অথচ যুক্ত হয়ে আছি সবাই, লিখে কিছুই বোঝানো যায় না, শুধু একটা আকুলতা, একটা অস্থিরতা ধাক্কা দিতে থাকে! বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট এর কথা বলেন, সেও কি অদ্ভুত অবিশ্বাস্য ব্যাপার! নিকট ও দূর সত্যিই কি জুড়ে আছে অমন নিবিড় হয়ে ?
মানুষের জীবনটা আসলে কিরকম? বিষাদের নাকি আনন্দের? নাকি যে যেভাবে চায় সেভাবেই পায় জীবনকে? এই যে ক্যারোলিন, সুখদু:খের স্রোতের ভিতর দিয়ে কেমন নতুন গড়া নৌকার মতন অনায়াস গতিতে অবলীলায় ভেসে যাচ্ছে, আমি তো তেমন পারি না! কেন পারি না? কীসে আমাকে টেনে ধরে পিছন থেকে? সকলের সঙ্গে কেন মন খুলে মিশতে পারি না? এ কি আমার জন্মগত কোনো অসহায়তা? নাকি পূর্ণবয়স্ক এই আমার ভিতরের মানুষটা আজো অভিমানী এক শিশুর মতন ঠোঁট ফুলিয়ে বসে আছে?
বারে বারে মনে পড়ে প্রবঞ্চিত শৈশবের দিনগুলো যখন বাবা বা মা কেউ আমাকে বুঝতে চাইলো না, শুধু কঠোর শাসন করে গেল কারণে অকারণে। মনে পড়ে সেই কৈশোরের একাকীত্ব, যখন খুব কাছের বন্ধু কেউ ছিলো না, যখন বাবামায়ের সঙ্গে বন্ধুর মতন একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠা খুব প্রয়োজন ছিলো, কিন্তু তা হলো না। এইসব কথা মনে মনে তোলাপড়া করে নিজের সপক্ষে কিছু যুক্তি দাঁড় করাই আবার নিজেই ভেঙে ফেলি। আরও কত মানুষের শৈশব-কৈশোর আরো কত কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে পার হয়েছে, কই তারা তো সবাই এরকম হয়ে যায় নি?
ক্যারোলিন গুণ্‌ গুণ্‌ করে গান গাইতে গাইতে আসছে, দু'হাতে দুখানা আইসক্রিম কোণ, আমাকে একটা দিলো। নিজে ঠোঁটে মুখে আইসক্রিম মাখামাখি করে খেতে খেতে বাচ্চাদের মতন হাসছে। বলছে, "চলো না বেড়িয়ে আসি, উইকেন্ডে ঘরে বসে থেকে কি হবে?"
আমার ওকে দেখে অবাক লাগে, এত প্রাণশক্তি এত আনন্দ এত মজা করার ক্ষমতা এই ক্ষীণকায়া মেয়েটির মধ্যে কিকরে থাকে? আইসক্রিমের ঠান্ডা শিরশিরে দুধালো মিষ্টতা মুখের ভিতরে গলে যায়, আমি ক্যারোলিনের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। হঠাৎ করে মনে পড়ে আমার খয়েরী মলাটের ডাইরিটাকে, ডাইরিটার পাতাগুলো ঘিয়ে রঙের, কেমন একটা হালকা ধূপের গন্ধ ছিলো পাতাগুলোতে।
পাতাগুলো ভরে উঠছিলো এলোমেলো কবিতায়। একলা একজন মানুষের গভীর সঙ্গোপনের সাথী। কেউ কোনোদিন জানতে পারেনি আমার কলেজবেলার কবিতাদের, খুব সাবধানে লুকিয়ে রাখতাম ডাইরিটা। দেশ থেকে চলে আসার সময় সেটা আনা হয় নি সঙ্গে করে আর।সেই খুব যত্নে লুকিয়ে রাখা ডাইরিটা কি কেউ খুঁজে পেয়ে গেছে? মা অথবা বাবা? নাকি এখনো ওটা লুকানোই আছে? লুকিয়ে থেকে থেকেই হয়তো একদিন পুরানো, জীর্ণ হয়ে যাবে, লেখার কালি আবছা হয়ে হারিয়ে যাবে। আজ থেকে একশো বছর পরে কোথায় থাকবে আমাদের চেনা এই বর্তমানের জিনিসগুলো সব?
সন্ধ্যাবেলার কমলা পালকমেঘের মতন একটা কবেকার লেখা অনামিক কবিতা ভেসে এসে আমাকে ছুঁয়ে যায়, কেমন করে স্মৃতির মধ্যে লুকিয়ে চলে এসেছে সে?

" আঁকেবাঁকে পাথরের চুলগুছি আল্পনা-
ঘুরে ঘুরে এলোমেলো ঢেউকথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে
নিজের মতন পথ চলে নদী।
মাঝে মাঝে ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছেফুল
ফেনায় ফেনায় ফুটে উঠে পাড়পাহাড়ে মিলিয়ে যায়।
গাঢ় যুবতী রোদ ঢেকে দিয়ে বিকেল আসে জলকল্যাণী।

কলাবতীরঙের শাড়ী পরে মায়াবতী সন্ধ্যা গেছে এই পথেই
বৃষ্টিভেজা হিমচম্পার গন্ধ ছিলো বাতাসে।
চিরঞ্জীব সৌরভের ছোঁয়ায় থমকে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে,
ফিরে যেতে ইচ্ছে করে ধূলিপথে আরক্ত ছাপ রেখে-
জন্মবেলার আলোআঁধারি ডাকে- আয় আয়।


কে যেন ডেকেছিলো? মনে পড়ে না তার নাম -
শুভ্র শঙ্খমালা ছিলো তার গরীম গ্রীবায়
ভোর হয়-হয় রাতের মতন চোখ, আলোয়-কালোয় জড়াজড়ি,
সবুজ আঁচলে ছিলো ধান্যদুর্বামঞ্জরী।
ধূপছায়াবেলায় সে বলতো সাতভাই তারার গল্প।
কোন্‌ একশিলা নগরীতে হারিয়ে গেল সে,
আকাশ তখন মুহুর্মুহু বিদ্যুৎস্নানে আবিষ্ট। .....”


আমি জোর করে ঘোর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য উঠে দাঁড়াই। বলি, "বেশ তো, চলো না কোথাও ঘুরেই আসি। সমুদ্র তো মাত্র দুইঘন্টার দূরত্বে। যাবে?"
ক্যারোলিনের আইসক্রীমমাখা মুখ খুশীতে আলো-আলো হয়ে ওঠে, বিশ্বাস করতে পারছে না যেন এমন গলায় বলে, "সত্যি যাবে ?"
" হ্যাঁ, সত্যিই তো। চলো বেরিয়ে পড়ি এখনই। কোনো গোছগাছের কিছু নেই, সন্ধ্যেবেলায় ফিরে আসবো। দুপুরে ওখানেই কোথাও খেয়ে নেওয়া যাবে। এসো, যাই।"
" আরে! পোষাকটা অন্তত পাল্টে আসতে দাও। আর সানস্ক্রীন লোশন, ক্যামেরা...." কথা বলতে বলতে ক্যারোলিন পাশের ঘরের দিকে চলে যায়, আমি হেসে জুতোমোজা পরতে শুরু করি। আমার সানস্ক্রীন লাগবে না। সূর্যক্ষুধায় আমার ভিতরটা আনচান করছে, পুড়ে কালচে হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।


ভালোবাসার নীল আলো একদিন আকাশভরে ফুটে উঠবে, ঐ আকাশপরীর ডানা দু'খানির মতন। ততদিন শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা। আমরা অপেক্ষা করতে চাই না, তবু অপেক্ষা করতে হয় কেবলই অপেক্ষা করতে হয়। আরোগ্যের অপেক্ষা, শান্তির অপেক্ষা, ভালোবাসার অপেক্ষা ...

***