Tuesday, March 15, 2016

বর্ণমালা

এই প্রিয় বর্ণমালা,
তার মায়াময় শরীরে নদীর ঢেউ-
তার চোখে আকাশের জ্যোতিরুৎসব
তার হৃৎপিন্ডের ধক-ধক
সমুদ্রের তরঙ্গভঙ্গের মতন সুরেলা।
তার গানে ভোর হয়-
তার গানে সন্ধ্যা নামে।
আমি তার কাছে গিয়ে
চুপ করে বসি।

যেমন মায়ের কাছে গিয়ে
নতজানু হয়ে বসতাম-
মাথা রাখতাম কোলের উপরে,
কুরুশকাঠি পাশে রেখে দিয়ে
আমার চুলে বিলি দিত মা।
আটপৌরে শাড়ীর নরম ভাঁজে
ধূপের গন্ধ, চন্দনের স্নিগ্ধতা
বড় প্রিয়, বড় মায়াময়।

তেমনই প্রিয় এই বর্ণমালা-
বর্ণমালাই আশ্রয় ,বর্ণমালাই স্বদেশ
বর্ণমালাই হৃদয়ের জন্মভূমি,
জ্বলজ্বলন্ত নক্ষত্ররাজি নিয়ে
অশেষ হয়ে বিছিয়ে আছে
আকাশে আকাশে।

স্রোতস্বিনী

আমি একটা নদী খুঁজছিলাম,
স্নিগ্ধ এক সজল স্রোতস্বিনী,
কিনারে রুদ্রপলাশ গাছ এই বসন্তে
ফুল্লকুসুমিত হয়ে ঝলমল করছে।

ভেবেছিলাম ঐ নদীর পাশেই
নির্জনে তোমার দেখা পাবো ।
সারাদিন কেটে যাবে রৌদ্রের ঘ্রাণে,
আর গাছে গাছে বাতাসের মর্মরে।

তারপরে যখন সন্ধ্যা নামবে-
তখন আকাশভরা তারার নিচে
নদীর কিনার ধরে হাঁটতে হাঁটতে
একে একে আমরা চিনতে থাকবো নক্ষত্রদের,
কালপুরুষের জ্বলজ্বলে কাঁধে রাঙা আর্দ্রা
পায়ের কাছে উজ্জ্বল নীল বাণরাজা -
একটু দূরে তীব্র লুব্ধক,
আরেকটু দূরে দুই পুনর্বসু-
উত্তরে সপ্তর্ষির সাত তারার
অনন্ত জিজ্ঞাসাচিহ্ন ছুঁয়ে-
সোজা চলে যাবো ধ্রুবতারায়।

কিন্তু সেই আশ্চর্য নদীটা
কিছুতেই যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না !

অলখ নদী

"জানেন, আমার একটা ছেলে ছিল, প্রথম পক্ষের। ওর মা মারা যাবার পর আমি ছাড়া আর কেই বা ছিল ওর? তারপরে বড়লোক ঘরের মেয়ে বিয়ে করি, তখন এই স্ত্রী আর এই পক্ষের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমার আগের পক্ষের ঐ অসহায় ছেলেটাকে দেখতো আমাদের এক পুরনো বিশ্বস্ত পরিচারিকা। আমি ঐ ছেলের উপরে কেন যেন রেগে থাকতাম, অকারণে খুব মারতাম। ও চুপচাপ মার খেত, কোনো কোনোদিন রক্তাক্ত হয়ে যেত, ছেড়ে দিলে চলে যেত। কোনোদিন কিছু বলতো না, বেশি লাগলে আস্তে আস্তে কাতরাতো, একদিন আমার পায়ের উপরে মুখ রেখে বলেছিল, "আজকে মেরো না, ছেড়ে দাও, আজকে বড্ড জ্বর।" পায়ের পাতার উপরে ছোঁয়া পেয়েছিলাম বলে বুঝতে পারলাম জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সেদিন বুঝতে পারলাম স্রেফ অত্যাচার করছি দুর্বলের উপরে। ওকে দু'হাতে করে তুলে নিয়ে ওর ঘরে পৌঁছে দিলাম, বিছানায় শুইয়ে দিলাম। চিকিৎসার ব্যব্স্থা করলাম। কিন্তু সেরে উঠলো না। বেশী জ্বর সেরে গেল, কিন্তু ভিতরে ভিতরে অসুখ ছিল, দুর্বলতা ছিল, সারলো না। ও বিছানার সঙ্গে মিশে শুয়ে থাকতো, আমি ওর পাশে গিয়ে বসে থাকতাম। আমায় একদিন কেমন কাতর গলায় বললো, "তোমায় একটা কথা বলি বাবা?" আমি বললাম, "বল্‌।" আস্তে আস্তে বললো, "আগে কোনোদিন বলতে পারিনি, ভয় লাগতো। আজকে বলি। তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি, জানো? আগেও বাসতাম। তুমি অত মারতে, কিন্তু তাও আমি তোমায় ভালোবাসতাম। কোনোদিন বলতে পারিনি, তুমি যদি রাগ কর? আজকে বললাম, কিছু মনে করো না।" এই বলে চোখ বুজে অন্যদিকে ফিরলো। আমি চুপ করে বসে রইলাম। কিছুই বলতে পারিনি। শুধু ওর মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিলাম। ঘুমিয়ে পড়ল, আর সে ঘুম ভাঙলো না। ওর মায়ের কাছে চলে গেল। আমি তারপর সংসার ছেড়ে চলে এসেছি, পথে পথে ঘুরে বেড়াই, ভিক্ষে করে বেড়াই আর এই কাহিনি সবাইকে বলি। আমিও তো ওকে ভালোবাসতাম, বাসি এখনও, আগে বুঝতেই পারিনি। এখন আর ওকে কোথায় পাবো? তাই ভালোবাসা ভরা হৃদয় নিয়ে পথে পথে ঘুরি। একটু প্রার্থনা করবেন যেন সে যেখানেই থাকুক, ভালো থাকে।"

অকালবৃদ্ধ ভদ্রলোক কাঁদছিলেন, দেখে কেমন অদ্ভুত মায়ায় আর দুঃখে ভরে গেল মৃন্ময়ীর মনটা। সন্তান হারানোর দুঃখ সে জানে, যদিও প্রকাশ করে না কোথাও।

কৃষ্ণচূড়া

তোমাদের বাগানে ছিল পাশাপাশি দুই কৃষ্ণচূড়া
সারাবছর শান্ত সবুজ ছায়া মেলে চুপ,
কেবল বসন্ত এলেই টকটকে লাল ফুল ফুটতো ওদের।
তুমি বলতে ওরা লালপাহাড়ীর দুই রাখাল
দেশে ফেরার পথ খুঁজে না পেয়ে
গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
শুধু বসন্ত এলেই ওদের মনে পড়ে
লালপাহাড়ীতে ওদের দেশঘরের কথা,
তাই ওদের মনকেমন করে-
আর সেই মনকেমন লালফুলের মঞ্জরী হয়ে
ফুটে উঠতে থাকে ডালে ডালে ।

তোমাদের মস্ত ছাদে ছিল দুই পাথরের রাজহাঁস
তুমি বলতে ওরা জ্যোৎস্নারাতে জ্যান্ত হয়ে
উড়ে যায় উত্তরের তুষারঢাকা পাহাড়ে,
ভোরবেলা কারুর ঘুম ভাঙার আগেই ফিরে আসে,
তুমি নাকি একদিন সকালে
ওদের ডানায় তুষারের চিহ্ন দেখেছিলে ।

আমাদের একটা আশ্চর্য নদীও ছিল
যে নদীকে কেউ দেখতে পেতো না,
শুধু আমরা জানতাম ঐ নদীর
তীরের বালিতে আছে সোনালি স্ফটিক,
নৌকো নিয়ে ঐ নদীর উৎসের দিকে গেলে
পাওয়া যায় বিশাল এক সোনার পাহাড় ,
আর ওর স্রোতের সঙ্গে নাও বেয়ে গেলে
পাওয়া যায় পারাপারহীন নীলসমুদ্র ।

সেইসব রূপকথা-দিন চলে গেল
কল্পনার নদীর স্রোতের মত তরতর করে ।
তুমি একদিন বিদায় নিয়ে
দূরে কোথায় চলে গেলে,
তোমাদের বাড়ী, বাগান সবই বদলে গেল
কৃষ্ণচূড়া উধাও, রাজহাঁসেরা উধাও-
আমার কল্পনা করতে ইচ্ছে হতো
কৃষ্ণচূড়ারা লালপাহাড়ীর পথ খুঁজে পেয়ে
সেইখানে চলে গেছে মানুষ হয়ে,
আর রাজহাঁসেরা উড়ে গেছে উত্তরে
ওদের সেই প্রিয় তুষারশৃঙ্গে।
কিন্তু ধূলিসংসারের লোহার শলাকা
কল্পনার ডানাকে আহত করে, ক্লান্ত করে
সে উড়াল দিতে পারে না ।

তবু তাকে জল দিই, খাবার দিই
মাঝে মাঝে স্নান করাই-
তাকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে তো !

নইলে তুমি ফিরে এলে-
কেমন করে তোমাকে শোনাবো
যন্ত্রণার রোদ্দুর জমে জমে
কীকরে ঝিকিমিকি সোনালি স্ফটিক হয়েছে?
ঘুম-ঘুম ব্যথা জমে জমে
কীকরে উজ্জ্বল নীল স্ফটিক হয়েছে?
সন্ধ্যেবেলার বিষাদ-মেঘেরা জমে জমে
কী করে রক্তপলাশ ভোর হয়েছে?