Wednesday, November 16, 2011

গিরিব্রজ

জন্মনীড় ছেড়ে, চেনা মাঠ বন নদী পাহাড় ঝর্ণা সব কিছু ছেড়ে উড়াল দিয়েছিলাম, অচিন দেশের দিকে, জ্যোৎস্নাপালকের পাখিরা সেদিকে থাকে। জন্মজলের বিন্দুগুলো ঝরে পড়ে যাচ্ছিলো ডানা থেকে।

অনেকটা পথ ওড়া, নীচে কখনো ডাঙা কখনো জল। তারপরে পৌঁছাই, অচিনগাছে বাসা বাঁধি, ফল ঠোকরাই, খাই আর ভাবি কোথায় সেই জ্যোৎস্নাপালকের পাখিরা? চেনা-চেনা পাখিদের দেখি মাঝে মাঝে, ছোটো ছোটো দলবাঁধা ছাতারে, ওরা সবসময় দলবেঁধে থাকে আর খুনসুটি কি ঝগড়াঝাঁটি করে, ঠোকরায়। ওদের পালকে কেমন যেন দুঃখী ধূসর রঙ! আমি উড়ে পালাই অন্যদিকে।

তবু কেজানে কেন আর কিসের দায়ে বারে বারে ফিরে আসি উত্তরের পাহাড়ে! সব সুখদুখমন্থন করে সেই যে সুপ্রাচীন পাখি গেয়েছিলো নিদ্রাহারা গান, সেই গানের মায়াটানে। আমি সবকিছু এড়াই, তবু একে এড়াতে পারিনা কেন? দুঃখবালি মাখবো না বলে কত পথের আলাপ পথেই রেখে চলে গেছি, ভেতরের ওই অন্ধকার আমার চেনা বলে সেখানে যাই নি কখনো, সুকৌশলে এড়িয়ে গেছি আমন্ত্রণী হাসি। কিন্তু এই পাহাড় কেন ভুলতে পারিনা? কেন এখানে ফিরে আসি বারবার?

নিদ্রালু চোখে চুপ করে বসে থাকি নীলকদম্বের ডালে , বাতাসে ভেসে আসে সেই গান, প্রাচীন পাখি যে গান গেয়ে গিয়েছিলো কতযুগ আগে, কুলহারা সমুদ্রের মত সে গান, দিগন্তে নত হয়ে পড়া আকাশের হৃদয় থেকে ভেসে আসে সেই গান। আমি নড়তে চড়তে পারিনা, চুপ করে ঝিম হয়ে বসে থাকি যেন মহুয়াফুলের মধু পান করেছি আকন্ঠ।

বন্ধুরা বলে এই করেই নাকি আমি মরবো। ওই পাহাড় এক মস্ত ফাঁদ। ওই গানের মায়ায় ভুলিয়ে শিকারী বিঁধবে আমায় তীরে! আমি শুনি, বুঝি, কিন্তু কিছুই করতে পারিনা, যেই না সেই গানের রেশ শুনি বাতাসে, অমনি প্রাণপণে ডানা নাড়তে নাড়তে এসে পৌঁছাই পাহাড়ে, হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বসি নীলকদমের ডালে, তারপরে বুঁদ হয়ে যাই সেই গানে। কোথা দিয়ে যে প্রহরের পর প্রহর কেটে যায়, কোনো হুঁশ থাকে না আমার।

বন্ধুরা বলে, "ওসব মনের ভুল। আসলে কোনো গান নেই। ও মায়া, ও শুধুই মায়া। বাঁচতে চাস তো যাসনে আর ওখানে।"

আমি ওদের কথা শুনিনা, আমি তবু যাই, আমি যে শুনতে পাই গান! অকুল সমুদ্রের মত সে গান, দিগন্তে নত হয়ে পড়া আকাশের হৃদয় থেকে ভেসে আসে সেই গান- কী করে বলি ও সত্য নয়, মায়া?

একদিন পাহাড় থেকে ফিরছি ঘরে, বেশ রাত, দখিনা হাওয়া ঝুরুঝুরু করছে জারুলের ডালে ডালে, রক্তকাঞ্চনের পাতায় পাতায়। আকাশে ফালি চাঁদ বেশ পুরুষ্টু হয়ে উঠেছে, নারিকেলের পাতায় পাতায় পিছলে পড়ছে রুপোগলা আলো। হঠাৎ দেখা হলো এক চেনা পাখির সঙ্গে, আমি অবাক হলাম- সে একা! ওরা তো কখনো একা থাকে না!

সে কুশল সংবাদ জানতে চায়, আমিও জানতে চাই তার কুশলসংবাদ। আমরা কথা বলি পাশাপাশি উড়ে চলতে চলতে, অনেকক্ষণ কথা কই, অনেকটা পথ উড়ি পাশে পাশে, একসময় সে বিদায় চায়, অন্যপথে উড়ে যায় একা একা--আমি আবার ভাবি এ কেন একা ছিলো আজ? ওরা তো কখনো একা থাকে না!

তারপরে ভাবনাচিন্তা মুছে ফেলে টলটলে জলের দিঘির উপর দিয়ে উড়ে যেতে যেতে দেখি জলের ভিতরে চাঁদ! আমার মতন আরেক পাখিও উড়ে যাচ্ছে জলের ভিতর দিয়ে। জলের ভিতরে কি আরেক দেশ আছে? চেনাজানা সবকিছুই কি সেখানে আছে উল্টা হয়ে?

কনকনে একটা হাওয়া কোথা থেকে এসে আমায় ছুঁয়ে যায়! এখন তো এই হাওয়ার সময় নয়! এ তো সেই নিঠুর হাওয়া যা ধারালো ক্ষুরের মতন বনের সব পাতা ঝরিয়ে দেয়! এখন এ হাওয়া এলো কোথা থেকে? সেই অদ্ভুত অকাল শীতবাতাসের ঝাপটা চোখেমুখে নিয়ে ফিরে আসি বাসায়, কোমল আস্তরণের মাঝে সঁপে দিই নিজেকে, উষ্ণ পালকের মধ্যে মুখ গুঁজে চোখ বুজি। আধোঘুমে আধোজাগরণে ভাবি কোথায় থাকে সেই জ্যোৎস্নাপালকের পাখিরা?

কিন্তু ঘুম আসে না চট করে। চোখ মেলি। হাওয়া শন্‌শন্‌ করে বয়ে যায় বনের ভিতর দিয়ে, চাঁদের রূপালী আলো চিকমিক করে ঝোরার জলে, ঝুঁকে থাকা ফার্ণের পাতায় জলের বিন্দু লেগেছে, তাতেও ঝিকমিক করে জোছনা। আমার মনে পড়ে বহুদূর উষ্ণ দেশের বনকুঞ্জের কথা, তাতেও এমন জ্যোৎস্না পিছলে পড়তো শুক্লপক্ষ রাতে। ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে যাই।

দেখি এক আশ্চর্য গাছ, পাহাড়ের উপরে। মস্ত বড়ো সেই গাছের মাথা যেন হারিয়ে গেছে আকাশে। মেঘ ফুঁড়ে, আকাশ ফুঁড়ে কোথায় যে চলে গেছে কত উপরে কিছুই বুঝতে পারিনা। শিকড় তার নেমে গেছে কত নীচে মাটির কত গভীরে- তাই বা কেজানে! হয়তো চলে গেছে পাতালে, ঝিমঝিমে দুপুরের ঘুমঘুম বাসায় মায়ের ঘুমপাড়ানি গল্পে যে পাতালের রাজ্যের কথা শোনা যেতো। কেজানে!

গাছের এক ডালে ছিমছাম এক ছোট্টো বাসা। হেলাফেলার খড়কুটোকাটার বাসা না, অচেনা উদ্ভিদতন্তু দিয়ে বহু যত্নে বোনা বাসা, সোনালী তার দিয়ে মজবুত করে বাঁধা, ভিতরে নরম তুলোর আস্তরণ। সেই বাসায় বসে তাকাই আকাশের দিকে, খোলা আকাশ ছড়িয়ে আছে অনেক অনেক দূর, নীল আকাশে রোদ্দুর আর মেঘেরা লুকোচুরি খেলে। পাখির দল উড়ে যায় মাঝে মাঝে। ওদের কথাবার্তার টুকরো-টাকরা মাঝে সাঝে এসে পৌঁছায় আমার কাছে, কখনো বা বাতাসে উড়ে যায় অন্যদিকে।

উপরে তাকাই, গাছের শেষ মেলে না, নীচে তাকাই, গাছের শেষ মেলে না। এর মাঝখানে বসে থাকি সাধের বাসায় আমার, ভাবি এই বুঝি বাতাসে ডানা ভাসিয়ে ভাসিয়ে এলো জ্যোৎস্নাপালকের পাখি! ভাবতে না ভাবতেই মস্ত পুচ্ছে অজস্র ঝলমলে রঙ আর মস্ত দুই ডানায় রঙধনু ঝলকিয়ে উড়ে এসে নামলো এক অচিনপাখি! আকাশের বিদ্যুতের মতন তীব্রোজ্জ্বল তার রূপ, সমারোহ ধরে না।

সে পাশের ডালে বসে আমার দিকে চেয়ে হাসলো, বললো, "তুমি কোথাকার ? এখানে, এই গাছে আগে তো তোমায় দেখিনি!"

উত্তেজনায় ধকধক করে হৃৎপিন্ড, কোনোরকমে আমি বলি, " আমি তো এই সেদিন এলাম। আগে এখানে ছিলাম না তো! দেখবে কেমন করে? তুমি কে? তুমিই কি জ্যোৎস্নাপালকের পাখি?"

সে হাসে, নির্মেঘ আকাশে যেন বিদ্যুতের সমারোহ জাগে সে হাসিতে--- হাসি থামলে সে বলে, " আমি এইখানে থাকতাম। বেড়াতে গেছিলাম দূরের দেশে, ফিরে এসে তোমার বাসা দেখে অবাক হয়েছি।"

আমি অবাক, বলি," তুমি এইখানে থাকতে? কই, তোমার বাসা তো দেখিনি!"

সে বলে, "আমার তো বাসা নেই। আমি বাসা গড়ি না। গাছের ডালে থাকি আর আকাশে আকাশে উড়ে বেড়াই। বাসা গড়ে কী হবে?"

আমি বিস্ময়ে চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে থাকি, সেই অদ্ভুত কনকনে ঘুম ভেঙে যায়। আহ, সব স্বপ্ন! এত স্পষ্ট স্বপ্ন ? অফুরান সেই গাছ, ঝলমলে সেই পাখি, সব স্বপ্ন? যাঃ।

ছলছলে রূপালী জ্যোৎস্না আরো তীব্র এখন, এর মধ্যেও যেন স্বপ্নাভা লেগে আছে। একা জেগে বসে থাকি বাসায়। সর্বচরাচর ঘুমিয়ে আছে, কী অসীম নিতল রহস্যে ভিজে আছে সবকিছু!

***

পাশের ডালে একটা বাসা, সেখানে থাকে এক ভিনদেশী পাখি। সে কথা বলে না বিশেষ, কতটুকুই বা দেখা হয় আমাদের! আমি উড়ে বেড়াই, খাবার খুঁজে বেড়াই, ঝুপ করে জলে পড়ি মাছ ধরার জন্য-বেশ স্নানও হয়ে যায়! নয়তো পাহাড়ে যাই, সেই অলৌকিক গানের পাহাড়! শুধু ফিরে আসি রাত্রের ঘুমটুকুর জন্য।

পাশের বাসার পাখির সঙ্গেও তাই তেমন আলাপ-পরিচয় হয় নাই। সেতো বেশী কথাও বলে না, নইলে হয়তো নিজেই এসে একফাঁকে বন্ধু হয়ে যেতো! অবশ্য আমি নিজেও যেতে পারতাম বৈকি! কিন্তু সে কিনা ভিনদেশী, হয়তো তার কথাও সহজে বুঝবো না! কী দরকার বাপু ঝামেলার! তারচেয়ে যেমন আছি, তেমনই থাকি! এইসব ভেবে ভেবে আর আলাপ-পরিচয় তেমন হয় নি! আজকের স্বপ্নভাঙা রাতে হঠাৎ মনে হলো বন্ধুত্ব থাকলে মন্দ হতো না!

নেশাধরানো জ্যোৎস্নায় ডুবে আছে সবদিক। আমি উপরে তাকাই, অফুরাণ আকাশে চাঁদের আলো ছাড়িয়ে আছে হাওয়াহাল্কা রুপোলী জরির ওড়নার মতন, ফুটকি ফুটকি কয়েকটা তারাও জ্বলছে। চাঁদনি রাতে বেশী তারা দেখা যায় না, যে রাতে চাঁদ থাকে না, সেই নেইচাঁদ রাতে আকাশে তারায় তারায় ঠাসাঠাসি লেগে যায়।

ভিনদেশী ডানা ঝাড়া দেয় ওর বাসায়, সেও জেগে গেছে। আমি ছোট্টো করে ডাক দিই।

"এই যে শুনছেন, আপনি কি জেগে আছেন?"

ঘুমঘুম গলায় সে বলে, "জেগে গেলাম, আপনিও জেগে যে!"

" আমি ঘুমিয়েছিলাম, ঘুম ভেঙে গেল। জেগে উঠে অবশ্য লাভই হলো। এমন জ্যোৎস্না!!! আপনি আগে দেখেছেন এমন আশ্চর্য জ্যোৎস্না? " আমি আবিষ্ট গলায় বলি।

সে উদাসীন গলায় বলে, " কত দেখেছি, খোলা মাঠের ধারে গাছে বাসা বেঁধে থাকতাম, সে গাঁয়ের মাঠের দুধেল জ্যোৎস্না দিকদিগন্ত ভাসিয়ে দিতো। এ আর এমন কী জ্যোৎস্না!"

আমি একটু ক্ষুব্ধ হই, বলি, "তাই নাকি? কোথায় সে গাঁ?"

এবারে ওর উদাসীন স্বরে দু:খ মিশে যায়, দক্ষিণের দিকে ডানা ছড়িয়ে দিয়ে সে বলে, "ওওওও ই দিকে। অনেক পাহাড়, বন, নদী, মাঠ, ঘাট, ঝর্ণা পার হয়ে ছিলো আমাদের গাঁ।"

" ছিলো? এখন আর নেই?"

" নাহ, সে গাঁ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বনে আগুন লাগলো তো! বিরাট দাবানল। সবাই পালিয়ে গেলো। আমরাও।"

আস্তে করে বলি, " আমি জানতাম না, মাফ করে দিন। আপনার দু:খ হবে জানলে আমি কখনো জিগ্গেস করতাম না।"

"নাহ, মাফ চাইবার কী আছে? আর, এতদিন পরে আজ আর দু:খ কিসের? ছিলো সেদিন দু:খ, যেদিন আমাদের সদ্য ডিমফোটা চারটি অসহায় শিশু আগুনে পুড়ে গেলো। ওদের মা চাইছিলো না ওদের ছেড়ে আসতে, কিন্তু ওরাই বললো নিজের শক্তি থাকতে কেন পুড়ে মরবে মা? পালাও। আমরা পরের বছরেই আবার তোমাদের ঘরে ফিরে আসবো নতুন হয়ে। "

আমি স্তব্ধ হয়ে যাই, চুপ করে চেয়ে থাকি ওর দিকে। সে একটুক্ষণ থেমে থাকে, তারপরে আস্তে আস্তে বলে, " ওদের মা পালিয়ে এসেছিলো আমার সঙ্গে, কিন্তু সন্তানশোক সইতে পারলো না, অসুখ হয়ে মরে গেলো। আমি বেঁচে রইলাম, একা একা। ভুলতে চেষ্টা করি, খাই দাই বেড়িয়ে বেড়াই, কিন্তু ভুলতে পারিনা। "

আমি কী বলবো বুঝতে পারিনা, এ কী ভয়ঙ্কর কাহিনী! আমার ইচ্ছে করে কিছু সান্ত্বনার কথা বলি ওকে, এমন কিছু যা ওই ভয়ানক দু:খের কিছুটা হলেও প্রশমন করে! কিন্তু কিছু বলতে পারিনা। বোবা হয়ে বসে থাকি। সব ভাষা যেন ভুলে গেছি, যেন কোনো বাক্য শব্দ কিছুই ছিলো না আমার কোনোদিন!

এমন সময়! ঠিক সেই মুহূর্তে! আকাশভরা জ্যোৎস্নাকে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন কাঁপিয়ে দিয়ে বেজে উঠলো সেই অলৌকিক সঙ্গীত! সেই সব সুখদুখমন্থন করা গান! নিদ্রাহারা, কুলহারা গান! সুপ্রাচীন অলীক পাখির সেই গান!

আমি কানখাড়া করি, সেও করে। শুনতে পেয়েছে, সেও শুনতে পেয়েছে! মায়া নয়, মায়া নয়! সে আমার দিকে তাকায়, বলে, " গান? কোথায় হচ্ছে? আপনি শুনতে পাচ্ছেন?"

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলি। বলি, " আমার এখনই যেতে হবে, ওই পাহাড়ে, ওখান থেকে ভালো শোনা যায়।"

সে বলে," আমিও যেতে চাই, আমাকে সঙ্গে নিন।"

আমরা দুজনে উড়াল দেই, জ্যোৎস্নাভরা আকাশ দিয়ে ভেসে চলি গীতপাহাড়ের দিকে, দু:খজল শিশিরের মতন ঝরে যায় আমাদের ডানা থেকে। আমাদের চারিপাশে উপরে নীচে ছড়িয়ে যেতে থাকে অনন্ত রাত্রির পালক, সীমাসংখ্যা পেরোনো পালকেরা, তার নরম ওমের মধ্যে নিজেদের সমর্পণ করে দিয়ে বসি নীলকদমের ডালে। আকাশ ভরে, বাতাস ভরে, জলস্থলের হৃদয় ভরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সেই অলৌকিক সুরের সুধা-- "বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা/ জাগে অসীম নভোমাঝে অনাদি সুর ......"

( শেষ )

ইচ্ছে-জলফড়িং

হেমন্তের দিন গুলোকে বিষাদবিধুর বলেন জ্ঞানীগুণীরা অনেকে। দিন ছোটো হয়ে যায়, আলো পাওয়ার সময়টুকু কমতে কমতে কমতে কমতে কেমন একটা মনকেমন রেখে যায়, বিরাট বিরাট গাছেদের সব সবুজ পাতাগুলো দেখতে দেখতে বাদামী লাল কমলা হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে যেতে থাকে, ন্যাড়া গাছেরা নাঙ্গা সন্ন্যাসীর মতন স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকে উদাসীন নীল আকাশের নিচে। এমন সব দিনে মানুষের মন ও নাকি কেমন বিষাদনীল হয়ে যায়।

দরজাবন্ধ হয়ে যাওয়া ঘরের মতন লাগে মনটা। তাই নিয়েই আসি যাই ঘুরে বেড়াই, দৈনন্দিনের দাবী তো না মিটালে চলে না। নতুন কোনো লেখা আসে না কলমে, আসে না মনে, অন্যদের লেখাপত্তর পড়ি- এখনকার মানুষের লেখা, অনেক বছর আগের মানুষের লেখা, আগে যেসব লেখা পড়ে ভালো লেগেছে, আনন্দ হয়েছে সেসব লেখা। কিন্তু কিছুই যেন যায় না ভিতরে, ঝরে যাওয়া পাতাদের মতন ঝরে যায়, উড়ে যাওয়া হাঁসেদের ডানা থেকে ঝরে যাওয়া জলবিন্দুর মতন ঝরে যায়।

সেই অলৌকিক ইচ্ছেরা কই? ওরাই তো টান দিয়ে বার করতো বাইরে, ওরাই তো দেখাতো আলো দেখাতো ছায়া দেখাতো মেঘেরোদে জড়াজড়ি খেলা। সেই মেঘ সেই রোদ তো আছে, সেই আকাশও তো একই, তবে ইচ্ছের সেই পক্ষীরাজ কোথায়? সে কি আসে আর যায়, ধরা দেবে না?

এই তো একটা ইচ্ছে কেমন আলোয় ছায়ায়
খাতার পাতায় দু'এক টুকরো আঁচড় কাটায়-
সময়বেড়া টপকে গেছে সফেদ ঘোড়া
ঐ ওপাশেই ঝিণুকবাগান বর্ণচোরা,
এই তো আবার চোখ ঢেকে যায় বৃষ্টিধারায়
ইচ্ছেগুলো জলফড়িং এর সঙ্গে পালায়।

আবার দেখি রোদ পড়েছে ছিন্নপাতায়
বৃষ্টিধোয়া ছবির মাঠের রঙীন ছাতায়,
ঐ তো আসে দু'পাক খেয়ে ঝিলিকভ্রমর
কানের গোড়ায় স্পষ্ট শুনি গুঞ্জনস্বর
এই তো আবার চোখ ঢেকে যায় ঝড়ের ধূলায়
স্বপ্নদুপুর দুদ্দাড়িয়ে দৌড়ে পালায়।

***