Friday, June 27, 2014

ক্ষমা

আমার ছোট্টো নদীটা হারিয়ে গিয়েছিল
হারানোর আগে ওর নাম ছিল ক্ষমা-
মধ্যগ্রীষ্মের প্রচন্ড বালিঝড়ে একদিন
নদীটা নেই হয়ে গেল ।

শুধু রয়ে গেল একটা আঁকাবাঁকা রেখা,
ঐখান দিয়ে একদিন ক্ষমা বইতো,
এখন সেখানে মরুবাতাস ঝিং ঝিং
করে বয়ে যায় বালির ছররা ছড়িয়ে।

শীর্ণ কাঁটাঝোপের পাশে
জীর্ণ পাথর-ঘরে
আমি অপেক্ষায় থাকি তবু।
যদি সে ফেরে কোনোদিন।
সে ফেরে না।
দিন যায় মাস যায় বর্ষ ফুরায় কত
হারানো নদী আর ফেরে না।

তারপর একদিন-
দুপুরের সূর্যের জ্বলন্ত মুখ ঢেকে দিয়ে
আকাশ ভরে এলো বর্ষণসম্ভবা মেঘেরা-
বৃষ্টির করুণাধারা ঝরতে থাকলো
ঝরতে থাকলো ঝরতে থাকলো -
সমস্ত বিকেল, সন্ধ্যে, রাত্রি।

সকালে উঠে দেখি
ফিরে এসেছে হারানো নদী,
ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভোরের আলোর ঝিলিক-
আকুল কলরোলে গাথাসপ্তশতী।

শুধু-
ওর বুকে একখানি ক্ষত-
এক চিলতে লাল স্রোত,
তাকে ঘিরে দুটি নীল ধারা,
নীল ব্যথার মত।

তবু সে ক্ষমা, ক্ষমা, ক্ষমা-
সীমানাহারা সমুদ্রসমা ক্ষমা-
গহীনের আরক্ত ক্ষত ও নীল বেদনা ঢেকে
আদিগন্ত বইছে অনন্ত প্রিয়তমা ।

Tuesday, June 24, 2014

অনন্ত বাতিঘর

1

এই ঘরগুলো আশ্চর্য, ভারী অদ্ভুত। এরা নিজেদের আকার বদলায়, রঙ বদলায়। গোটা বাড়ীটাই নিজের আকার আকৃতি বদলায়। কখনো মুহুর্মুহু বদলায়, কখনো ধীরে। গতকাল আমার ঘরটা ছিলো চৌকো, ছাদটা ছিলো বর্গাকার। এখন ঘরটা চতু:স্তলকীয়, ত্রিভূজাকার দেয়ালগুলো ঐ উপরে একটা বিন্দুতে মিশে গেছে, কোনো ছাদের প্রয়োজন হয়নি আর। দেয়ালগুলোর রঙও বদলে গেছে, গতকাল ছিলো হালকা সবুজ, ভিতর থেকে স্বচ্ছ আর বাইরে থেকে অস্বচ্ছ। আজ তারা নীলকান্তমণির মতন নীল, দুপাশ থেকেই অস্বচ্ছ।

সবকিছু নিজেদের বদলে ফেলে এখানে, ভারী অবাক লাগে আমার। হয়তো অবাক হওয়া উচিত না। আমার অবশ্য কোনো অভিযোগ নেই, আমার মাঝে মাঝে মজারই লাগে। এত বৈচিত্র!

শুধু দেয়ালের রঙ বা আকারই তো না, জানালা দরোজাও বদলায়। কোনো কোনো দিন কোনো দরোজাজানালাই দেখতে পাই না, ভয়ে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে, ক্লসট্রোফোবিক লাগে। তখুনি ছোট্টো একটা দরোজা দেখা দেখা দেয় কোনো এক দেয়ালে, আমি স্বস্তির শ্বাস ফেলি। হালকা সুগন্ধী হাওয়া বয়ে যায় আমার মুখচুল ছুঁয়ে, বেলীফুলের গন্ধ হাওয়ায়। আমার মন হালকা হয়ে যায়, আনন্দের বৈদ্যুতি বয়ে যায় আমার ভিতর দিয়ে।

যেন ঘরগুলো বুঝতে পারে আমার মন, আমার সাথে খেলতে চায়। কখনো কখনো আমার ভালোই লাগে খেলতে, কখনো কখনো চাপা টেনশনে কিছুই ভালো লাগে না। তখুনি এরা খেলা বন্ধ করে দেয়, আমার মন শান্ত করে দেবার কিছু একটা করে। এরা কি আমার জন্য ভাবে?

আজকের নেপথ্যসুর ভারী নরম একটা সুর, বুঝতে পারিনা কি বাজনার সুর, ভারী ভালো লাগে। কখনো মনে হয় বেহালা, কখনো বাঁশী, কখনো জলতরঙ্গ। বাতাসে আজ জুঁই ফুলের গন্ধ।

এখানে অনেক সার্ভিস রোবট, এরা আমার সমস্ত প্রয়োজনের সময় সক্রিয়। মায়াও এদের মাধমেই আমার সাথে যোগাযোগ করেন। রোবটদের কেউ কেউ দেখতে একেবারে মানুষের মতন, কেউ কেউ আবার খুব যান্ত্রিক চেহারার। ধাতব চেহারার রোবট আছে, ক্রিস্টালাইন রোবট আছে।

মায়ার বার্তা নিয়ে আজকে এলো কিরা, কিরা দেখতে মানুষের মতন, মিষ্টি নরম চেহারার একটি মেয়ে, হালকা বাদামী চুলগুলো এলোমেলো, মুখে একটা নরম হাসি। কিরার হাসিটা কেন জানি খুব চেনা লাগে। কোথায় দেখেছিলাম এই হাসি? মনে পড়ে না, আগের অনেক কথাই ভুলে গেছি। তবু মনেও তো আছে অনেক কথা! যা ভুলতে চাই তা ভুলতে পারিনা, অথচ যা ভুলতে চাই না তা গেছি ভুলে।

কিরা আমাকে মায়ার বার্তা জানালো। মায়া আমার সঙ্গে দেখা করতে চান, ঠিক ন'টার সময় আমার যেতে হবে মায়ার কাছে। মায়ার সামনে কেন জানি সবসময় আমি কেমন অস্বস্তি বোধ করি। আমি জানি না কেন এমন হয়। মায়া খুব স্নিগ্ধ, শান্ত চেহারার, যতবার আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে প্রত্যেকবার ভালো ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কিছুতেই আমি মায়ার সামনে সহজ হতে পারিনা, অদ্ভুত এক টেনশন আমার মনটাকে পেঁচিয়ে ধরে।

মায়ার উপস্থিতির তাপ আবছাভবে আমাকে মনে করিয়ে দেয় কোনো একজনের কথা, একজন যাকে আমি খুব ভয় পেতাম, যাকে আমি খুব ভালোবাসতাম, যাকে আমি প্রচন্ড ঘৃণা করতাম, যাকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করতাম, যাকে ছাড়া থাকতে পারতাম না আবার যাকে একমুহূর্ত সহ্য করতে পারতাম না। এইসব বিপরীত আবেগের অসম মিশ্রণ আমার মধ্যে ঘুলিয়ে ওঠে, আমার মাথা ঘুরায়, সবকিছু কেমন ঘোলাটে লাগে। মায়ার কাছে যেতে ইচ্ছে করেনা, কিন্তু তবু তৈরী হতে থাকি। আমার ইচ্ছা অনিচ্ছায় কিছু এসে যায় না, মায়ার যেকোনো নির্দেশই এখানে শেষকথা।



তৈরী হয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। আমার ভাবনা বুঝতে পেরে স্বচ্ছ হয়ে যায় জানালা। বাইরে ঝকঝকে রোদ্দুরে হাসছে লাল পাতাওয়ালা গাছের বাগান।  পৃথিবীর হেমন্তের কথা মনে পড়ে, যদিও এইসব গাছের পাতারা সবসময়েই লাল।

 রাতে অজস্র তারাওয়ালা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে প্রথম যেদিন আমাদের সূর্যকে দেখেছিলাম ক্ষুদ্র টিমটিমে একটি আলোকবিন্দুর মত, সেদিন কেমন একটা আশ্চর্য অনুভব হয়েছিলো! বুঝতে পারিনি সেটা কী। সে কি অভিমান, সে কি দুঃখ, নাকি সে অনাসক্তি?

পৃথিবীতে আমরা সংগ্রাম করেছিলাম স্বৈরতন্ত্রের বিরূদ্ধে, টোটালিটারিয়ান সমাজব্যবস্থা আমরা চাই নি। আমরা জীবনের শেষ মুহূর্তটুকু পর্যন্ত দিতে তৈরী ছিলাম সে সংগ্রামে। সমান অধিকার আর চিন্তার স্বাধীনতা ছিলো আমাদের কাছে সবচেয়ে বড়ো জিনিস।

এখানে সবকিছু অন্যরকম লাগে, মাঝে মাঝে অদ্ভুত একটা শীতে ভেতর পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। মানুষ এখানে প্রযুক্তিতে এত অগ্রসর আর এত দ্রুত আরো আরো অগ্রসর হয়ে চলেছে যে আমার পক্ষে বুঝতে পারাও সম্ভব না সবটা। আমি সবটা বুঝতে চেষ্টাও করি না। শুধু একটা জিনিস কাঁটার মতন খচখচ করে ভিতরে। কিছুতেই বুঝতে পারিনা, কেন এই মানুষেরা এত শান্ত, এত বাধ্য, এত নি:শব্দ আজ্ঞাবাহী? কেন তারা একটাও প্রশ্ন করে না, কেন তারা একটাও নতুন সাজেশান দেয় না?

যত পার্টিতে সভাসমিতিতে আনন্দোৎসবে গেলাম, সর্বত্র একই জিনিস দেখলাম। ঠান্ডা বাধ্যতা, শান্ত আনুগত্য। বিদ্রোহের একটা ছোট্টো ঝিলিক কারুর চোখের ভিতরে দেখার জন্য কী যে তৃষার্ত হয়ে থাকে আমার সারাদেহমন! একটা ছোট্টো সোনালি ঝিলিক শুধু যা এই নীরব মাথাকাত করা আনুগত্যের শৈত্য দূর করে দেবে। কোথাও দেখিনি। শুধু আরো আরো আরো শীতে কেপে উঠেছে আমার মেরুশিরা।

মায়ার কাছে যাবার সময় এগিয়ে আসছে, সেই অদ্ভুত শীত আবার আমার ভিতরে ফিরে আসছে। একটা নাম না জানা অস্বস্তি, ভয়। যেতে ইচ্ছে করে না, একদম ইচ্ছে করে না। কিন্তু উপায় নেই, যেতেই হবে। মায়ার কথার নড়চড় হয় না এখানে, হবে না কখনো। আহ, কতদিন আমিই বা মায়ার মায়াজালের বাইরে থাকতে পারবো? একদিন না একদিন ধরা পড়তেই হবে।

এবারে ঘরে মায়া একাই ছিলেন। অন্য যেসব দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে, সেসব সময়ে সবসময়েই আরো লোক ছিলো ঘরে। এবারে মায়া একা আর আমি তার সামনে। দু'জন একা, মুখোমুখি।

মায়ার ঘর আমার কাছে সবসময়ই ম্যাজিকম্যাজিক লাগে। কখনোই ও ঘরে কোনো দেয়াল দরজা জানালা কিছু চোখে পড়ে নি, শূন্যতার অনুভুতিও হয় নি কিন্তু। একধরনের আশ্চর্য আলো আর সঙ্গীতে পূর্ণ সে ঘর। বুঝতে পারিনা দাঁড়িয়ে আছি না ভেসে আছি। যেন ভিন্ন মাত্রা, যেন চেনা জগতের কিছু না সে, যেন একটা ভিন্ন বাস্তবতা যার সঙ্গে আমার সীমাবদ্ধ ত্রিমাত্রিক অনুভূতি পাল্লা দিতে পারে না।

সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা ভালোবাসা-ঘৃণা তিতিক্ষা-জিঘাংসার বন্যায় ডুবে যাবার আগে কুটোর মতন হাত বাড়িয়ে ধরি স্মৃতি। কী হয়েছিলো মায়ার কাছে আসার আগের পথটুকু? হাসিমুখ কিরা আমাকে পাশে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলছিলো, একটা সবুজ দরজা খুলে গেল, আমরা একটা আলোছায়া ঝিলমিল করিডর ধরে যাচ্ছিলাম। চারিপাশে কী ছিলো, সবুজ দেওয়াল নাকি খোলা আকাশ?

আমি শিউলির গন্ধ পাচ্ছিলাম, অনেককাল আগের এক ভুলে যাওয়া শরতের ভোরের হাওয়া আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো আমি যেন অনন্তকাল পথ চলছি, চলছি, চলছি। দিন আসছে, রাত আসছে, বাঁকা চাঁদ পূর্ণ থালার মতন গোল হয়ে উঠছে, আবার ক্ষইতে ক্ষইতে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে।

একটা বাঁক ঘুরে দৃশ্য বদলে যায়। এগিয়ে আসে ইলক আর সেডিনা- ওদের চিনি। ওরা ক্রিস্টালাইন চেহারার রোবট। ইলক পুরুষ, সেডিনা মহিলা, মানে সেরকম দেখতে। মূর্তির মতন চেহারা হলেও দুজনেই হাসিখুশী, ভারী আন্তরিক মনে হয় ওদের। এখানে কোনটা যে বাস্তব আর কোনটা যে অন্যকিছু বুঝে উঠতে পারিনা। ইলক আর সেডিনার হাতে আমাকে দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল কিরা।

(To Be Continued)

The Great Cycle

There were six chairs around the neat circular table at the center of the room. The room was strange, a shiny tetrahedron. Aron, Ena, Lamex, Geia, Tamaril and Talisa entered and took their seats.

Each of them had stony face, lips tightly shut, eyes half closed. They were in half-trance state. Everybody kept their right hand on the table, one on another, six hands made a little column on the table.

Everyone now fully opened their eyes, bright shiny eyes focused to the center of the table where their right hands met. Then six voices arose to sing in harmony, they sang a mysterious ancient hymn together. Then they said , “Let it be done, let it be done, let it done.” After that, all of them fell back to a deep trance of meditation.

After an hour or so, they rose from the meditation and removed their hands from the table. One by one they stood up.

Aron looked at Talisa and gently said, "We’ll meet again. Isn’t it Talisa?"

Talisa held Aron in her soft, lovely eyes and smiled. She said, “ Sure. We’ll meet again."

Aron said, " Do you remember Talisa, long ago, we just talked like that? Just before I left for planet Alpha?"

Talisa said quietly, "Yes, I remember. It was after the convocation. You got a job on planet Alpha. That day you just told the same thing, we’ll meet again, isn’t it? "

Talisa and Aron laughed together.

Aron said, "You were so gloomy that day, when I departed. But next year you came to Alpha to join the same job."

Talisa smiled and said, "I tried my best to find a job on planet Alpha. But I was not hopeful at all. There were so many uncertainties! But you know that I finally managed to get a job there. It was a result of some unexpected chain of events, I guess. But this time, I’m sure, absolutely sure."

Tamaril looked at Geia, he wanted to say something, but didn’t say anything finally. Tamaril was very shy from the beginning. For a long time he was a close friend of Geia, but never could say anything more than just friendly words. But Geia knew that Tamaril loved her.

Geia smiled and held Tamaril in her deep, black eyes. Love-light made them so beautiful! She thought, will Tamaril be so shy in new life, too?

All six of them walked quietly towards the room reserved for them. There each of them lied down on assigned bed and sank into deep sleep. Their neuronic information were mapped in details. All of those recorded information went to the Central Bureau of Information. Everything were stored into the sub-atomic machines with great care.

All six of them died just after this recording and their dead bodies were cremated. But that death was not the end for these people since their minds were securely stored into the machines. When those information will be restored, they will rise again in the new world, in a new life.

Their universe was old, very old, about a trillion years old. It was going towards the absolute zero temperature at the end of its life. In that cool, darkened universe, there will be no usable energy and all life-forms, intelligent or not, will surely die. All civilizations will end.

Those six people were selected to contribute their minds and intelligence to the ultimate restoration project. Their civilization, however high it might be, will be destroyed along with their universe. But these stored data might survive if it could be transmitted elsewhere. Eventually that could begin a new civilization in new universe.

They had very advanced technology available, their civilization itself was many billion years old. All the accumulated knowledge and technology of millions of years enabled them to make the project a reality.

The data was stored inside subatomic machines. Those machines were successfully transmitted through the wormhole to enter a new, young, warm universe.

In the new Universe those machines found habitable planets with good natural resources to be utilized. Those machines used those raw materials to prepare organic molecules including DNA. Then they used the stored information to clone those six beings. New Aron, Ena, Lamex, Geia, Tamaril and Talisa were created again to begin a civilization again.



(Cont)

Saturday, June 21, 2014

উশীরস্রোতা

১।

সৃঞ্জয় বললো, " কী, কেমন লাগছে এখন ? "

ভোরের হাওয়া ঠান্ডা বেশ, আমি স্কার্ফটা গলায় ভালো করে জড়াতে জড়াতে হেসে বলি, " ভালো লাগছে। এখন বেশ ভালো লাগছে। আসলে কালকে একটু বেশী আবেগের পাল্লায় পড়ে গেছিলাম। এখানে আসা যেন একটা স্বপ্নের মতন ব্যাপার, কে জানতো এভাবে এখানে আসা হবে? "

সৃঞ্জয় হাসে, আমি আরো চওড়া করে হাসি। কী আর করার আছে এখন? বিস্ময় এত বেশী যে কোনো কথা দিয়েই তা প্রকাশ করা সম্ভব না।নিজের বাচ্চাবয়সের কথা মনে হয়, তখন প্রত্যেকটা দিন এমন অমলীন বিস্ময়ে ভরে থাকতো, কী পালকের মতন হাল্কা ছিলো সেই জীবন!

এখানে দুপুরবেলাগুলো খুব গরম। তাই খুব ভোরবেলাতেই আমরা সেতু পার হয়ে এসেছি নদীর পশ্চিমে। এই নদীর বর্তমান নাম উশীত্থা। সুপ্রাচীনকালে এর নাম ছিল উশীরস্রোতা। সুগন্ধি উশীর তৃণ জন্মাতো এর তীরে। এখন নদীটা প্রায় শুকনো, বালি-বালি খাতের ঠিক মাঝখান দিয়ে সরু একটা জলস্রোত ধীরে ধীরে বয়ে যাচ্ছে। তবে বর্ষায় উত্তরে ঢল নামলে নাকি জল অনেক বাড়ে, তখন গোটা নদীখাতটাই ভরে ওঠে। নদীর উপরে পাকাপোক্ত ব্রীজ, গাড়ী চলতে পারে। ও পথেই এসেছি আমরা। আমাদের সারথী এখানকার স্থানীয় একজন লোক, হোটেল থেকেই আমাদের জন্য ঠিক করে দিয়েছে এই গাড়ী আর ড্রাইভারকে।

এখন আমরা গাড়ী থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছি নদীর পশ্চিমপারে। সামনেই নীল আকাশে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের পর পাহাড়। বাদামী, কালো, ধূসর বা বালিরঙ পাহাড়। ঋজু, উদ্ধত, কঠিন, শিলাময়, বৃক্ষবিরল পাহাড়ের সারি। এখানে জমিও খুব শুকনো, গাছপালা প্রায় নেই, মাঝে মাঝে একরকম কর্কশ ঘাস আর কন্টকগুল্ম দেখতে পাই।

কাছেই একটা ছোটো বাজারমতন, সেখানে পথের পাশের চায়ের দোকানে সবে উনুনে আগুন দিয়েছে। চা আর কিছু খাবার অর্ডার দিয়ে দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চিতে বসি আমরা। আমাদের অবাক করে দিয়ে খুব তাড়াতাড়িই এসে যায় চা, খাবার। সূর্যোদয়ের সময় হয়ে গেছিল, চা খেতে খেতেই দেখি পাহাড়ের চূড়াগুলো সকালের আবীরলাল আলোয় রঙীন হয়ে উঠে উঠে তারপরে গোলাপী থেকে সোনালী হয়ে উঠলো।

খাওয়া শেষ হলে আমরা রওনা হই সমাধি-পাহাড়ের দিকে। সম্রাজ্ঞীর খোঁজে যেতে হলে ঐখানেই তো যেতে হবে। সমাধি পাহাড়েই পরজীবনের প্রাসাদ। কয়েক হাজার বছর আগে রাণী সপ্তাশ্বসুতা তৈরী করিয়েছিলেন নিজের আর প্রিয়জনেদের জন্য। পার্থিব জীবনের সামান্য সময়টুকুর পরে বিস্তৃত যে অনন্ত জীবনকে তাঁরা জানতেন, সেই জীবনের জন্য।

সেখানে পৌঁছে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি সেই সুপ্রাচীন প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের সামনে। সপ্তাশ্বসুতা! মহারাণী, সম্রাজ্ঞী! সম্রাজ্ঞী নিজেকে বলতেন সূর্যসম্ভূতা। স্বয়ং সূর্যদেব নাকি নেমে এসে তাঁর পিতার মধ্যে প্রবেশ করে তাঁর জননীর সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁকে সৃজন করেছিলেন। প্রাচীরের চিত্রমালায় সেই মহাপবিত্র ঘটনার কিছু কিছু ব্যাপার নাকি খোদাই করে রাখা হয়েছে।

আসলে কেমন ছিল সে? কেমন করে সে ভাবতো, হাঁটতো, সাজতো, কথা বলতো? কেমন করে কাটতো তার গ্রীষ্ম বর্ষা শীত বসন্ত? কোনোদিন, সেই হাজার বছর আগে, তার কিশোরী বয়সে এইরকম কোনো সকালে সে কি তার কোনো চাহনেওয়ালার কথা ভাবছিলো? পুরানো পাথরের টুকরোয় কিংবা প্রাচীরে বা মেঝেয় আঁকা ছবিতে অথবা লেখা কাহিনিতে কি সময় আটকে থাকতে পারে? ধরা দিতে পারে পূর্ণ, সজীব, স্পন্দিত সেই হারানো জীবন?

সেই মেয়েটিকে দেখতে চাই, সেই সূর্যসম্ভূতাকে। খুবই কি আশ্চর্য আর অন্যরকম ছিলো সে? একদম শৈশব থেকে ? নাকি সেই শৈশবে কৈশোরে আর পাঁচটা মেয়ের মতই সাধারণ ছিলো, পরে রাজত্বের দায়িত্ব আর রাজনৈতিক কূটকৌশল তাকে বদলে দিলো?

"শ্রমণা, কী হোলো? এতক্ষণ ধরে ডাকছি, সাড়া দিচ্ছ না যে! " মনের ভুলভুলাইয়া থেকে বাস্তবে ফিরে আসি সৃঞ্জয়ের ডাকে।

বলি, "ডাকছিলে নাকি? আরে আমিও যেমন! কী যেন ভাবতে ভাবতে..... ডাকছিলে কেন? "

সৃঞ্জয় আমার হাত ধরে নিয়ে যায় পাথরের সিঁড়ির দিকে, প্রাসাদে ঢুকতে গেলে আমাদের উঠতে হবে সেদিক দিয়েই।

সৃঞ্জয় বলতে থাকে, " কেন এরকম বারে বারে বেসামাল হয়ে যাও? তুমি নিজে ইতিহাসের ছাত্রী, তোমার গাইড ডঃ প্রসাদ কতবার বলেছেন আবেগ মিশিয়ে ফেললে আর নিরপেক্ষ ইতিহাসচর্চা হয় না? তুমি তবু কেন এরকম হয়ে যাও? এখানে এসে এইসব এলাহী কান্ড দেখে বেসামাল হবার কথা তো আমার! আমি তো ইতিহাসে পোড়খাওয়া লোক না। " সৃঞ্জয় হাসে, ওর হাসির সঙ্গে তাল দিতে আমিও হেসে উঠি।

সিঁড়ির কাছে এসে অদ্ভুত একটা ভয়ে আমার ভিতর-বাহির শিরশির করতে থাকে, অসহায় জ্বরগ্রস্তের মতন সৃঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলি, " আজ থাক। আমার শরীর কেমন করছে, মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে যাবো। "

সৃঞ্জয় আমাকে সাবধানে ধরে ধরে সরিয়ে নিয়ে আসে সিঁড়ির কাছ থেকে, বলে, "থাক তবে। কী হোলো তোমার? মুখচোখ একদম ছাইয়ের মতন দেখাচ্ছে। চলো, আজ ফিরেই যাই।"

আমরা এ শহরে এসেছি গতকাল। এখানে তিনদিন, তারপরে অন্য শহরে যাত্রা। পুরো ঘোরাঘুরির জন্য হাতে মোট পনেরোদিন আছে । অথচ কী তীব্র অস্থিরতা আমার ভিতরে ঘূর্ণী তুলছে ! মনে হচ্ছে যথেষ্ট সময় নেই। কোনোদিন আগে যে দেশ দেখিনি, কেন সেখানে আগে কখনো এসেছি বলে মনে হয়?

কেন পথের এক-একটা বাঁকে এসে চমকে উঠি, এ যেন চেনা! কিন্তু তাতো হতে পারে না! সৃঞ্জয় বলে যে আমি খুব বেশীরকম কল্পনাপ্রবণ। ছোটোবেলা থেকে গল্প আর ইতিহাস পড়ে পড়ে সব মিলিয়েমিশিয়ে নাকি ঘেঁটে ফেলেছি! এরকম হলেই নাকি এরকম অচেনা জায়গা চেনাচেনা ঠেকে !

ফিরে আসি নদীর অন্য পাড়ে, ছোটো একটা দোকানে ঢুকে ঠান্ডা পানীয় খেতে খেতে জুড়াতে থাকি ক্লান্ত শরীর আর আলোড়িত অনুভবকে গুছিয়ে আনতে থাকি যথাসম্ভব। তারপরে মিউজিয়ামে যাই, আমাদের পরিচিত বন্ধু একজন আছেন সেখানে।

সন্ধ্যাবেলা রওনা হই সরাইয়ে ফেরার জন্য, তখন অন্ধকার বেশ গাঢ়। আকাশের দিকে চেয়ে আবার কেমন হয়ে যাই। মরুভূমির রাত্রি অপরূপ! একসাথে এত তারা, এত তারা! একেবারে ঝকঝক করছে! হাল্কা ওড়নার মতন দেখা যাচ্ছে ছায়াপথ। এরকম কবে দেখেছিলাম, কোনোদিন দেখেছিলাম কি? হয়তো দেখেছিলাম কোনোদিন।

হয়তো সে এ জন্মে নয়, হয়তো বহুজন্ম আগে যখন এই বালির টিলাগুলোর পাশ দিয়ে যে পথ চলে গেছে পাথরের সীমানা দেওয়া গাঁয়ের দিকে, সেই পথে হাঁটতাম। রঙীন ঘাঘরা-চোলি থাকতো আমার অঙ্গে, কাঁখে থাকতো কলস, সখীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাসতে হাসতে জল নিয়ে ফিরতাম ঘরে। মরুগোলাপের ঘ্রাণ আমাদের মনকে উচাটন করতো!

সৃঞ্জয়কে এসব বলা বৃথা, আমি নিজের ডাইরিতে এইসব লিখে রাখবো। বহু হাজার বছরের যবনিকা কি খুলবে? জ্ঞান উন্মেষের সময় থেকে আজ পর্যন্ত যে মানুষটাকে খুঁজছি আমি, তাকে কি পাবো?

বহু বছর আগের কথা মনে পড়ে, একটা ছোট্টো বাড়ী, তার ছাদে উঠে চেয়ে আছি পশ্চিমের দিকে, পশ্চিমে খোলা ধানক্ষেত, আদিগন্ত আকাশ তার উপরে উপুড় হয়ে পড়েছে, সূর্যাস্তকালের রঙীন মেঘেরা চারিদিক রঙীন করে দিয়েছে, সন্ধ্যাতারাটি সবে চোখ মেলেছে। সেইসব সময়ে আমার মনে আসতো এক আশ্চর্য মানুষের কথা, কত হাজার মাইল ব্যবধান আর কত হাজার বছরের দূরত্ব থেকে আমার দিকে চেয়ে থাকতো তার দুটি গভীর কালো চোখ। রাতের স্বপ্নেও ফিরে ফিরে আসতো সে। কাউকে বলতে পারিনি তার কথা, কাউকে না। কী করে বলবো, আমিই কি জানতাম সে আসলে কে?

সৃঞ্জয় এসব বুঝবে না বা হয়তো ভুল বুঝবে, সেই আশঙ্কায় ওকে কিছু বলতেও পারছি না। সে এমনিতে আমার খুব ভালো বন্ধু, বন্ধুরও বেশি কি? বুঝতে পারি না। সে নিজে কী মনে করে আমাকে? বন্ধু? নাকি তার অনেক বেশী?

২।

রাতে হোটেলে ফিরে সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে ক্লান্ত সৃঞ্জয় অঘোরে ঘুমোচ্ছিলো। আমি ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে বসে বসে ভাবছিলাম! ভাবনাগুলো যেন শত শত রঙীন সুতো, একটা আরেকটার সঙ্গে জড়িয়ে জড়িয়ে ভয়ানক জট পাকিয়ে যাচ্ছিল।

তারপরে নিজেও শুয়ে পড়লাম । ঘুম আসে না। মনে পড়ে সৃঞ্জয়ের পাগলের মতন ভালোবাসার মুহূর্তগুলো। কিন্তু সেইসব মুহূর্তেও কেন আমার মন আলগা হয়ে যায়? কেন অজানা বিষাদ এসে জমে বুকের খুব ভিতরে?

আমার জীবনটা আর পাঁচজন মানুষের মতন সহজ সরল হলে কত ভালো হতো! কিন্তু তা নয় কেন? কেন ভিতরে বারে বারে জেগে ওঠে সেই রহস্যময় সত্তা? ভিতর থেকে ফিসফিস করে কী যেন বলে। একটা কী যেন সমাধান হওয়া বাকী আছে, সেটা সমাধান না হলে কিছুই হবে না।

নাইট ল্যাম্পের নরম হাল্কা আলো ঘরে, রুম ফ্রেশনারের মৃদু সুগন্ধ ভেসে বেড়ায় ঘরের বাতাসে। এইসবের মধ্যে চুপ করে চোখে চেয়ে শুয়ে থাকি, মনের ভিতরে কে যেন ডাকতে থাকে, আয় আয়। কে সে? কে ডাকে? কোথায় যেতে ডাকে? সপ্তাশ্বসুতার পরজীবনের প্রাসাদে? ক্লান্তি একসময় জয়ী হয়, দু'চোখ লেগে আসে।

চার ঘোড়ার রথে বসে আছেন এক তেজদীপ্তা মধ্যবয়সিনী নারী, সুশোভন বেশ তার, কিন্তু বস্ত্র রঙীন নয়, শুভ্র। দীর্ঘ গ্রীবায় মহার্ঘ্য রত্নহার। দুই কান থেকে দুলছে হীরকখচিত কর্ণাভরণ। মাথার দীর্ঘ কেশ জড়িয়ে তুলে চূড়া করে মাথার উপরে বাঁধা, চূড়া ঘিরে রত্নমুকুট। চোখে দীর্ঘ করে টানা কাজলরেখা। কিন্তু এইসব সাজসজ্জা অলংকার সব ছাপিয়ে উপচে পড়ছে সেই আশ্চর্য নারীর অকুন্ঠিত তেজের দীপ্তি, বোঝা যায় অনেক ক্ষমতার অধিকারিনী।

রথে এঁর পাশে বসে আছে এক কিশোরী, অদ্ভুত মায়া-মায়া মুখ তার, চোখে স্বপ্ন। এর বস্ত্রালঙ্কারের তত বাহুল্য নেই, শ্বেত বসন আর নীলাভ সাদা উত্তরীয়। গলায় ফুলের মালা। চুলগুলি জড়িয়ে তুলে ফুলের মালা দিয়ে বেষ্টন করে রাখা। এর হাতে পূজার থালি, সম্ভবত কোনো মন্দিরের দিকে যাচ্ছেন এঁরা।

রথ চালাচ্ছে এক তরুণ, এর পরনে শ্বেতবসন, উর্ধাঙ্গে শুভ্র উত্তরীয়। এর মাথার চুলগুলো ক্ষুদ্র, সারা গায়ে কোনো অলংকার নেই দেখে মনে হয় বুঝি খুব সাধারণ সামান্য অবস্থার মানুষ। কিন্তু মুখচোখ দেখে তেজোদ্দীপ্ত যোদ্ধার মতন মনে হয়। এর চোখের মণি গভীর, যেন কীসের রহস্য সেখানে। এরই দিকে কেমন অদ্ভুত কোমল চোখে চেয়ে আছে কিশোরী মেয়েটি।

ভোরের নরম হাওয়া এসে লাগে গালে কপালে, ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্নেদেখা কিশোরী মেয়েটি আর রথচালক তরুণ কিন্তু স্মৃতিতে তাজা হয়ে থাকে তখনো। কে ঐ মেয়েটি আর ছেলেটি? ওদের কেন চিনি চিনি মনে হয়? ওদেরই খোঁজে কি আসলে এসেছি এখানে? যা আমার সচেতন মন জানে না কিন্তু ভিতরের মন জানে? কোথায় পাবো ওদের? এই হাজার হাজার বছরের বিস্মৃতির ধূলা সরিয়ে কেমন করে বার করবো ওদের? আর বার করেই বা কী হবে? কোনো সার্থকতা কি আর থাকতে পারে এই এত হাজার বছর পরে?

৩।

আজ সপ্তাশ্বসুতার প্রাসাদ ঘুরে দেখে এসেছি সৃঞ্জয় আর আমি। এখনো আমাদের বিস্ময়ের রেশ ফুরায় নি। ফেরার পথে পুরোটা সময় ধরেই কেবল সেই হাজার বছর আগের মানুষের অতিমানুষিক কীর্তির কথাই বলাবলি করছিলাম দু'জনে। আধুনিক প্রযুক্তির কোনো সাহায্য ছাড়া ঐসব বিশাল বিশাল স্থাপত্য আর অতি উঁচুদরের ভাস্কর্য কী করে তারা করলো? এ আজও এক রহস্য আমাদের কাছে। আমাদের অতীত আর বর্তমানের মাঝখানে যেন এক অনতিক্রম্য শূন্যতা, কোথায় যেন যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছি আমরা।

বেলা তখনো ছিল অনেক। হোটেলে ফিরতে ভালো লাগলো না, বসলাম গিয়ে নদীর পাশে গাছের ছায়ায়। অনেক কথা বলার পরে আর অনেক বিস্ময়ের ঝলসানির পরে যেন ছায়ার নিচে একটুকরো শান্তি। ওপারে দেখা যাচ্ছিল দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, মাঝে মাঝে টিলা। আমরা আর কথা বলছিলাম না, নদীর কলধ্বনি শুনছিলাম, নদীটা যেন আমাদের গান গেয়ে শোনাচ্ছিল। সেই গানের মধ্যে করুণ এক সুপ্রাচীন কাহিনি শুনছিলাম আমি। নিজের অজান্তে কখন চোখ ভরে উঠলো জলে।

গাছের ছায়ায় ঘাসের উপরে শুয়ে পড়লো সৃঞ্জয়, মাথার নিচে নিজের ব্যাগখানা বালিশের মতন করে দিয়েছে। দিব্যি চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়লো কয়েক মিনিটের মধ্যে। আমি নিজেও গাছের কান্ডে মাথা হেলিয়ে দিলাম।

হঠাৎ শুনি মধ্যরাত্রির প্রহর বাজলো কোথায় যেন, আকাশ তারায় তারায় ছেয়ে আছে। এখন কৃষ্ণপক্ষ। চাঁদ উঠবে একেবারে শেষরাত্রে। অন্ধকারের ভিতর থেকে শুনি ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ, তার সঙ্গে মাটির উপরে কাঠের চাকার ঘর্ষণের শব্দ। একটা অশ্ববাহিত রথ আসছে, বেশ আস্তে আস্তে, চুপিচুপি। নদীর কিনারে ঝুপসি একটা গাছের নিচে এসে থামলো রথ, রথারোহী ও চালক বলতে একজনই ছিল।

সে নামলো। নিবিড় নীল উত্তরীয়ে মাথা থেকে পা অবধি আবৃত তার। ঘোড়াটাকে রথ থেকে খুলে ঘোড়ার পিঠে আলতো চাপড় দিয়ে কী যেন বললো, মুক্ত ঘোড়াটা নদীতীরের তৃণভূমিতে নেমে গেল।

নিবিড় নীল উত্তরীয়ে আবৃত মানুষটি এইবার নদীতীর বরাবর চলতে শুরু করলো। বাদামী পাহাড়ের পায়ের কাছে নদী যেখানে একটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে চলে গেছে উত্তর-পূর্বে, সেইখানে এসে সে থামলো। পাহাড়ের গায়ের খাঁজগুলো সিঁড়ির মতন, খাঁজে খাঁজে সাবধানে পা রেখে সে উঠলো খানিকটা, এসে পৌঁছলো একটা পাথুরে চাতালে। চাতাল পেরোলেই একটা গুহামুখ, আলগা একটা পাথর গড়িয়ে এনে গুহামুখ বন্ধ করা হয়েছে।

মুখ ও মাথা থেকে উত্তরীয়ের আবরণ সরালো মানুষটা। এইবারে তাকে চিনতে পারলাম, সে ঐ কিশোরী মেয়েটি, আগে যাকে পূজা দিতে যেতে দেখেছিলাম। মুখের কাছে দুই হাত জড়ো করে সে এক অদ্ভুত শব্দ করলো, রাতপাখির ডাকের মতন সে আওয়াজ কিন্তু তার মধ্যে যেন মিশে আছে সাংকেতিক আহ্বান। একবার, দুইবার, তিনবার ডাক দিল সে। তিনবারের পর চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো খানিকক্ষণ।

উত্তর এলো তখন। ঠিক ওরকম আওয়াজ। পাহাড়ের অন্যদিক থেকে উঠে এলো আরেক মানুষ, মুখের ঢাকা সরাতেই চিনতে পারলাম, আগেরবারে দেখা সেই রথচালক তরুণ। কিশোরী মেয়েটি দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ছেলেটিকে, তাদের সম্মিলিত মিষ্টি হাসির রেশ ছড়িয়ে গেল রাত্রির বাতাসে। তারা গুহামুখের পাথর ঠেলে সরিয়ে গুহায় ঢুকে গেল।

অন্ধকারে তারা দেখতে পায় নি শ্বাপদের মতন তীক্ষ্ণ দুটি চোখ তাদের লক্ষ করেছে, রাজার নিয়োগ করা গুপ্তচর। অন্ধকারে মিশে থেকে সে অনুসরণ করেছে একদম শুরু থেকে। নিঃশব্দ দ্রুতগতিতে পাহাড়ের কাছ থেকে রাজবাড়ীর দিকে দৌড়ে চলে গেল সেই গুপ্তচর।

" শ্রমণা, শ্রমণা! " – কে যেন কাঁধে নাড়া দিচ্ছে। চোখ মেলে দেখি সৃঞ্জয়, সে জেগে গেছে। আমায় জাগাচ্ছে। সবটাই স্বপ্ন ছিল। মাথা তুলে দেখি বেলা পড়ে আসছে, ছায়া দীর্ঘ হয়েছে। এবারে হোটেলে ফিরতে হবে আমাদের।

উশীরস্রোতার দিকে এগিয়ে গেলাম, জলে হাত ডুবিয়ে আস্তে আস্তে বললাম, "আসি।" নদী কলস্বরে কী বললো কেজানে! এমন কত মানুষ এসেছে, কত গেছে, নদী কাকেই বা মনে রেখেছে !

আমরা ফিরে চললাম পান্থনিবাসের দিকে। আগামীকাল দুপুরে আমাদের অন্য শহরের দিকে যাত্রা। নদীটাকে হয়তো আর ছোঁয়া হবে না। যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে তাকালাম, কেন যেন মনে হচ্ছিল কেউ ডাকছিল। মনের ভুল নিশ্চয়। সেই রহস্যময় মানুষটাকে কোথাও কি খুঁজে পাবো কোনোদিন? নাকি সে আমার নিজের মনের বানানো গল্প একটা? সবটাই কল্পনা?

৪।

হোটেলে ফিরে কিছুক্ষণ টিভি দেখলাম। রাতের খাবার সময় হয়ে গেছিল কিন্তু আমার একটুও খিদে ছিল না। খানিকক্ষণ সাধাসাধি করে সৃঞ্জয় একাই গেল ডিনার খেতে। আমি ব্যালকনিতে গিয়ে বসলাম এক গেলাস অরেঞ্জ জুস নিয়ে।

আকাশ তারায় তারায় ছেয়ে আছে ঠিক সেই স্বপ্নটার মতন। ওদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আচ্ছন্ন হয়ে আসে দু'চোখ। আবার দেখি সেই কিশোরীকে, আজকে সে সাদাসিধে পোশাকে না, আজকে তার জমকালো রাজকীয় পোশাক, সর্বাঙ্গে হীরামণিমুক্তার অলঙ্কার ঝলকাচ্ছে।

আজ তার রাজ্যাভিষেক। তার নাম ছিল হেমা, কিন্তু আজ থেকে সে আর হেমা নয়, তার পূর্বজীবন মুছে গেছে, আজ থেকে সে সূর্যসম্ভূতা সপ্তাশ্বসুতা। কিন্তু ওর দীপ্ত কালো চোখের মণির গভীরে দেখি টলটলে জল, যেন উশীরস্রোতা বয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে সেখানে আগুনও জ্বলে ওঠে।

স্বপ্নের মধ্যে ছুঁতে পারি হেমার বেদনাস্পন্দিত হৃদয়, সেখানে থেমে আছে আছে সেই তরুণের নিথর মুখ, বুকে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত। হেমা সেই রাত্রে নির্বিঘ্নেই ঘরে ফিরে নিজের শয্যায় ঘুমিয়েছিল। সকালে পরিচারিকা ডেকে তুলে দুঃসংবাদ দিল। রথচালক সুষীম নিহত হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃতদেহ পৌঁছালো রাজবাড়ীতে, রাজ আদেশে আর সকলের সঙ্গে হেমাকেও দেখতে হলো সুষীমের মৃত মুখ।

হেমা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু, কাউকে কিছু বলতে পারলো না, কাঁদতে পারলো না, কোনোরকম শোকপ্রকাশ করতে পারলো না। সামান্য রথচালকের মৃত্যুর জন্য রাজকুমারীর শোকপ্রকাশ কীসের? শুধু তার বুকের ভিতর সব ভেঙে পড়ছিল, সে বুঝেছিল রাজা নিজেই লোক লাগিয়ে হত্যা করেছেন সুষীমকে, হয়তো রাজকুমারীর সঙ্গে ওর গুপ্তপ্রণয় জানতে পেরে গেছিলেন। কিন্তু কন্যাকে কেন অব্যাহতি দিলেন? কেন তাকেও হত্যা করলেন না?

তারপরে রাজকীয় মর্যাদায় অন্তেষ্ট্যিও হয়ে গেল সুষীমের। সুষীমের শোকাহত বাবা-মা চলে গেলেন তীর্থযাত্রায়, রাজকোষ থেকেই নাকি খরচ দেওয়া হয়েছিল।

সেইসব এই অভিষেকের আটদিন আগের কথা। আজ সপ্তাশ্বসুতা যৌবরাজ্যে অভিষিক্তা হচ্ছে। কিন্তু সে জানে হেমা এখানে নেই। হেমাকে এরা স্বর্ণশিকলে বাঁধতে পারে নি। সে একা একা একা চলে গেছে, দূর থেকে আরো দূরে, জন্মজন্মান্তর ধরে সে সুষীমকেই খুঁজবে। "সুষীম, সুষী-ঈ -ঈ ম!"

কলিং বেল বাজছে, আচ্ছন্ন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠি। শ্লথ পায়ে এগিয়ে যাই দরজা খুলতে, সৃঞ্জয় ফিরলো বুঝি।

৫।

হাতে একটা ছোট্টো আলো, চাবির রিঙ এ আটকানো আলো। সুইচ অন করতে উৎস থেকে আলো বেরিয়ে পাথুরে দেয়ালে একটা আলোকবৃত্ত রচনা করেছে, আলোকবৃত্তটি ঘিরে ছায়াবৃত্ত, তাকে ঘিরে আবার একটা হাল্কা আভার বৃত্ত, এইভাবে পর পর কয়েকটা আলো আর ছায়ার রিঙ এর পরে আবারো নিকষকৃষ্ণ অন্ধকার।

অদ্ভুত একটা পাথুরে সিঁড়ি দিয়ে নামছি, চারিদিকে পাথরের রুক্ষ দেয়াল। কোথাও কোনো শব্দ নেই। বাইরের পৃথিবীতে এখন দিন না রাত্রি? কেজানে! কখন এসেছি এখানে? তাও মনে নেই। আর কত পথ বাকী? কেজানে!

শুধু মনে পড়ে শেষরাত্রির ঠান্ডা বাতাসের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি নদীর দিকে, তারাগুলো দপদপ করছে মাথার উপরে। চলতে চলতে একসময় নদী পেলাম, নদীর পাশ দিয়ে চলতে লাগলাম, কে যেন ফিসফিস করে আমায় পথনির্দেশ দিচ্ছিল। আমার কোনো ভয় ছিল না, কোনো দ্বিধা ছিল না, দ্বিধাদ্বন্দ্ব সব শেষ হবার পরেই বেরিয়ে পড়েছিলাম।

বেরিয়ে পড়ার আগে একটা ছোটো চিঠিতে সৃঞ্জয়কে জানিয়েছি যে আমি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় সজ্ঞানে নিরুদ্দেশে যাচ্ছি, সে যেন আমার জন্য চিন্তা না করে। চিঠিটা টেবিলে রেখেছি গেলাস চাপা দিয়ে। সকালে উঠেই দেখতে পাবে ও।

মনে পড়ে হাঁটতে হাঁটতে পা দুটো ক্লান্ত হয়ে এলো, তারপরে দেখি নদীটা একটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে আর সামনে সেই পাহাড়, ঠিক স্বপ্নে যেমন দেখেছিলাম। পাহাড়ের গায়ের খাঁজে হাত পা রেখে রেখে উঠলাম চাতালে, সত্যিই একটা পাথুরে চাতাল ছিল আর তার সামনে ছিল সেই গুহা। গুহামুখে পাথর চাপা ছিল না।

মুহূর্তমাত্র দ্বিধা করে আলোটি জ্বালিয়ে ঢুকে পড়লাম। ঢুকে দেখলাম ধাপে ধাপে সিঁড়ি চলে গেছে, কখনো নামছে কখনো উঠছে। কখনো ঘুরে ঘুরে চলছে পাথুরে সিঁড়ি আর সিঁড়ি। চারিপাশে পাথরের দেওয়ালে কোথাও আর্দ্র জলধারা কোথাও রঙীন ক্রিস্টাল জ্বলজ্বল করে উঠছে আলো পড়ে, কোথাও অদ্ভুত সব নীল লাল সবুজ চিত্রমালা।

কোথা থেকে কে যেন ডাকে আমায়, ভাষাহীন, শব্দহীন সেই অমোঘ আহ্বান অগ্রাহ্য করার শক্তি নেই আমার। আমি চলতে থাকি, চলতে থাকি। হাজার হাজার বছরের বিরাট শূন্যতা, অতলস্পর্শী বিরহ-হাহাকার আমার পায়ের নিচে ভেঙে ভেঙে পড়তে থাকে। সময়হীন এক অমৃতলোকে দাঁড়িয়ে আছে জরাহীন, মৃত্যুহীন, বেদনাহীন এক তরুণ, অপূর্ব বিভা ঘিরে আছে তাকে।

চলতে চলতে নির্মোকের মতন খসে পড়ে যায় আমার সমস্ত বসন-ভূষণ-পরিচয়-ভাবনা-ঘরদুয়ারস্মৃতি। অদ্ভুত ফুলের গন্ধ এসে লাগে নাকে, অনুভব করি আমার অভূতপূর্ব কুন্ডলিত কেশভার বিচিত্র কবরীতে বাঁধা, তার উপরে জড়িয়ে আছে সুগন্ধী পুষ্পমালা। আমার পরনে সুবর্ণখচিত বস্ত্র, উর্ধাঙ্গে কঞ্চুলী ও উত্তরীয়। সেই সহস্র বৎসর আগে যেমন ছিল।

হাতের আলো কখন খসে গেছে, কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি, সব দেখতে পাচ্ছি বিচিত্র এক আলোতে। অক্লান্ত চরণে চলতে থাকি, চলতে থাকি, মনে মনে বলি, " আমি আসছি, আমি আসছি, সুষীম, আমি আসছি। "



(The End)

জ্যোৎস্নাশিহরিত

সারাদিন এখান থেকে ওখান, অল্প অল্প বিরতি দেওয়া ঘোরাঘুরি, অনিশ্চয়তার সঙ্গে ইচ্ছেখেলা। তারপরে ক্লান্তিসন্ধ্যা। সরাইয়ে ঘর নিয়ে নেয়ে খেয়ে বিশ্রাম। চিরল ঘুমিয়ে পড়েছে।

ঘুমের সাধনায় বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে ব্যর্থ হই। বেশী ক্লান্তিতে স্নায়ু টানটান, ঘুম আসে না। উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়াই, পর্দা সরিয়ে তাকাই বাইরে। জ্যোৎস্নাশিহরিত মধ্যরাত।

বালিময় শুখা দেশ, দূরে দেখা যায় পাহাড়ের আবছা রেখা। বালিপাহাড়। আকাশ এখানে ভারী পরিষ্কার। এই বালিতে পাহাড়ে মাটিতে এমনকি বাতাসেও কেমন ঝিমঝিমে রহস্যময়তা। হাজার হাজার বছরের রহস্য।

মনে হয় কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলে রাতবাতাসে। কে যেন ডাকে তুরা, তুরা, তুরা-আ-আ-ই। কে ডাকে? কেন ডাকে? কেন আবছা আবছা চেনা চেনা লাগে? কেন সারাদিন অচেনা অচেনা বাঁকে চমকে উঠেছি চেনা চেনা লেগে?

ইচ্ছেগাছে উড়ে বেড়ায় পরী
ঘুমিয়ে গেছে সাতপাহাড়ের বন
জোছনা রঙের ওড়নাগুলো নিয়ে
একাই খেলে না-ঘুমানো মন।

দূরের জলে ঘাই তোলে রাতমাছ
জলকলিটি স্বপ্নে কথা বলে,
মরূদ্যানের ঝর্ণা-পাহাড়-হাওয়া
আধেক নেশা আধেক ঘুমে ঢলে।

চিরল বুঝবে না,সে আমাকে অতিরিক্ত কল্পনাপ্রবণ বলে জানে। ঠাট্টা করে এই নিয়ে। বলে কাজের পক্ষে নাকি ক্ষতিকর এত কল্পনাপ্রবণতা। আমিও মেনে নিই, যথাসম্ভব লুকিয়ে রাখি এসব ওর কাছ থেকে।

আমাদের কাজের পদ্ধতি, হিসাব করা, মাপ নেওয়া, গণনা এসবে মিল আছে বলে আমাদের কাজ এগিয়ে চলে, কিন্তু কেউই কি আমরা সত্যি করে কাউকে বুঝতে পারি? মনের ভিতরের যে লুকানো মন, যে কিনা অন্যভাবে বুঝে নেয় সব, সে মনের হদিশ কি কেউ জানি?

ঘুমের পর্দাঘেরা অচিন দেশের নির্জন মধ্যরাতে মনে পড়ে যায় সেই পাগল বাঁশিওয়ালাকে, দখিন হাওয়ায় সারারাত যার বাঁশির সুর ভেসে আসতো! সে কোথায় আজ? কতদূরে?
আমরা দু'জন একটি গ্রহেই থাকি
মধ্যে শুধু একটি মহাসাগর
একই আকাশ-চন্দ্রাতপের নিচে
জীবনখেলায় কুটোকাটার ঘর।

পর্যাবৃত্ত

১। নী

গোল জানালাটির সামনে এসে দাঁড়ায় নী। আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়ে ছোঁয় নীল বোতামটাকে। এখন সে হাত পায়। কয়েকমাস আগেও অত উঁচুতে হাত যেতোনা নী'র। তখন ওর সঙ্গে ওরাককে আসতে হতো। কিন্তু নী'র ভালো লাগতো না, কেমন যেন মনে হতো এক একা আসতে পারলেই ভালো হতো। ওরাকের সোনালী ধাতব মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, কিন্তু নী'র মনে হতো ওরাক যেন ভেতরে ভেতরে বিরক্ত, রুটিন কাজের বাইরে এই কাজটি তাকে করতে হওয়ায়। নী জানতো না ওরাকের রাগ, বিরক্তি, মান-অভিমান এইসব মানবিক অনুভূতিগুলি নেই, সেগুলো তাকে দেন নি তার নির্মাতারা। সেকথা নীকে জানানোর কেউ ছিলো না সেখানে।

নীল বোতামটায় আস্তে আস্তে চাপ দেয় নী। এই অন্ধকার করিডরের শেষে এই গোল জানালাটার সামনে দাঁড়ালে প্রতিবারই কেমন যেন একটা বুক ধুকপুক ধুকপুক করে নী'র। তবু কিছুদিন বাদে বাদেই সে এইখানে না এসে পারে না।

গোল জানালার অস্বচ্ছ ঢাকনা সরে গিয়ে স্বচ্ছ ঢাকনা বেরিয়ে পড়লো। নী ওর মুখ আরো এগিয়ে আনে। একদম কাছে আনে চোখ। ওর নবীন জ্বলজ্বলে চোখের সামনে প্রকাশিত হয় মহাকাশ। অবর্ণনীয় বিস্ময়! । অসংখ্য গ্রহতারা নীহারিকাময় রহস্যভরা মহাকাশ, ঘন অন্ধকারে বিন্দু বিন্দু আলোজ্বালা তারারা, দূরের গ্যালাক্সির ঘূর্নীবাহু, নেবুলার মেঘওড়না, কখনো বা হালকা তুলোর মতন--ধূলিহীন তীব্রতায় ঝকঝক করছে সব।

নী ইস্কুলে শুনেছে আর পড়েওছে ওরা সবাই এই মহাকাশের মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছে, অনেক অনেক দিন পরে যখন তারা অনেক বড় হয়ে যাবে, তখন অনেক অনেক দূরে একটা নীল গ্রহে গিয়ে সবাই পৌঁছবে। বহু বহু শতাব্দী আগে ঐ গ্রহটা থেকেই নাকি তাদের এই যানটি, নির্মাতারা যারা নাম রেখেছিলো ফিনিক্স-1, যাত্রা শুরু করেছিলো মহাশূন্যে। হিমায়িত করে রাখা মনুষ্যভ্রূণদের নিয়ে। পরে কখনো হানাহানির দুর্যোগ কেটে গেলে আবার যাতে তারা ফিরে আসতে পারে। তখন যদি গ্রহের মানুষ নিঃশেষ করে ফেলে নিজেদের, তবু মহাশূণ্যে নিরাপদ দূরত্বে ফিনিক্সের মতন নানা মহাকাশযানে রয়ে গেলো তাদের বংশধারা। অনুকূল পরিস্থিতে ফিরে আসতে পারবে জননীগ্রহকে পুনর্মানবায়িত করতে। এইসব ভেবেই সবকিছু সেইভাবে প্রোগ্রাম করে দিয়েছিলেন নির্মাতারা । সঙ্গে ছিলো অফুরন্ত নিউক্লীয় শক্তি-উৎস আর নক্ষত্রের আলোর শক্তিকে সংগ্রহ করার প্রকৌশল। এসব এখনো সব বুঝতে পারে না নী, এখানে যে দশজন মানুষ আছে ,তারা কেউই সবটা বুঝতে পারে না। আরো বড় হয়ে নাকি বুঝবে। নী আরো বুঝতে চায়, এখনি।

কী অপরূপ সুন্দর ওই ঘুর্ণী গ্যালাক্সিটা! নী'র মনে হয় আচ্ছা, ওখানে কি নী'র মতন কেউ আছে? দিওতিমার মতন? তাভামের মতন, ওরিনের মতন? যদি থাকে, তবে সে কি এমন করে চেয়ে দেখে মহাকাশ! সে কি ভাষায় কথা বলে? তারও কি খুব কাছের বন্ধু আছে যেমন নী'র আছে দিওতিমা?

নী নিজে নিজে খুব আস্তে আস্তে নিজের সঙ্গে কথা বলার মতন করে বলে,"এই, এই শোনো! তোমার নাম কী গো? তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছো? আমি নী, তোমার নাম কী? তুমি কি আমার বন্ধু হবে? দিওতিমার মতন বন্ধু?" বলে ফেলে নিজের মনেই হেসে ফেলে সে, কার সঙ্গে সে কথা বলছে?

নী পায়ের শব্দ পায়, সে চেনে এই পায়ের শব্দ। ওরাক। নিতে আসছে নী কে। এখন ওদের পড়তে বসার সময়। নী বোতাম টিপে গোল জানালার ঢাকনা বন্ধ করে দেয়। ওরাক এসে গেছে, ওর হেলমেটে হালকা কমলা রঙের আলো জ্বলছে,নী'র দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে সে তার ওঠানামাহীন ধাতব গলায় বলে,"নী, তোমার পড়ার সময় হয়ে গেছে। চলো।" নী কোনো কথা না বলে হাত বাড়িয়ে ওরাকের শক্ত হাত ধরে বলে, " চলো।"

পড়ার ঘরে দিওতিমা ছিলো, ওরিন তাভাম রীহা জুইক তুরি কিজা রুফাস মিলে সকলেই ছিলো। শুধু ইলক তখনো আসে নি, ইলকের মাঝেমাঝেই দেরি হয়, সে ছবি আঁকে কিনা, তাই আঁকতে আঁকতে ভুলে যায় যে পড়ার ঘরে যাবার সময় হয়ে গেছে। নী গিয়ে দিওতিমার পাশে বসে পড়ল।

দিওতিমা ওর দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে খুব মৃদুস্বরে বলল,"নী, আজকেও গেছিলি গ্যালাক্সি দেখতে?" নী কথা না বলে স্মিতহেসে মাথা দুলিয়ে জানায় সে গেছিলো। ওদের কথার মাঝখানেই সে দেখলো ইলক আসছে সাইননের হাত ধরে। সাইনন ইলকের দেখাশোনা করে,সে ধাতুনির্মিত রোবোট হলেও তার মুখখানা কেন জানি নী'র বেশ ভালো লাগে, তার মনে হয় সাইনন যেন হাসছে!

ওদের শিক্ষিকা রুশা, সেও রোবোট, কিন্তু সেকথা রুশাকে দেখে ওরা বোঝে না, নরম মিষ্টি চেহারা রুশার, দিওতিমা বলে রুশাকে মা-মা দেখতে। তারা কেউ জানে না মা কেমন হয়, তাদের জন্মই হয়েছে কত অন্যরকমভাবে! কিন্তু কোথায় মনের খুব গভীরে মাতৃস্মৃতি রয়ে গেছে। লক্ষ লক্ষ বছরের এভোলুশনকে তো আর মুছে দেওয়া যায় না! রুশাকে দেখলে তাদের ভালো লাগে, ওর মুখের হাসিটাও ভারী মিষ্টি। যতবার রুশার হাসি দেখে, ততবার নী'র মনে পড়ে জিনির কথা। কি হলো জিনির? আর তার সাথে দেখা হবে না?

শৈশবে জিনি ওকে দেখাশোনা করতো। খাওয়াতো, পরিষ্কার করতো, সাজাতো, পোশাক পরাতো,কোলে নিয়ে দোল দিতো। হালকা নরম সুরে কথা বলত জিনি ওর সঙ্গে। জিনির কথা ধরে ধরেই কথা ফুটেছিলো নী'র। জিনির মুখের হাসি ছিলো খুব মিষ্টি। এই রুশার হাসির সাথে কোথায় যেন মিল! কী হলো জিনির? একদিন জিনির বদলে এলো ওরাক! ওদের সবারই ছোটোবেলার রোবোট বদলে গেছে। এইরকমই নাকি নিয়ম। কে করেছে এইসব নিয়ম? নী জিনিকে দেখতে চায়! এখনো মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে তার মনে হয় জিনির পোশাকের নরম প্রান্তটি বুঝি তাকে ছুয়ে গেলো! আর কোনোদিন দেখা হবে না? কোথায় গেলো নী'র জিনি? দিওতিমার সেম্মা? তাভামের মিমা রা? সকলের ছোটোবেলার ন্যানিরা?

কোনো কারণ নেই তবু নী'র মাঝে মাঝে মনে হয় ওদের সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে না। কেউ জানে না ওদের কী হলো! রুফাসকে কিজাকে তুরিকে-সবাইকে জিজ্ঞেস করেছে নী। কেউ কিছু বলতে পারে নি, ওরা জানতে আগ্রহীও না। ওরা ব্যস্ত ওদের পড়াশোনা,খেলাধূলা, হবি এইসব নিয়ে।

কিন্তু নী'র মন কেমন করে। মাঝে মাঝে সে যখন দিওতিমাকে নিয়ে ওই উপরের গোল বারান্দায় গিয়ে বসে গল্প করে, ওরা বসে কুট্টি কুট্টি গোলাপী ফুলওয়ালা লতাটার নীচে রাখা দুখানা চেয়ারে। নী বানিয়ে বানিয়ে সে গল্প বলে একের পর এক, ওর সব গল্পেই কোনো কোনো চরিত্র থাকে ন্যানির। বাকীরা ওদের এই বানিয়ে গল্প বলা আর শোনার খেলায় উত্‌সাহী না, এই খেলা শুধু নী আর দিওতিমার।

অন্যেরা মেকানো বানায়, বোর্ড গেম খেলে, কার্ড গেম খেলে, অডিভিডি গেম খেলে, এমনি হুটোপাটি করা খেলা খেলে সবাই মিলে--ওসব খেলায় নী আর দিওতিমাও যোগ দেয় বেশীরভাগ সময়েই। শুধু মাঝে মাঝে কোনো কোনো দিন ওদের এসব ভালো লাগে না, তখন ওরা চলে যায় উপরের গোল বারান্দায়, গল্প বলা আর শোনা খেলতে।

কিছুদিন আগে নী গল্প করছিলো, অদ্ভুত এক দেশ, কিছু আলো কিছু ছায়া সেখানে। সেখানে আকাশে মেঘ ভেসে যায়,বৃষ্টি পড়ে -সে দেশ খুব সবুজ! সেখানে এক ছোট্টো মেয়ে দিয়া আর ওর ন্যানি থাকে বিরাট এক প্রাসাদে ..... দিওতিমা শুনছিলো গালে হাত রেখে, দুচোখ বড় বড় করে মেলে। আকাশ মেঘ নদী সমুদ্র পাহাড় সব ওদের চেনা, এসব ওরা চেনে শুধু থ্রী-ডি প্রোজেক্টরে দেখে দেখে। কিন্তু সত্যি করে ওসব কেমন হবে? এসব নিয়ে কেমন গল্প বানিয়ে ফেলে নী! বলতে বলতে সে নিজেই অবাক হয়ে ভাবে সে কিকরে এইসব বলে? এসব কার স্মৃতি?

2. ফিনিক্স-১

ফিনিক্স-১। সুবিশাল এই মহাকাশযান। আলোর অর্ধেক গতিবেগে ভেসে চলেছে মহাশূন্যপথে। মহাকাশের বিপুল বিস্তারে এই গতিবেগ শম্বুকগতি বললেও বাড়িয়ে বলা হয়। কিন্তু ফিনিক্সে আন্ত:-গ্যালাক্টিক ঝাঁপের ব্যবস্থা আছে। সেইসব সুবিধা মহাশূন্যের যেসব বিন্দুতে পায়, ফিনিক্স তা কাজে লাগায়। বহু কোটি আলোকবর্ষ পার হয়ে যায় প্রায় বিনাসময়ে। ফিনিক্সের গতিনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা পুরোপুরো প্রি-প্রোগ্রামড। এই বিষয়ে এখানকার কারুর কিছুই করার উপায় নেই।

নী, দিওতিমা, রীহা, জুইক,ইলক, তাভাম, ওরিন,তুরি,কিজা আর রুফাস-এই দশজন সদ্য দশবছরে পা দেওয়া ছেলেমেয়ে ছাড়া এখানে আর কোনো মানুষ নেই। বাকী সবই নানা জৈব ও অজৈব যন্ত্রপাতি। ছোটো ছোটো বনসাই গাছপালা আর লতাপাতা আছে অবশ্য অনেক। আর অনেক রোবোট। নানাশ্রেনীর। নানারকম কাজের জন্য ভিন্ন ভিন্ন রোবোট। বিশেষজ্ঞ চিকি‌ত্‌সক, শিক্ষক, প্রোকৌশলী থেকে শুরু করে নানাধরনের পরিচর্যাকারী সবাই এখানে রোবোট।

মানুষ শুধু দশজন। দশবছর আগে একই দিনে এদের সকলের ভ্রূণ হিমায়িত অবস্থা থেকে জাগিয়ে তুলে জেস্টেশন চেম্বারে প্রস্ফুটিত হতে দেওয়া হয়। সেরকমই নাকি নির্দেশ ছিলো। এরা সকলে পূর্ণমানবশরীর নিয়ে জন্মায় একই দিনে, কয়েক ঘন্টার তফাতে তফাতে। প্রত্যেকের দেখভালের জন্য একজন করে রোবোট নিযুক্ত হয়। যেমন নী'র জন্য ছিল জিনি। সেইসব রোবোটদের সকলের বিশেষ স্কিল ছিলো মানবশিশু প্রতিপালনে। এই ছেলেমেয়েদের বয়স পাঁচ হতেই সেই ন্যানি রোবোটেরা নিষ্ক্রিয়য় হয়ে চলে গেছে স্টোরেজে। এসেছে নতুন রোবোট, এরা থাকবে এদের পনেরো বছর হওয়া পর্যন্ত। তারপরে এরা নিজেরা নিজের মতন থাকতে পারবে স্বাধীন হয়ে। এরকমই নাকি নিয়মে বলা আছে। এখন তাই নী'কে দেখাশোনা করে ওরাক।

নী কাউকে বলে নি, এমনকি প্রাণের বন্ধু দিওতিমাকেও না যে ওরাককে ওর পছন্দ হয় না। ওরাক একটু হাসিখুশী হলে হয়তো ওর মন এতটা বিরূপ হতো না। কিন্তু ওরাকের মুখ একদম কঠিন, শক্ত,ভাবলেশহীন। সে যাকগে। ছোটো হলেও নী তীক্ষ্ণবুদ্ধি, সে বুঝতে পারে সবই ওর মনোমত হবে না। আরও সে বুঝতে পারে যে কিছু কিছু কথা আছে যা শুধু ওর নিজের, কারুর সাথেই তা ভাগ করে নেওয়া যায় না।

একটা অদ্ভুত স্বপ্ন মাঝে মাঝে নী'কে উতলা করে তোলে। সে স্বপ্নে দেখে একটা আশ্চর্য পাথুরে সিঁড়ি, পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে। সিঁড়ির দুধারে অজস্র সবুজ লতা, লতাগুলো রঙীন ফুলে ভরে আছে,ঝলমল করছে রোদ্দুরে, হাওয়ায় দুলছে। ঠিক যেন হাতছানি দিয়ে ওকে ডাকছে!

সে এখানের বাকী সকলের মতই মাটি,পাহাড়, পাথর, সমুদ্র, হ্রদ,দিন,রাত, রোদ্দুর, বৃষ্টি,দিনের আকাশ, বিভিন্ন ঋতু, ঝড়তুফান সব চেনে ক্রিস্টাল ভিউতে দেখে দেখে বা থ্রী-ডি প্রোজেকশনে দেখে দেখে। লতা ফুল সিঁড়ি এসব অবশ্য সত্যি সত্যিই দেখেছে। তাই পাহাড়,লতা,ফুল, রোদ্দুর সব চিনতে পারে। কিন্তু সেটা কোথাকার পাহাড়? ওর দেখা কোনোকিছুর সাথে মিল তো নেই! ফুলগুলোও তো একদম অন্যরকম! কেমন যেন অদ্ভুতভাবে তার মনে হয় সে পুরো দৃশ্যটার উপরে ভেসে ভেসে দেখছে!

কেন সে বারে বারে এই স্বপ্ন দেখে? এ কার স্মৃতি?সে কাউকে বলে নি, সে বোঝে কাউকে এসব বলা যাবে না। কিন্তু সে বুঝতে চায়। সে তাড়াতাড়ি বড় হতে চায়, সংরক্ষিত তথ্যের ঘরে প্রবেশাধিকার পেতে চায়। কিন্তু পনেরোবছর হওয়ার আগে তা হবার উপায় নেই। ইশ,কবে যে তার পনেরো হবে!

সংরক্ষিত তথ্যের ঘর! সে ঘর এই যানের একদম সর্বোচ্চ জায়গায়। অবশ্য মহাকাশে কোনটা উপরে আর কোনটা নীচে এমনিতে বলা ভারী শক্ত। কিন্তু কৃত্রিম অভিকর্ষের ব্যবস্থা করা আছে বলে এরা ভারশূন্যতা অনুভব করে না। মেঝেতে হেঁটেচলে বেড়াতে পারে স্বাভাবিকভাবেই। মানবশিশুদের ঠিক গন্তব্যগ্রহের সমান অভিকর্ষের মধ্যে বড় করা হচ্ছে, নইলে গ্রহে পৌঁছে এরা মানিয়ে নিতে পারবে না, ফিনিক্সের পুরো উদ্দেশ্যটাই তাহলে বৃথা হবে। তাই এদের কাছে উপরের ঘর বা নীচের ঘর এসব কনসেপ্ট জানা। ভারশূন্য হয়ে ভেসে বেড়াতে হলে এরা জানতেই পারতো না উপর নীচ কাকে বলে!

ঐ সংরক্ষিত তথ্যের ঘর এদের কাছে "ফরবিডেন জোন"। ওদের কাউকেই ওখানে যেতে দেওয়া হয় না। বয়স পনেরো হবার আগে দেওয়া হবে না জানে সবাই। রুশা বলেছে ওদের সবাইকে। নী ভাবে কি মজাটাই না হবে সেই বিশেষ জন্মদিনে! রঙীন কাগজ, অনেক বেলুন আর টুনিবাতি দিয়ে ঘর সাজানো হবে, কেক কাটা হবে, গান গাওয়া হবে। তারপরেই কি সবাই ছুট দিয়ে ওই ঘরের দিকে যাবে তারা? নাকি অন্যরকম হবে সবকিছু? কল্পনার সঙ্গে মিলবেই না একটুও?

নী ভাবে এই যে জন্মদিনে ঘর সাজানো, বাতি জ্বালানো, কেককাটা, গান গাওয়া, এইসব কোথা থেকে শুরু হলো? রুশাকে জিজ্ঞাসা করলে সে বলে এসব নাকি নিয়ম। ওদের প্রতি নাকি এইরকম নির্দেশই আছে! কারা দিলো নির্দেশ?এসব নিয়ে আরো জিজ্ঞাসা করলে রুশা হাসে আর বলে এসব তো জানা কথা, সকলেই জানে! এসব নিয়ম টিয়ম নিয়ে বেশী জিজ্ঞেসই নাকি করতে নেই! নিয়ম আছে মানার জন্য, কোথা থেকে এলো, কারা দিলো সেসব অবান্তর। নী অবাক হয়ে ভাবে কেন এমন? জানতে চায় বলেই তো সে জিজ্ঞেস করে! জানতে চাওয়া তো অন্যায় হতে পারে না! জানাতে না চাইলে তাদের এই স্কুলেরই বা কী দরকার ছিলো?

মাঝে মাঝে কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তরে রুশা বলে বড় হলে নাকি জানতে পারবে তারা। নী ভাবে কেমন ছিলো সেই মানুষেরা, এইসব রীতিনীতিনির্দেশমালা যারা দিয়েছিলো? তারা কি তাদের মতন মানুষই ছিলো নাকি অন্যরকম? তাদের কথাই কি জানতে পারবে ওই সংরক্ষিত তথ্যের ঘরে? নী ছটফট করতে থাকে বহু আকাঙ্খিত সেই বিশেষ দিনটা আসার জন্য।

স্কুল শেষ হলে রুশা হাসিমুখে বিদায় দেয় ওদের সবাইকে এক এক করে। দিওতিমাকে নিতে আসে রুহাম, রুহানের দেহ ধাতব, কিন্তু মুখ দিব্যি হাসিখুশী! নী ভাবে তার কপালেই পড়লো কিনা ওরাক, যে হাসতে জানে না!

দিওতিমাকে হাত নেড়ে বিদায় দিতে সেও হাত নেড়ে চলে যায় রুহামের সঙ্গে, তার হাত ধরে। পরদিন স্কুলটাইম আর প্লেটাইমের আগে আর দেখা হবে না। প্রতিদিন বিদায়বেলায় মনখারাপ হয় নী'র। কী কি ক্ষতি হতো যদি স্কুলের পরেও আরো অনেকক্ষণ একসাথে থাকতে পারতো সে আর দিওতিমা!

মহাকাশে দিনরাত নেই, সবই এক, অন্তহীন বিভাময় বিভাবরী। তাদের গন্তব্যগ্রহটিকে নাকি প্রায় ত্রিশঘন্টার দিনরাত্রি ঘুরে ঘুরে আসে। তাদের জন্যও তাই ফিনিক্সে সেইভাবেই ব্যবস্থা করা।

রুহামের পর আসে সেরাক, সে তাভামকে নিয়ে যায়। সেরাকের মুখ আরো শক্ত,সেরাকও কখনো হাসে না, কিন্তু তাতে তাভামের কোনো হেলদোল আছে বলে মনে হয় না, সে এসব কেয়ার করে না। সে থাকে তার নিজের হবি নিয়ে, তাভামের হবি গানবাজনা। তার একটা বেহালা আছে, সে অবসরে সেটা বাজায়। তার বেহালার করুণ সুর একদিন শুনেছিলো তারা সবাই।

আজকে সবাইকে "বাই বাই" করে সেরাকের হাত ধরে যখন তাভাম চলে যাচ্ছে, তখন নী'র হঠাত্‌ মনে হয় হয়তো তাভামও তার মতন মনের ভাব লুকিয়ে রাখে। ব্যাখাতীত একটা অনুভব কাঁপিয়ে তোলে নী'কে, তাভামের জন্য কোনো কারণ ছাড়াই চোখে জল আসতে চায় তার। মনে হয় তাভাম তারই মতন স্নেহ খুঁজে বেড়াচ্ছে, কিন্তু কাউকে বলতে পারছে না। নী অবাক হয়, এরকম কেন লাগছে তার? কোনো কারণ সে খুঁজে পায় না। তাভাম হয়তো এসব সত্যিই কেয়ার করে না! সে বোকার মতন ওসব ভাবছে! নী জানে না বহুকাল আগে যখন তাদের গন্তব্যগ্রহে মানুষ বাস করতো তখন তার সেই অনুভবকে নাম দিয়েছিলো সমবেদনা। সেই অপরূপ অনুভূতির ধিকারী হয়েও যে তারা কেন .....

ওরাক আসছে, নী নিজেকে সামলে নেয়। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গীতে সকলকে বিদায় জানিয়ে চলতে থাকে ওরাকের সঙ্গে। তার ঘর বেশ দূরে, যানের একেবারে প্রান্তে। নির্জন ঘরটি ভালোই লাগে নী'র, তার কয়েকটা ফুলের টব আছে, তাতে নানারকম ফুলগাছ লাগিয়েছে সে, স্কুল থেকে ফিরে তার প্রধান কাজ অনেকক্ষণ ধরে পুষ্পপরিচর্যা! এই কাজটি খুব ভালো লাগে তার।

3. ওরাক

"আমি ওরাক। পুরো নাম ওরাক ওমেগা-৩। ওমেগা লটের ৩ নম্বর রোবট আমি। কতকাল আগে কোথায় আমার জন্ম হয়েছিল মানে যন্ত্রপাতি দিয়ে পার্টস জুড়ে জুড়ে কোথায় আমাকে নির্মাণ করা হয়েছিলো সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই আমার। ওমিবর্গ কোম্পানির অসংখ্য কারখানার কোনো একটাতেই নিশ্চয়। আমার ডানবাহুতে প্রিন্টেড সিম্বল ওমিবর্গের। সেই হিসাবে তারাই আমার নির্মাতা হবার কথা। নির্মাণসময়ের ধারনা আমার মেমরিতে থাকার কথাও না। আমার মেমোরিতে ঘটনাস্মৃতি, নানা স্কিল শিক্ষা ইতদি স্টোরড হতে শুরুই তো হয় আমার সুইচ-অন হবার পর থেকে। তার আগের কিছু কিকরে থাকবে? তবু মাঝে মাঝে আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়, অস্বস্তিকর অজানা অনুভূতি। স্মৃতি তন্নতন্ন করে খুঁজে পাই না কখন ঘটলো এমন একটা ঘটনা আমার মনে পড়তে থাকে ....."

ওরাকের নোটবুক পড়ছে রুশা, একেকটা পাতা পড়া শেষ হতেই আঙুল দিয়ে পাতার কোণার বোতামটা ছুঁতেই পরের পাতা ফুটে উঠছে বুকস্ক্রীণে। অদ্ভুত সব চিহ্ন আর ০ ১ ইত্যাদিওয়ালা ভাষা এই লেখার, এই ভাষা শুধু রোবটেরাই পড়তে পারে সরাসরি, মানুষদের পড়ার জন্য ডিসাইফার করে দিতে হয়। পড়তে পড়তে মনুষ্য-উপযোগী ভাষায় অনুবাদ করে নিজের মেমরিতে জমা করে রাখছে রুশা। তেমনই নিয়ম।

ওরাকের নোটবই। সেই ওরাক, ছয় বছর আগে যথাযথ বিচারের পরে যাকে ডিসম্যান্টল করে ফেলা হয়েছে। অন্য কোনো উপায় ছিলো না, সে এমন নিয়ম ভেঙেছিলো, যে ওই পরিণতি ছাড়া অন্য কিছু হতে পারতো না। ওর মেমোরি কিউবগুলো ও সব পিউরিফাই করা হয়েছে, কিছু কিছু নিউট্রাল অংশ কপি করে রাখা হয়েছে,বাকী সবকিছু ইরেজ করে দেওয়া হয়েছে চিরকালের মতন। নতুন করে নানা যন্ত্রে ব্যবহার করা হয়েছে কিউবগুলো।

ওরাক বলে আর কেউ নেই আজ ফিনিক্সে। শুধু এই নোটবুকটা কেমন করে রয়ে গেছে! এইটার অস্তিত্বের কথা কেউ জানে না। রুশাও জানতো না এই কিছুক্ষণ আগে এটা খুঁজে পাওয়ার আগে পর্যন্ত। একেবারে হঠাত্‌ পাওয়া। পুরানো ফাইলপত্র গোছাতে গোছাতে বেরিয়ে পড়লো। ওরাক কি ভুল করে ফেলে গেছিলো রুশার জিনিসপত্রের মধ্যে?

ওরাকের কথা চলছে- " ফিনিক্স-1 এ যখন প্রথম আমাকে জাগানো হলো সেই মুহূর্তটা মনে আছে আমার। হাল্কা ছায়া ছায়া উষ্ণ কোমল একটা মুহূর্ত। সর্বাঙ্গঢাকা সাদা, নীল, কমলা পোষাক পরা কারা যেন ঘুরছিলো চারপাশে, আমি জেগে ওঠার প্রথম নড়াচড়া প্রকাশ করার পর একজন এগিয়ে এসে আমার কপালে হাত রাখলো, মাপা গলায় বললো, "সিস্টেম রিস্টার্ট। এমেমটি ওয়ান।" ধীরে ধীরে আমার তাপমাত্রা বাড়ানো হচ্ছিলো। আমার স্মৃতি আর কার্যক্ষমতা অ্যাক্টিভেট হচ্ছিলো। নানা কিসিমের সিস্টেম ইনস্টল করা হচ্ছিলো আর ওই সাদা কমলা নীল পোষাকে ঢাকা ওরা মাপা মাপা গলায় নির্দেশগুলি উচ্চারণ করে যাচ্ছিলো। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হচ্ছিলো না, যথাসম্ভব স্মুদলি হয়ে যাচ্ছিলো, খাপে খাপে বসে যাচ্ছিলো স্কিলসেট। কিন্তু কোনো কোনো ইনস্টলেশানের সময় অনেক বেশী সময় লাগছিলো, তীক্ষ্ণ একটা যন্ত্রণার অনুভূতি হচ্ছিল। হয়তো আমার কল্পনা! ধাতব রোবট যন্ত্রণা বুঝতে পারে নাকি? ওরা জেনেশুনে যেসব জিনিস আমায় অনুভব করতে দিয়েছে তার বাইরের কিছু কিকরে আমি অর্জন করবো? কল্পনাই হয়তো।"

রুশা পড়তে পড়তে থামলো এখানে, সে খুব অবাক হয়েছে। রুশা কোমল লিকুইড- ক্রিস্টাল আর পলিমারের রোবট, বাইরে থেকে দেখতে প্রায় মানুষের মতন, তাই নী দিওতিমা তাভাম রা ওকে কাছের মনে করে। রুশার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও অনেক উঁচুদরের। সে শিক্ষিকা। ধাতব রোবটের তুলনায় তাদের চিন্তাভাবনা ও অনেক সূক্ষ। পড়তে পড়তে রুশা ভাবলো- আশ্চর্য! ওরাক এসব কি লিখেছে? যন্ত্রণার কথা! যন্ত্রণা কাকে বলে?

জোর করে ভাবনা থামিয়ে রুশা পড়ে চললো ওরাকের নোটবই-

"ফিনিক্সে প্রথমে আমার কাজকর্ম ছিলো সাধারণ, অনিয়মিত। সর্বক্ষণের কাজকর্ম কিছু ছিলো না। কখনো কখনো প্রয়োজন পড়লে হয়তো প্রকৌশলীদের সাহায্য করা বা সার্ভিসিং এর কোনো কাজ থাকলে তা করা। বেশীরভাগ সময় এইসব প্রয়োজন পড়তো আন্ত:-গ্যালাক্টিক ওয়র্পড্রাইভের সময়। যদিও ফিনিক্সের ভ্রমণপথ প্রি-প্রোগ্রামড, তবু স্পেসটাইমের ফাঁক দিয়ে ঝাঁপের সময় অতিরিক্ত কিছু প্রস্তুতির দরকার হতো। তো, সেইসব সময়ে প্রকৌশলী রোবটদের সাহায্য করতে হতো। তখন আমি সাময়িকভাবে বিশ্রাম ত্যাগ করে কাজে মেতে উঠতে পারতাম। কিন্তু তারপরে আবার যে কে সেই। কাজ নেই,কাজ নেই। শুধু নিশ্চল বসে থাকা অপেক্ষা করে। কি যে কষ্টের সেইসব সময়গুলো! সময় যেন কাটতেই চাইতো না।

এই প্রায় নিষ্ক্রিয়য় অবস্থায় চুপ করে বসে থাকার সময় শুধু একদম ভেতরের একটা ক্ষুদ্র নিউক্লিয় শক্তি-উত্‌স সক্রিয় থাকতো। মাইক্রো-ফিউশনের চারটে ইউনিটের মধ্যে মাত্র একটা চালু, বাকী তিনটে বন্ধ। সেই একটা নাকি কখনো থামে না, থামলেই নাকি সব শেষ। এই "সব শেষ" কথাটার মানে আমি কোনোদিন বুঝতে পারিনি, শুধু একটা শিরশিরে ভয় ঝিনঝিন করতে থাকতো কথাটার মধ্যে। কিজানি হয়তো তাও আমার কল্পনা!"

এইখানে এসে আবার রুশা থামে, সে ভাবে সে নিজে কি বুঝতে পারে "সব শেষ" কথাটার মানে কি? ডিসম্যান্টল করে ফেলা মানে শেষ, কিন্তু তার পরেও থেকে যায় মেমরি কিউব, সেইগুলোও যদি ইরেজ করা হয়, তাহলেও হয়তো কোথাও থেকে যায় কিছু। যেমন রয়ে গেছে ওরাকের নোটবই, সত্যিই কি সবকিছু শেষ হয়?

ঝাপসা চোখ পরিষ্কার করে আবার রুশা পড়ে চলে- " অপেক্ষার সময়গুলো বড় দীর্ঘ লাগতো, একসময় কেমন একঘেয়ে লাগতে শুরু করলো যদিও আমার তা লাগা মোটেও উচিত ছিলো না। কিন্তু আমার তো অনেককিছুই অনুচিত। প্রথম থেকেই আমার সন্দেহ ছিলো যে আমার কলকব্জায় কোনো বিরাট কিছু গন্ডগোল আছে যা কিনা কেউ ধরতে পারে নি। সেই গন্ডগোলের ফলেই আমার নানা উদ্ভট অনুভবের ব্যারাম! অনুচিত সব ভয়ভাবনা এসে থানা গেড়েছে আমার মধ্যে! আমি বিশেষজ্ঞ রোবটদের কাছে গিয়ে থরো চেকাপ করালাম, তারা সবকিছু খুঁজেপেতে দেখে রায় দিলো সব ঠিকঠাক। অথচ আমার অস্বস্তি, ভয়, একঘেয়ে লাগা, বিরক্ত লাগা এসব রয়েই গেলো। আমি পরে খুঁজে খুঁজে এসব শব্দ জেনেছি, রোবটদের মধ্যে এসব শব্দের প্রচলনই তো নেই! মানুষের অভিধানে এসব আছে, কারণ এইসব নিতান্ত ইন-এফিশিয়েন্ট আর ভেজা-ভেজা ব্যাপারগুলো মানুষেরই একচেটিয়া অধিকারে। এইসব দোষই নাকি মহত্‌ গুণ হয়ে দেখা দেয় মানুষের ক্ষেত্রে,কারণ তারা স্রষ্টা, নতুন পথের সন্ধান তারা দিতে পারে। তাই এইসব নেসেসারি ইভিল তারা বহন করে। তা হবে, আমি আর কিকরে তা জানবো? আমি মেটালরোবট, আমার জীবনে এসব অহেতুক বোঝামাত্র। আমার ক্ষীণ একটা সন্দেহ আছে পালিমার রোবটেরা হয়তো এসব কিছু কিছু অনুভব করে কিন্তু কাউকে বলে না। ওদের বুদ্ধিমত্তা আমাদের থেকে অনেক উঁচু, হয়তো তারাও স্রষ্টা, হয়তো তারাও নতুন পথ দেখতে পায়! " আবার রুশার মুখে ক্ষীণ হাসি দেখা দেয়, বাইরের থেকে কিছু বুঝতে পারা কত কঠিন! সে, পলিমার রোবট, সে কি স্রষ্টা? সে কি নতুন পথ দেখতে পায়? সে জানে,না, না,না। সে শুধু নিয়মমালা পালন করে। অথচ ওরাক ভাবতো তারা কত জানে, কত বোঝে!

"এইসব অপেক্ষার সময়গুলো ক্রমে ক্রমে আরো বেড়ে গেলো। আমার পক্ষে আরো অসহ্য হয়ে উঠলো সব। আন্ত:-গ্যালাক্টিক ওয়র্পড্রাইভও কমে গেছিলো অনেক, তখন মানবশিশুদের তৈরী করা শুরু হয়ে গেছে- চিকিত্‌সক রোবটদের ব্যস্ততা তুঙ্গে। ন্যানি রোবটদের ট্রেনিং শুরু হয়ে গেছে। ওদের কাজের ব্যস্ততা দেখে ঈর্ষা হতো। এও এক অচেনা অনুভব, কেমন একটা খোঁচা লাগার মতন,কিন্তু মেটাল নেইল নেই, স্পার্ক নেই, কিছু নেই, তাও খোঁচা। রহস্যময়। আমি জানি আমার উচিত ছিলো আবার চেকাপ করানো, কিন্তু আমি যাই নি। জেনেশুনে সেই আমার প্রথম নিয়মলঙ্ঘন। " রুশা কেঁপে ওঠে,নিয়মলঙ্ঘন করা তাহলে সম্ভব? সে ঠোঁট কামড়ায়।ভাবতে চেষ্টা করে ওরাককে দেখে তার কখনো অন্যরকম কিছু মনে হতো কিনা! না, সবসময় ওরাককে সাধারণ নিয়মবদ্ধ বলেই মনে হয়েছে! কোনো অস্বাভাবিক কিছু সে লক্ষ করেনি। তার পর্যবক্ষণ শক্তি ভালো, কেন তাহলে কিছু সে অনুমান করলো না?

আবার সে পড়তে থাকে-"একসময় আমি ডাইরি লেখার কথা ভাবতে শুরু করলাম। নিয়মে কোথাও বলা ছিলো না যে রোবট ডাইরি লিখতে পারবে না। আমি সেক্ষেত্রে কোনো নিয়ম ভাঙি নি। ডাইরি লিখতে লিখতেই আমি শিখতে থাকলাম অনেক কিছু। সাধারণ তথ্যভান্ডারে আমার অ্যাক্সেস ছিলো বলে বেশীরভাগ জিনিসই আমার পক্ষে জানা সহজ ছিলো। কিন্তু শুধু তথ্য জানা আর জিনিসটা আসলে বুঝতে পারা যে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার, তা তখনই বুঝতে শিখি।"

রুশার রিসিভারে ডাক আসে, সে তাকায়। নী ডাকছে। এখনই তাকে যেতে হবে সংরক্ষিত তথ্যের ঘরে, এখন অবশ্য নী'দের কাছে সবই অ্যাক্সেসিবল। তাদের বয়স সতেরো হয়ে গেছে। আর কিছুদিন পরেই ফিনিক্স-১ পৌঁছবে গন্তব্য গ্রহে।

রুশা নোটবই বন্ধ করে গুছিয়ে রাখে, পরে বাকীটা পড়বে। এখন নী'র কাছে যেতে হবে, নী'র ডাক উপেক্ষা করার প্রশ্নই ওঠে না। রুশা নী'কে জানায় সে আসছে এখুনি।

(To Be Continued)

Friday, June 20, 2014

Children Of Earth(1)

1.

Meghan remembered the crystal-clear sky of that late fall afternoon, she was about five years old then. The day was sunny with the dry, cool north wind flowing through the leaves of evergreen trees- mango, black-berry and coconut trees. Wind shook the hard, brown branches of deciduous trees, getting ready to shed their leaves.

     There was an old lady lying down on the mattress under the shadow of a jackfruit tree. The old lady was accompanied by a little girl- a young kid with rosy cheeks and bright, dark eyes.

The old lady unfolded a story of a forgotten land with many rivers and green paddy-fields and bamboo bushes. The story was about a little girl named Tuya who had seven older brothers. Their parents died of illness. Those seven brothers were merchants, they sailed to the sea in their large ships but Tuya stayed back in their home. What happened then?

     Meghan couldn't remember clearly what was in that story after that event, but she could still remember the old lady, her grandma, she was so nice to her, so caring! Closing her eyes, Meghan can still see her loving face, those zigzag lines of old age on her cheeks, around her eyes, on her chin. Meghan could clearly picture her sharp nose and her loving smile.

     Meghan remembered other stories. The story of a young-man named Nathan going  back to his long-forgotten country after the independence. He visited his childhood village and the school where he was a student long time back. Many people came to see him, the kid who left the village long time back now returned as a fully grown man!

The old teacher of Nathan was still alive and working at that same school. The delighted old man asked Nathan to teach some of the classes. Nathan gladly accepted that offer, many joyful and happy moments came when he taught in that school. Just like all good things, that short period ended, Nathan left again. Meghan couldn’t remember more, what happened to Nathan after that?

    There were many more stories Meghan could remember, all of those stories were like the stories of the nomads- various events, and experiences here and there and always there was a never ending thirst for a land- a vast, green land full of rivers and trees, from where they won't have to be uprooted!

    Meghan placed her fingers on the map stretched out on the table, there were so many lines on the map, borders and borders, frontiers, check points, border security forces, the men with firearms, sentinels of the countries! Why so many lines? Thorny borders to prevent the invaders? Who were those invaders? She tried to feel those thorns under her fingers while sliding along those lines.

   Meghan didn't know why she felt so sad, so lonely, so detached from everything around her! Ron was at work, he wouldn't be back until 6 o'clock. He would have to drive for about 40 minutes to reach home. After that he will take Meghan to eat out at their favorite Chinese restaurant. But what would Meghan do for the whole day? 

     Tic Tic Tic Tic---moments were slow, so slow! Meghan threw a blanket on the carpet, stretched herself on that, tried to meditate. Otherwise all those sad memories would come again and will keep coming in and those memories wouldn’t let her rest.

All those dark stories of helpless people, uprooted from their homes and going towards uncertainty would haunt her. It didn't happen to her personally but why all those stories always kept coming to her? So vivid, so alive as if they wanted to be expressed through her, with all their living moments.

     Meghan tried to relax, untied her mind. She tried to take her attention away from every part of her body which could feel anything. She started from her feet, then legs, thighs, waist, belly....

After the full relaxation she felt floating in air ; her depression faded away, she felt she was sinking in an ocean of slumber.

In her dream, she saw a small hut near a vast field, felt a cool wind of winter. She saw mist coming over the landscape and then suddenly she saw a man, sitting on a soft dry grass-mattress near a lamp, that middle-aged man was busy writing on some parchment-like paper with a long white feather.

He paused and dipped the long feather’s narrow end into an inkpot. There was a half closed door behind his back, passing that door in dream,  Meghan saw two little girls of about five years of age were sleeping on a cot.

  Meghan couldn't remember them from her conscious memories, but in dream she could easily relate them very close to her, as if they were her own.  Meghan, in her dream, knelt down near the kids, both kids were sleeping.  Meghan placed her hands gently on the foreheads of the sleeping kids before she leaned to kiss them.

Sunday, June 15, 2014

বৃষ্টিঘ্রাণ

ঝাঁঝালো রোদ্দুরে শহর জ্বরে পোড়ে
পাথুরে ফুটপাথে আগুন ঢল,
হঠাৎ ঝড় রঙে তোমার কথা এলে
ক্লান্ত সন্ধ্যাটি সুরবিভল।

রূপোর ক্রীতদাসী খোলস ঝেড়ে ফেলে
আকুল মুখে মাখে বৃষ্টিঘ্রাণ,
স্মৃতির ঝাঁপি খুলে হারানো মালা তুলে
ছায়ার দিঘিটিতে অলীক স্নান।

মেঘ তো সেদিনও এমনই ছিল নীল
এমনই বুকে ছিল বজ্রবীণ,
হঠাৎ খাঁচা ভেঙে আলোর ডানা মেলে
কথারা পাড়ি দিল ঠিকানাহীন।

সেসব কথাদের শ্রোতা তো ছিল কেউ
কেউ তো শুনেছিল মেঘলা গান,
হঠাৎ ঝড় রঙে তোমার কথা এলে
চমকে জেগে ওঠে ঘুমানো প্রাণ।

Mirror-image

Steve drove all night long through the desert. When he reached the city, sun was rising. Rita knew he was coming; he called her last night when he stopped at a gas station.

Steve saw her waiting at the front-porch. Rita, his high-school sweetheart, still so pure, so fresh, so loving! Rita came forward when he parked and got down from his car. Steve smelled jasmine when she embraced him.

“Such a long time! Did you miss me?” she said.

“I missed you.I missed you every day, every moment I was away.” he said.

Rita laughed and kissed him.

Steve went to take shower while Rita was preparing breakfast. Steve felt fresh after a good shower in fragrant warm water. Only a little doubt, like a thin thorn, pricked his heart.

Last night when he was driving through the desert, he stopped for half an hour. He felt lost. He couldn’t remember anything during an interval of time just before his getting up and encountering a storm. A total dark patch in his memory.

After the hole in the continuum of his memory, the first thing he could recall was that he got up as if from a deep sleep. It was all dark and stormy. The whole lab complex was out of power! Why? Power line must have been damaged severely.

Then how come he hadn’t been concerned! Such a strange feeling! Everything was mingled so badly that Steve couldn’t put the pieces together in right place. It was very puzzling! On desert, after thinking hard for half an hour or so, he couldn’t get any clue to solve that puzzle.

Then he decided not to think anymore and to reach Rita as soon as possible. He first searched for his cell-phone, it wasn’t with him! He stopped at a gas-station and used the pay phone to call Rita in the middle of the night. He was much relieved when Rita responded. At least, that part of his life was intact!

In the morning, after her warm welcome, he was more relieved. While taking shower, that strange helplessness came back for a moment. Steve, with all his mental strength, refused to accept it and came out refreshed.

Rita and Steve got married next day and then they went to their honeymoon to an island. Rita switched off her cell-phone( Steve didn't have his with him) for the whole honeymoon time, they didn’t want to be interrupted.



*******

Real Steve woke up in the clinic of the lab complex where the cloning project was being done. He had internal hemorrhage at that night of disaster when the lab complex had power failure for a whole night.

The high-security chamber where the jar containing the clone was kept, got struck by lightning. Steve happened to be there at that time and he fell unconscious. Several hours later, security guards rescued him and transported him to the clinic.

They found the broken container lying on the wet ground with the chemicals but they didn’t find the clone Steve. Research team knew that time was almost ripe for clone Steve, an adult fully grown man with all the memories of real Steve up to his twenty-seventh birthday mapped to his brain, to come out of that jar and start to live like a twin of real Steve. But disaster did strike.

Steve recovered from coma several days later. Then slowly he gained strength and remembered what happened. But he also had no clue of what happened to his clone.

After several days, he called Rita. Nobody answered, Rita wasn’t home.



*******

Rita and Steve just got back from their two weeks honeymoon. Now, they were the happiest couple in town. A call came very early in the morning. Rita received the call while her husband was still asleep by her side.

“Hello, Rita, I’m Steve here. How’re you doing?”

“Who? Steve? Steve who? What’s your full name? ”

“What? Rita, what happened to you? Are you mad at me? ”

“Look, I don't know who you are but please don’t call us in such early morning, we just came from our honeymoon and we’re quite tired.”

“Rita, Rita, please don’t hang up. Did you say honeymoon? ”

“What is it? Why are you asking such weird questions in such an odd hour? See, I don’t know who you are, but listen, I’m married to Dr. Steven Winfield, and we just got back from honeymoon.” Rita switched off the cell phone.



**********

Steve arrived to Rita after four days. His therapist, Dr. Christina Weber drove him. Steve was nearly dead. He couldn’t sleep or eat for two days, had a fever and delusion. His weak body which was recovering from illness couldn’t bear that sudden shock.

Rita and her husband welcomed Steve and Christina at the main-gate. Previous night, Christina called Rita and told everything about Steve and his crisis. Though very shocked, but Rita was prepared.

Clone Steve approached original Steve, his hands were shaking, nobody knew or could imagine what he had gone through. Only a dark shade on his face was showing a glimpse of his agony. A mere copy of a man, carrying all the memory of his life, illegally enjoyed the pleasure and happiness stored for the rightful man.

Clone Steve knelt down before real Steve and looked at his eyes. With a shaking,faint voice he said,“I beg you to kill me right now. I’m a mistake, a big mistake. My existence is wrong. Free me from all these agony.”

Real Steve stared at his copy for several moments. His copy, his clone! Another man with the same identity! As if he looked at his image in mirror. So similar but still so different! Two different people from the same original code. After some breathless moments, Steve placed his hand gently on his clone’s shoulder and smiled.

“Get up. Don’t be so sorry. From now on, we’ll be different persons. We’ll have different experiences and different memories. Together we’ll be rich.”

Slowly, clone Steve got up, his eyes got bigger in surprise when real Steve took his hands and joined those with Rita’s hands.

Real Steve said,“Rita and Steve, I wish you a very happy life together.”



___________

Tuesday, June 10, 2014

প্রজাপতিডানার রেণুধূলি

একদিন ভাবছিলাম আর লিখবো না । প্রবাস বা স্বদেশবাস--কোনো কিছুতেই আর কিছু তফাৎ দেখতে পাই না। সর্বত্রই সেই একই ভালোমন্দ আলো-অন্ধকার আসে যায় আসে যায় আসে যায় একইরকম। সেই মেঘ-রোদ্দুর-বৃষ্টি সেই মনখারাপ মনভালো---একই সব।

কী হবে লিখে? চোখ মেলে দিয়ে কান খুলে দিয়ে মনের দরজা খুলে চুপ করে বসে দেখাই ভালো। মানুষের হৃদয়ের আলোছায়ার খেলাও তো এই আকাশ বাতাস মেঘরোদবননদীর উপরের আলোছায়ার খেলার মতনই। যারা সত্যিকারের অনুভবী লেখক, যারা সত্যিকারের সূক্ষ্ম স্পন্দনশীল হৃদয় নিয়ে পৃথিবী দেখেন-তারা হয়তো পারেন এই আলোছায়ার খেলা তুলে ধরতে। আমার পক্ষে চেষ্টা করাই মূঢ়তা।

তবু মাঝে মাঝে আকুলিবিকুলি করে ওঠে মনের ভিতরে, না-ফোটা ডানার কুঁড়ি চঞ্চল হয়ে ওঠে, তখন কে যেন কলম তুলে দেয় হাতে, কারা যেন কানের কাছে ফিসফিস করে ওঠে, অনেক অনেক স্বর--- হাল্কা কচি স্বর,গম্ভীর জোরালো স্বর, মেয়েলী কোমল স্বর-সে প্রায় গানের মতন সুরেলা,দানা-দানা পুরুষালী স্বর,তীক্ষ্ণ চড়া স্বর, তরুপত্রে বাতাসের মর্মরের মতন নরম স্বর--- ওরা বলে,"বলবে না আমাদের কথা?"

কাগজের উপরে কলম সরে সরে যেতে থাকে,অক্ষরের পর অক্ষর--শব্দের পর শব্দেরা উঠে আসতে থাকে,এসব ঐ স্বরগুলির গল্প--একসময় দেখি তাদের গল্পের একেকটা অংশ কখন পুরো বা আধা ফুটে উঠেছে কাগজের উপরে। তখন ঐ কুঁড়ির মতন ক্ষুদে ক্ষুদে শব্দগুলি কথা বলতে থাকে, অন্ধকার থেকে আলোর ফুলের মতন ফুটে উঠতে চায় তারা,তাই...

নইলে এসব লেখা...অতি সামান্য ব্যাপার, অতি সাধারণ মানের... কত ভালো ভালো সফল লেখকেরা আছেন,তাঁরা আরো কত ভালো করে বলতে পারতেন...

প্রতিটা লেখার পরেই এমনি একটা মনখারাপী রঙ লেগে যায় মনের আকাশ জুড়ে, কিন্তু সব রঙ মুছে গিয়ে যখন তারারা ফুটে ওঠে মধ্যরাত্রিনীল জুড়ে তখন মনে হয়-এই যে চেনা-অচেনা জীবনগুলো বয়ে চলেছে সুখে দুঃখে আনন্দে বেদনায়, এই যে আলোছায়ার খেলা চলছে নিরন্তর--এরা কোথাও না কোথাও থেকে যেতে চায়, তাই অজস্রের স্বর হয়ে কোলাহল করে, কোথাও না কোথাও পূর্ণের পদপরশ পেতে চায় সব ঘটনাই। এই লেখাগুলোর মতন অতি তুচ্ছ ক্ষুদ্রও।

মনভালোর নীলসবুজগোলাপী কারুকাজ অমনি আবার ফুটতে থাকে।উড়ে যাওয়া প্রজাপতির পক্ষ্মধূলির মতন নরম সেইসব চঞ্চল পলাতক গল্পমালার দিকে চেয়ে হাসিমুখে ফিরে বলতে পারি সেই তরুণ কবির মতন,"শুভেচ্ছা নাও। হারিয়ে যেও না।"

এখানে দেখতে দেখতে গ্রীষ্ম চড়ে ওঠে রোদ্দুরে, ল্যাকপ্যাকে ব্যাকপ্যাক পিঠে নিয়ে হেঁটে আসে ইস্কুলের ছেলেপুলেরা। স্কুলে ওদের এসময় ছুটি বলে নানারকম প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ওরা আসে এসময় ইউনিভার্সিটি দেখতে।

প্রায়ই দেখা যায় একঝাঁক অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে তাদের বিশেষ ধরণের পোশাক পরে বড়ো বড়ো লম্বাটে গাড়ী থেকে নামছে রেসিডেন্স হলগুলোর সামনে। সামনের শরতে যারা কলেজে উঠবে তারা গ্রীষ্মের ছুটিতে প্রচুর ভিজিট করে উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্রগুলো।

আর দেখি লম্বা সাদা পোষাক আর মাথায় কালো ভেল পরা পাঁচ-ছ'জন তরুণী সন্ন্যাসিনীকে,সবসময় ওরা ক'জন একসঙ্গে চলে, অংকের ক্লাস নিতে যাওয়াই হোক, ক্যাফেটেরিয়ায় খেতে যাওয়াই হোক বা জিমনাশিয়ামে যাওয়াই হোক। ওরা শুধু সামারেই ক্লাস করে, তারপরে ফিরে যায় ওদের চার্চে, রোমান ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনী এনারা।

গাছপালার সবুজ এখন খুব ঘন, ঝড়বৃষ্টি না থাকলে আকাশ এত নীলকান্তমণির মতন পরিষ্কার নীল যে দূর্গাপুজোর কথা মনে পড়ে যায় বারে বারে। চত্বরের চারধার ঘিরে অজস্র কাশফুল, এগুলো আমাদের পরিচিত কাশফুলের মতন হাল্কা নরম না, বেশ স্থূল, ঝাপালো। কাশঝোপও শনঝোপের মতন বেশ গোছাধরা। এই ফুল শীতের কটা মাস বাদ দিলে পায় সারাবছরই হয় এখানে।

মনে পড়ে কীর্তিকে, মনে পড়ে শ্রুতিকে, ওরা দুই বোন, কীর্তি ছোটো, শ্রুতি বড়ো। কীর্তি ছমাস ছিলো এখানে, কদিন আগে চলে গেলো অনেক উত্তরে ওর দিদির কাছে। সেখানে মাস দুই কাটিয়ে যাবে মধ্যপশ্চিমের এক রাজ্যে পড়াশোনা করতে।

এখানে ওকে অমল বন্ধুত্ব ও সান্নিধ্য দিয়েছিলো যে পরিবারটি, সেই পরিবারের কর্ত্রী ক্যাথিকে মনে পড়ে, হাল্কা চেহারার মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা, গত শীতে ক্রিসমাসের কিছু আগে ওঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় এই কীর্তি আর আরেক বন্ধু থাজিং এর সূত্রে। আমাদের নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছিলেন তখন।

ওদের মেয়ে ভ্যালেরিকে মনে পড়ে, ভ্যালেরি এখন নাচের গ্রুপ খুলেছে শহরে। কিশোরীর মতন নরম চেহারার মিষ্টি মেয়ে ভ্যালেরি। আমারই এত মনে পড়ে ওদের অত অল্প দেখাসাক্ষাতেই, কীর্তির নিশ্চয় অনেকদিন ধরে ওদের মনে পড়বে অনেক অনেক প্রহরে। ওকে ওনারা প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নিয়ে যেতেন কোথাও না কোথাও।

এখান থেকে চলে যাবার আগে ক্যাথিদের কমুনিটি চার্চে ব্যাপ্টিজ্ম হলো কীর্তির, সেদিন ও ক্যাথিদের বাড়ীতে ওর জন্য পার্টি ছিলো। কীর্তি ওর অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিচ্ছিলো সকলের সঙ্গে, ধার্মিক হিন্দু গুজরাতী পরিবারের মেয়ে হিসাবে মুম্বাই শহরে বড়ো হবার সময় ওর ধর্ম নিয়ে কী অভিজ্ঞতা হয়েছিলো, সেইসব।

কনভেন্টে পড়াশোনা করতো ওরা দুই বোন, ষোলো বছর বয়সে ব্যক্তিগত বিপর্যয়ে প্রথম ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ে ও,দিদি শ্রুতি এই ব্যাপারে সাহায্য করেছিলো ওকে। কীর্তি বলছিলো কেমন করে বাড়ীতে ও বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখতো বাইবেল, কেমন করে প্রার্থনা করতো স্নানঘরে জলের কল খুলে দিয়ে যাতে কেউ শুনতে না পায়, কেমন করে ও ওর মায়ের সঙ্গে মন্দিরে গিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতো, এখানে আসার পরে প্রথম কিভাবে ও স্বাধীনতা পেলো ধর্মাচরণের----সেসব।

সুখ ও দুঃখের কুসুমেরতনে গাঁথা মালা, এর মধ্য দিয়ে গড়িয়ে যায় জীবন, জীবনের মতন। মানুষ মানুষকে খোঁজে, কথা বলতে চায়, সঙ্গ চায় মানুষের। কখনো আবার চায় না সঙ্গ, একাকীত্ব চায় ভীষণভাবে।

মানুষের মন অতি বিচিত্র। কেউ কি আজও এর রহস্যের কোনো তল পেয়েছে? কোনোদিন কি পাওয়া সম্ভব? কীজানি, না পাওয়াই হয়তো ভালো। বিস্ময় থাক জীবনের কোণায় কোণায়---প্রতিদিন সকালে শিশুর উৎসুক উজ্জ্বল চোখের সামনে দু'হাত মুঠো করে নতুন দিনটি যেমন বলে,"বলো তো, কী আছে এই মুঠোতে?"

মনে পড়ে জেনিনের বাড়ী, বেশ ক'বছর ছিলাম সেখানে। জেনিনের অনেক পোষা কুকুর ছিলো, বেড়াল ছিলো। আর ছিলো বাগান। সেখানে জেনিন নানা ফুলগাছ লাগাতেন, টোমাটোগাছ আর জুকিনিস্কোয়াশের গাছ লাগাতেন। একবার লাগিয়েছিলেন লালজবার গাছ, কিন্তু শীতের সময় ফ্রস্ট পড়ে পড়ে সে গাছ মরে গেলো।

একবার এক সাদা হাঁস এসে আশ্রয় নিয়েছিলো কাঠের ঘরের তলায়-দু'খানা ছানা হয়েছিলো কদিন বাদে। একটা সাদা, একটা রঙীন। রোজ ভোরে মা আর দুই ছানা খাবার খুঁজতো। সাদা ছানাটা হারিয়ে গেছিলো একদিন, ওদের মা বড়ো বড়ো পা ফেলে প্যাঁক প্যাঁক করে ডেকে ডেকে খুঁজছিলো। খানিক পরে খুঁজে পেলো। ছানারা বড়ো হলে তিনজনে উড়ে চলে গেলো নিজবাসে। কেজানে কোথায় ওদের ঘর! হয়তো অনেক দক্ষিণে সমুদ্রের তীরের নারিকেলবনে।

জেনিন এত পোষ্য ভালোবাসতো বলেই কি এভাবে অতিথি পাখিরা আশ্রয় নিতো এখনে? ওরা কি বুঝতে পারে কে ওদের চায়? ওদের ডানায় কি লাগে ভালোবাসার অদৃশ্য তরঙ্গ? কেজানে!

জেনিনের কথা শুনেছিলাম ওঁর নিজের মুখেই। জেনিন নিজেও ছিলো পোষ্যপুত্রী। জেনিন আর ওর যমজ ভাই--এই দুজনকে পালক পিতামাতা গ্রহণ করেন আপন সন্তান হিসাবে--একদম ছোটো ওরা তখন, জেনিনের নিজের নাকি জন্মের পর কয়েকদিন বাঁচার আশাই ছিলো না কি একটা অসুখে।

তারপরে ভালো হয়ে গেলো,পালক পিতামাতার ঘরে বড়ো হতে লাগলো। দেশের নিয়ম অনুযায়ী ছোটোবেলাতেই আস্তে আস্তে জানতে পারে যে ওরা দত্তক ছেলেমেয়ে। তারপরে জেনিনের পড়াশোনা, পড়া করতে করতেই বিবাহ ও সন্তান, তারপরে একসঙ্গে চাকরি ও সন্তানপালন, বিবাহবিচ্ছেদ, পুনর্বিবাহ, দশক অতিক্রান্ত হলে আবার বিচ্ছেদ, এখন একা একাই,মাঝে মাঝে বিবাহবিচ্ছিন্ন স্বামী দেখা করতে আসেন, এখন ওনারা ভালো বন্ধু---সব অবলীলায় বলে গেলেন স্বাভাবিকভাবে। অবশ্য এখানকার নিরিখে খুব অস্বাভাবিক বা অন্যরকম জীবন নয়, হয়তো জেনিনের নিজের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও অনেকের জীবন এরকমই ছিলো।

কুকুর পোষার নেশা নাকি জেনিনের খুব অল্পবয়স থেকেই, ওনার যখন নিজের দুই শিশুকন্যা আর সংসার চাকরি সব ছিলো, তখনো নাকি পুষতেন। ভ্রুণ অবস্থাতেই ঝরে যাওয়া শিশুপুত্রটির কথাও বললেন, ছেলেটি জন্মালে একটু বড়ো হলে তাকে নিয়ে ওর বাবা নৌকা করে ফিশিং এ যাবার স্বপ্ন দেখতো। কিন্তু সে তো হলো না!

কিজানি স্থায়ী সংসার আর প্রেমিক-স্বামী/প্রেমিকা স্ত্রী আর উজ্জ্বল সন্তানেরা---এইসব হয়তো সব মানুষই চায়, কিন্তু যা চাওয়া যায়, সবসময় তা মেলে না, তাই স্বপ্নকল্পনা অবসরমুহূর্তের ভাবনায় থেকে যায় এইসব---আহা যদি অমন হতো! জেনিন রেজিস্টার্ড নার্স ছিলেন, ওর বড়ো মেয়েও নার্স হয়েছে-ছোটো মেয়ে স্কুলে পড়ায়। তারা কাছেপিঠেই থাকে,মাঝে মাঝে দেখতে আসে।

অদ্ভুতভাবে ওনার বড়ো মেয়ের জীবন খানিকটা জেনিনের মতন--বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে দুটি সন্তান নিয়ে সে পুনর্বিবাহিত হয় আরেক লোকের সঙ্গে।

ও বাড়ী ছেড়ে চলে এসেছি বহুদিন হলো,তাও মনে পড়ে যায়। কত মানুষ, কত ভিন্ন ভিন্ন রকম জীবনের গাথা।

মনে পড়ে সেই নাম-না-জানা বন্ধুটাকে, কোথায় সে আজ? পথের এক বাঁকে দেখা দিয়ে হাসিমুখে মিলিয়ে গেছে অন্য বাঁকে। আমাদের পুরানো শিক্ষকেরা আজ কোথায়? কেউ কেউ আছেন, মাঝে মাঝে দেখা হয় কালেভদ্রে, কেউ কেউ ধরাধামেই নেই, তাঁরা শুধু স্মৃতির সরণী বেয়ে দেখা দিয়ে যান। সেই সব পুরনো বন্ধুরা, স্কুলের বন্ধুরা, উড়ে গেছে পৃথিবীর কোণে কোণে, হয়তো মানুষের জীবনে এই চলাই কাম্য। চরৈবেতি চরৈবেতি।

স্মৃতিতে ভীড় করে আসে সোনালী গোলাপী পালকের মতন কিশোরবেলা তরুণবেলার বন্ধুরা,ওদের উৎসুক তরুণ মুখগুলো, আশাদীপ্ত, আলোয় উজ্জ্বল-সময় তখনো নখচিহ্ন আঁকে নি ওসব মুখে---প্রজাপতির ডানার রেণুর মতন উড়ে এসে লাগে ওদের গল্পগুলো আমার মনের পাতায়--- মধ্যগ্রীষ্মরাত্রির বাতাসের সঙ্গে ফিসফিস করে বলি,"ভালোবাসা নাও, হারিয়ে যেও না।"

Monday, June 9, 2014

Children of Dawn

I leaned forward to touch the black stone. My hairy hands reached the coarse, large, broken body of the black stone which was in front of our cave since the time immemorial. Now it had the reddish brown stains of blood on it. The remnant of yesterday's fight between Khush and Khuman.

I was the witness of their fight. I faintly recalled that Khush threw Khuman on this stone and tried to hit him with his hammer,Khuman moved his head and Khush's hammer hit the stone. The stone cracked apart. And then....then what happened? When did Khuman die?Did he die or did he flee away?

At that stage, our memory was not developed enough to recall all the details. We were not able to mourn over the loss of anything for a long time. We were half-human, our brain was still in a developing stage. We were half-tamed to form a tribe, half-wild to rebel and fight and either flee to the forest or die at the hands of the tribal leader.

Our emotions were acute and brief. We jumped, we screamed, we cried out loud. The defeated fell to the ground and writhed in pain when the victor danced and screamed in joy. Then we forgot. All of our memories were brief. We didn't have good enough long term memory necessary for a strong and long commitment. But it was coming.

Strangely, I felt an unknown pain somewhere inside me, something like the small rocks hitting me from inside. I felt weird, as if the trembling ripples on the river were trying to come out from myself. An unknown pain, like the unknown highland from where the big river came and the unknown lowland where it went.

Our tribe lived in a valley surrounded by the hills and thick forests. That green valley was our world. We didn't know what existed outside. Old wizards and witches told the tales of big hairy giants and bright winged people who dwelled outside. We didn't see them, we didn't want to see.

We were safe and happy in our green valley with a mighty river flowing through it. The river appeared between two hills far away where the big ball of golden fire jumped out of the blue line of the horizon every morning. It flew through the land and went towards the horizon where the golden fireball sank every evening.

The river was very important in our lives. She was not only a river, to us she was the river goddess, we worshiped her. The river which I could see clearly from the hilltop. The cave-front was on the hill, much higher than the ground level. Before yesterday's fight, the cave was Khuman's. Yesterday Khuman disappeared, either died or fled to the wilderness. Khuman's cave became Khush's cave after the decisive fight.

I looked at the clear blue sky and saw several vultures flying, were they flying above Khuman's corpse? Were they going to eat everything?

Yesterday Khuman was a strong, vivid, young life, brimming with activity and today Khuman's trace was nowhere. Again, I felt an acute pain somewhere inside me as if Khush threw a hard stone to hurt me. But there was no stone! Khush didn't strike me! He only threw his strong arms around me. I felt weak, I didn't want him but couldn't run away either. With his powerful hands he squeezed me hard. When his lips pressed against mine, I didn't feel like responding. The strange pain came back, the pain from inside, a strange feeling as if an internal fire burning me from within.

Khush didn't let me go, he enjoyed as far as he could and then he was exhausted, he fell asleep. I felt tired and heavy. I wanted Khuman to come back and take me to his arms. I wanted to weep and weep until Khuman's chest was flooded. But I knew Khuman disappeared and nobody knew where he was.

That time I didn't know that Khuman was to come back, he'll be born again, not only by himself, I will be born again with him. Through the agonizing ecstasy of developing a life inside another, the amazing thing which nobody could explain reasonably. We didn't have much reasons at that stage, we were still being developed, we were in a transition between untamed freedom and organised civilization.

*****

Adam shook my shoulder and asked, “Hey Erin, what are you doing here? When shall we start today's work? We're already late.”

I woke up from my dreamlike trance, all of a sudden I realized it was not the caveman's time, it was 21st century. Many many years passed!

Yet, the cave-front was still the same, even that broken stone was still there! Of course, there were no blood stains, those were washed off by the rain long long ago.

I stood up, dusted off my jeans and told Adam, “Let's begin.”

We started our fieldwork for our archaeology project . Me and Adam, the children of that foggy dawn far back in time, began our excavation to uncover the truth, the long forgotten truth of our origin.



*****

Frontier Friends

1

Alice slowed down her hyper-ship WLT03589. Then she reached for the hyper-com, the advanced communication-device provided by the Central.

“Hello Central, I'm A753 calling from WLT03589, are you receiving me? Over.” She repeated the same message three times as usual and then waited.

After half an hour, the reply came, “ Hello A753, we've received you at Central. Let us check your coordinates and let us know your condition. Over.”

Alice relaxed on a soft sofa, rest time was long, 24 hours, a whole day and night measured in earth time.

Oh, Earth! All of a sudden Alice felt homesick. She stretched herself on the suspended bed near the window and looked out. She saw billions of stars burning out there in ink-black space, millions of galaxies floating out there. Actually all of them are speeding away with a tremendous velocity, but from her viewpoint it was so calm, so peacefully quiet! She felt a deep, smooth touch of love and fell asleep.

About an hour passed quietly and then the stream of events started. Beep beep beep ....shrill, harsh alarms coming from all directions.

Alice jumped out of her bed. What happened? Suddenly had her ship's safety-system gone wild or what? Bright red lights were blinking everywhere, harsh and fearsome beeping sounds were unbearable!

Although too anxious to decide, Alice tried to put together her thoughts. Two way communication would take about half an hour if she tries to contact Central.

Alice looked at the clock and and saw she only slept for an hour! “ What could have happened in this short period of time? Has anything she did harmed the ship? Or any other danger appeared from outside ? ”

Alice tried to sort out things but she was totally clueless.

Suddenly a mechanical voice started, “A753, I'm your ship's safety-system speaking now. Please be prepared to take shelter in life shell. An unknown ship's coming towards WLT03589.”

Alice's heart began to pound faster and faster. An unknown spaceship? Where? Were there any humanlike beings in it? She looked out through the tiny window of the life-shell.

The speeding torus-shaped spaceship was clearly visible to her,the speeding torus was approaching her ship alarmingly fast. Alice knew safety system of her ship was prepared to fight with its all weapons ready, only she was thinking what would have happened if she could contact the torus-ship in some way? Was that impossible? What if there were living beings there? What if they were friends?



2

Alice found herself lying on a strange sea-beach, sand under her back was silky white, it was sunny and the sky was sapphire-blue. She saw coconut trees all around, she got up and walked towards the waves without worry. She somehow knew it was not all real, it was somewhat like a dream, but a sweet dream without horror or danger.

She touched the foamy water, it was lukewarm. She wanted to go into the water and play with the waves, she almost expected a couple of friendly dolphins to come and play with her. But at the last moment she changed her mind and turned towards the coconut trees and walked towards the grove to rest in cool shadow. It was there she met Cynthia.

Cynthia's planet, a little planet named Selena was in danger of getting hit by a planet size space-rock approaching it. The scientists and engineers were ready to launch a rescue project. But little Selena didn't have enough resources. So they asked for help to the capital planet, Edna. Edna was most powerful and resourceful planet of that spiral arm of their galaxy.

That appeal fell to deaf ear, Edna was busy with the war against the planetary terrorist groups. Strong and powerful Edna had no time to listen to little Selena.

As the time went by, some people who had means to go, fled Selena to other planets. But most people were still there, waiting for the complete death and destruction. Cynthia stopped there, her voice broke. Then she wiped her eyes and looked at Alice.

Alice sat like a marble statue, didn't move her eyes from her new friend for a moment. She listened Cynthia with all of her attention.

Cynthia said, “I was just floating around in space, without hope. I was just looking for something, somebody or some means to save my planet. I didn't really believe something would happen. All of a sudden, I found something. My devices detected a strange signal. It was caused by your spaceship. You came from anti-universe, your spaceship was made of anti-particles.

Then I contacted you by this dream spell, otherwise we couldn't talk. We were not allowed to go near each other beyond a certain range. Forgive me for using this dream technique, but I had no choice, I was so desperate to contact you!”

Alice assured her with friendly smile. Then said, “You don't have to apologize. What you did was right, perfectly good. If I were you, I would do the same. Now let me know, is there any way I can help you with?”

Cynthia said, “If you give me a ball of material, a chunk of metal or a dinner plate or anything like that, that can save us. We will only drop it on the approaching space rock, still far enough from Selena, if we drop your antiparticle plate on it, the part of the particle-made space rock will annihilate with it and the released energy will push the remaining rock from its orbit and Selena will be saved from getting hit.”

Alice was relieved. She thought, only this much? A chunk of material? She will do gladly. But how would Cynthia take it? Or would they have to throw it in such a way that it would hit the dangerous space-rock in such a way that it will change its orbit? In that case Alice would have to wake up and start computing and use the firing unit.

If Cynthia now takes off her dream spell, how will they communicate? In dream meeting, there is no language necessary,they're easily talking from mind to mind. In wakefulness, it won't be that easy.

She said, “Cynthia, I'll be glad to help you. Let me wake up and have the clear memory of this dream. So I can use my system to compute the orbit of that space rock. Don't worry, Cynthia, everything will be alright. Let me wake up first.”

Cynthia smiled a reassuringly, she said, “I'm not worried anymore. Alice, you'll remember everything of this dream when you'll wake up. I'm so sorry that we can't talk when you're awake. I don't know why there are so many different languages! We should have been hardwired for a common language. In that case we could communicate without any problem.”

Alice replied with a very soft voice, like the murmuring south breeze among the tender leaves of spring- “Cynthia, we're all hardwired for a common language, the language of love and kindness. You know that, don't you?”

Cynthia smiled but her eyes welled with tears, then the drops started to fall along her cheeks like a stream of tiny, shining pearls. Alice extended her right hand to wipe the tears, the tears of love and kindness.



3

Alice woke up smoothly. It was a dream but not all a dream. She will have to do a series of work now and everything have to be almost perfect otherwise Cynthia's home-planet Selena will not be saved from disaster. First she will have to turn on her probing and computing system and then start gathering information about Selena and the space-rock approaching Selena.

Alice smoothly started her job and tried to keep her nerve straight. A little anxiety or tension might have very bad consequences. She was careful to stay calm and focussed on her job. She succeeded doing that.

Alice's system was efficient, after a few hours of observation,the orbit of the space rock approaching Selena was calculated. The next step was to calculate the mass needed to change that orbit in which the space-rock will recede from Selena from the point where it will meet it's antimatter mass. After several hours, Alice's system prepared the ball from metal and clay. It was almost a perfect sphere with small geometric patterns on it. Alice held it on her palm, it reminded her of a toy globe she held in her childhood days. She wondered how that little and neat object will do a gigantic work, changing the orbit of a huge space-rock!

All the tiny particles she had in her body and around her were all antiparticles to Cynthia! Yet she was so similar to her! Yet she was so friendly! They were two young humans from the two sides of the frontier, the frontier which could never be crossed from either side.

Alice prepared her system to throw the sphere. When it was floating away with the initial velocity given by the system, Alice observed for a while. It was going away with the wings of fire around it, the little angel of fire to save a planet.

Alice felt a sweet tiredness, the tiredness people feel after a successful project. She stretched herself on the sofa by the window and then she fell asleep.

That dream-time seashore came back. There was that coconut grove again. And then, Cynthia. She was calm and quiet. She looked happier than before. Alice got up and shook her hands. Both smiled. Dream had its own advantages. In real life, they would not be able to shake hands.

Cynthia thanked her very heartily. Alice accepted.

“Do you know Cynthie, what do I want? I want to see you in real life. An impossible hope.” Alice tried to hide her sigh but wasn't fully successful.

Cynthia had the same wish, but it was not possible. Their frontier was as solid as death itself. If anyone would cross, will vanish in a flash of light immediately as soon as she touches anything. Still she wanted to hold real Cynthia's hands.

Sometimes human beings become so silly! They hope against all odds, they wait for a miracle to happen. And it happens, sometimes.

***

Friday, June 6, 2014

অন্তহীন নক্ষত্ররাত্রি

রাত্রি এক স্নিগ্ধ নদীর মত, ভোরের মোহনার দিকে বইছে চুপি চুপি। রাত্রি সেই প্রিয়তম মুখ, যা আমি কোনোদিন দেখিনি স্পষ্ট করে, স্বপ্নের ভিতরে আস্বচ্ছ নীলচে কুয়াশায় যে আকুল চোখ দুটি ভেসে থাকে।

বিস্মৃত এক সুবর্ণবেলাভূমি, নিরন্তর নীল সমুদ্র আছড়ে পড়ে যার বুকে, যেখান থেকে কেউ ফিরে আসে নি কোনোদিন-সেই উপকথার তীরভূমির মত এই রাত, দিনের রহস্যময়ী দিদি।

আমি আস্তে আস্তে ওর কোলে মাথা রাখি, চিৎ হয়ে শুয়ে চোখ মেলে দেখি আকাশে ফুটে উঠছে হাজার হাজার সহস্রদল পদ্ম।



পথেরা পথের মত থেকে যায়
নদীও নদীর মত উদাসীন বয়ে চলে-
অন্তর্জলিশয়ানে যে পড়ে থাকে
হাওয়া তার কাছে নিয়ে আসে
সুদূরের তরুক্ষীরগন্ধ।

মৃত্যুনীল চোখের পাতায়
শুক্ল রাত্রির জ্যোৎস্না ছুঁয়ে যায়,
তারারা ঝমঝম করে বাজে কানে-
সত্যিই ওপারের টান বড়ো গভীর।

ক্লান্ত প্রহরেরা ঘুম-ঘুম
ঘুমের ভিতর স্বপ্নেরা ছড়িয়ে যায়
অলীক পাখিদের নরম পালকের মতন,
ঘুম তো মৃত্যুর ছোটোবোন।
তার ভিতরকুঠুরিতে স্বপ্ন-
দিদির ভিতরকুঠুরিতে কি আরো উজল স্বপ্নেরা?
কেউ জানে না,কেউ দেখে আসেনি তো!

কোথায় কে যেন কাঁদে?
ছড়ানো ছেটানো টুকরো টুকরো বিলাপ,
একসাথে গাঁথা হলে প্রগাঢ় কান্না-
তবু শোনা যায় না
শ্রুতিতে অনন্ত অন্তর্জলি।

পথেরা পথের মত থেকে যায়
নদীও নদীর মত উদাসীন বয়ে চলে-----

Thursday, June 5, 2014

মিলনমেলা

একবার লিখতে লিখতে ভাবনায় পড়লাম কেন লিখি এসব? এইসব লেখার মধ্য দিয়ে কিছু কি পৌঁছে দিতে চাই? সদর্থক কিছু? তাই যদি হয় তাহলে কি সেই জিনিস, কি সেই বার্তা যা এইসব ছবিহীন গানহীন সুরহীন শুকনো কথা দিয়ে পৌঁছে দিতে চাই? কোনো উদ্দেশ্যই কি এতে পূরণ হয়?

সকলে নিজের নিজের সুন্দর দেশে নির্জনে স্বজনে প্রেমে অপ্রেমে সুখেদুঃখে বিরাগে অনুরাগে আছেন, কখনো ঝড় আসে বাসা ভাঙে, আবার দুর্যোগ থামে, রোদ ওঠে, ঝলমলে সুন্দর দিন আসে। এর মধ্যে পৃথিবীর এই ক্ষুদ্র কোণার এই সামান্য একটি মানুষের ততোধিক সামান্য দিনকথনের কোনো মানে আছে কি?

ভাবতে ভাবতেই একদিন এসে যায় দীপাবলি উৎসব,দেশে বাড়ীতে বাড়ীতে মোমবাতি বা প্রদীপ বা ছোট্টো লালনীল টুনিবাল্ব দিয়ে সেদিন সাজানো হয়েছে বাড়ীর চৌহদ্দি,ছাদের রেলিং, বাড়ীর পাঁচিলের উপরে উপরে অজস্র মোমবাতির শিখা কাঁপছে সন্ধ্যার বাতাসে।

আশ্চর্যভাবে প্রায় একই সময়ে এখানে হ্যালোউইন উৎসব,একত্রিশে অক্টোবর, মস্ত মস্ত মিষ্টিকুমড়োর ভেতরের সব কিছু বার করে নিয়ে গায়ে নানা আকারের ফুটো করে ভেতরে আলো জ্বেলে বাড়ীর দোরে দোরে বসিয়ে রাখা হয়, সেইদিন সন্ধ্যেবেলা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা বাড়ী বাড়ী যায় ক্যান্ডি চাইতে, তারা নানাধরনের অদ্ভুত পোশাকে সাজে, কেউ সাজে ভুত, কেউ প্রেত, কেউ দৈত্য, কেউ রাজকন্যা, কেউ দেবদূত। এসময় সব দোকানে দোকানে হ্যালো-উইন কস্টুমের হিড়িক পড়ে যায়।

এ উৎসব ভুতুড়ে একটু, আমাদের ভূতচতুর্দশীও তো ভুতুড়ে। হ্যালোউইনের পরেরদিন অবশ্য খুব উজল পবিত্র দিন, সকল সন্তের দিন-অল সেইন্ট'স ডে। আমাদের ভুতুড়ে ভূতচতুর্দশীর পরেও যেমন আসে দীপান্বিতা উৎসব, আলোর আহ্বান। এই আশ্চর্য মিলগুলো দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। আগে তো দেশে দেশে এত যোগাযোগের উপায় ছিলো না, হোস্টিলিটিও অনেক বেশী ছিলো, নানা অন্য অন্তরায়ও ছিলো, কিন্তু কেমন করে উৎসবে লোকাচারে বিশ্বাসে উপকথায় গল্পে এত এত এত মিল? তাহলে কি আমরা যা ভাবি তা সর্বাংশে সত্য নয়, বহু আগেও দেশে দেশে মানুষে মানুষে অনেক যোগাযোগ ছিলো?

হ্যালোউইনের পরে থ্যাংকসগিভিং এর জন্য প্রস্তুতি চলছে, এও এখানকার আরেক উৎসব। নভেম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার পরিবারের সকলে মিলিত হয়ে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া হয়, খাওয়ার আগে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন। সারাবছর যেন এমনি দুধেভাতে মানে মাংসে রুটিতে রাখেন তিনি, যেন সন্তানসন্ততি সুখে থাকে। প্রধান খাবার টার্কী পাখির মাংস আর ভুট্টা সেদ্ধ। তবে পরিবারে পরিবারে খাবারে বৈচিত্র থাকে অনেক, ডেসার্ট হিসাবে কেউ করেন পেকান পাই,কেউ পামকিন পাই। কেউ টার্কীর সঙ্গে সঙ্গে রাখেন চিকেন, রাখেন ল্যাম্ব। এই সব মিলেই ধন্যবাদজ্ঞাপন অনুষ্ঠান।

থ্যাংকসগিভিং এর আগে আগেই অনেকে দেখা করতে চলে যাচ্ছে বাবামায়ের সঙ্গে, পরে সেসময় আবার যাবে, অনেকে সপ্তাহান্তে গ্রিল বের করে টার্কীর মাংস গ্রিল করতে বসিয়ে দিচ্ছে, আহা ধন্যবাদ যত বেশী হয় ততই তো ভালো।ভালো খাবারের বিকল্প আছে নাকি দুনিয়ায়?

খাবার বলতেই খাদ্যোৎসব মনে পড়ে গেলো। বিভিন্ন দেশের খাবার দাবার নিয়ে ছোটো করে আন্তর্জাতিক উৎসব হয় প্রত্যেক শরৎ চতুর্মাস্যে, আগে এটা হতো বসন্তে। আগে শপিং মল এ কোনো অংশ ভাড়া নিয়ে হতো, এখন ক্যাম্পাসেই হয়।

প্রত্যেক দেশের জন্য ছোটো ছোটো টেবিল,তাতে নিজের দেশের শিল্পকর্মের কিছু নমুনা,পতাকা,ছবি আর খাবার। সকলে সকলে ঘুরে দেখে,প্লাস্টিকের প্লেটে প্লেটে খাবার তুলে তুলে দেন ভলান্টিয়াররা! এত ভালো ভালো সব খাবার!

এত দেশ এই পৃথিবীতে আর প্রত্যেকের খাবারদাবার এত ভালো। মাত্র দুইঘন্টার উৎসবকে মনে হয় খুবই সংক্ষিপ্ত, বেশ হপ্তা জুড়ে খাদ্যোৎসব হলেই যেন ভালো হতো,নইলে এত খাবার চাখা যায় নাকি? কোরিয়ার খাবার খেতে খেতে ভেনিজুয়েলা বাদ পাড়ে যায়, সৌদি আরবের অপরূপ আলুবড়া আর বিরিয়ানি চাখতে গিয়ে ভারতের আলুছোলে আর ক্ষীর খাওয়াই হয় না। ইরাকে যে এত ভালো মিঠাই বানায় তাই বা কে জানতো? ভেনিজুয়েলার পায়েসসদৃশ খাবারটি একটু চেখে আসা হলো এরই মধ্যে,জাপানের সুশি, চীনের ঝালঝাল হুনানচিকেনও।

বহু দেশের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে এখানে, এমনিতে তো সবাই জিন্স টিশার্ট বা ওরকম কোনো গ্লোবাল পোশাকে ক্লাস টাস করে, আজকে অনেকে আপন দেশের রঙীন বস্ত্র পড়েছে, প্রসারিত ঘেরওয়ালা পোশাক, মাথায় পরেছে আপন দেশের শিরোশোভা। অজস্র ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক করে উঠছে অজস্র ছবি, বিরাট পৃথিবীটার কোণার কোণার রূপরসশব্দ একই ঘরের মধ্যে দেখতে পাবার অদ্ভুত অনুভব ধরার চেষ্টা, চলিষ্ণু সময়ধারাকে ফাঁকি দিয়ে ছবিতে ধরে রাখার চেষ্টা।

কী বিপুল এই পৃথিবী, অথচ কী কোমল,কী করুণ। ভালোবাসার ঝর্ণাধারা বয়ে চলেছে, নিজের চারপাশের পাথরের খোলস খুলে ফেলতে পারলেই বুঝি কেবল সেই ঝর্ণায় অবগাহন করা যায়। দুর্লভ মানবজীন ও সে জীবনের দুর্লভ আশীর্বাদ অনুভব করা যায়। "বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা ---"



Monday, June 2, 2014

মায়াময় সবুজ ট্রেন

অ্যামট্র্যাকের রেলওয়ে স্টেশানটি ছোটো, অপেক্ষমান যাত্রীসংখ্যা একদম হাতেগোনা, দুই সাদাচুল প্রৌঢ়া হাতে দুটি ব্যাগ,পরিপাটী গোছানো ঝোলা স্কার্ট আর টপ পরা,জিনস-টিশার্ট পরা নীলচোখ যুবতী পিঠে ব্যাকপ্যাক, একটি ছোট্টো পরিবার-মাবাবা আর দুটি ছেলেমেয়ে,অজস্র লটবহর সঙ্গে, একজন উদাসীন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক-একহাতে ছোট্টো একটি ব্যাগ আর আরেকহাতে একটি বই,আর এই পিঠে ব্যাকপ্যাক আর লাগেজ ব্যাগ হাতে আমি।

ভাবা যায়, দিনের মধ্যে এই একখানা ট্রেন, তার জন্য যাত্রী এখান থেকে মাত্র এই কজন? এদেশে ট্রেনের জনপ্রিয়তা যে একদমই নেই, তা স্টেশানে এলেই টের পাওয়া যায়। সকলেই নিজের নিজের গাড়ীতে চড়ে ঘোরে,তাই ইন্টারস্টেট রাস্তাগুলো অসাধারণ ভালো,মেইন্টেনান্সও তেমনি।সেই পথসমূহই সকলে ব্যবহার করে। খুব বেশী দূর যাবার দরকার হলে লোকে প্লেনে করে যায়।

অ্যামট্র্যাক এখনো কিছু কিছু ট্রেন চালায়, আস্তে আস্তে এগুলোও হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। তবু বাসের কিছুটা বেশী জনপ্রিয়তা আছে, গ্রেহাউন্ড বাস সার্ভিসে অনেক লোক দেশের রাজ্য থেকে রাজ্যান্তরে যায়।

আমাদের ছোটো শহর থেকে ট্রেনযাত্রাটি বেশ মনোরম, সকাল নটায় ট্রেনে উঠে পড়া, আস্তে আস্তে পুবের সবুজ বনভূমি আর ঢেউখেলানো পাহাড়ের ল্যান্ডস্কেপের মধ্য দিয়ে ছোটো ছোটো শহর ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগিয়ে যায় ট্রেন।

পুবের রাজ্যের গন্তব্যশহরে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা নেমে পড়ে, ঘড়ি বদলে ফাস্ট করে নিতে হয় একঘন্টা, এপথে এলে এক টাইম জোন থেকে চলে আসতে হয় আরেক টাইমজোনে। প্রথমবার খুব মজা লেগেছিলো।

দুপুরবেলা পাশের সহযাত্রিণীর সঙ্গে গেলাম সাজানো ডাইনিংকারে,সেখানে খাবারের দাম এমনি জায়গার থেকে বেশী,কিন্তু খাবার ভালো। খেয়ে দেয়ে ফেরৎ এসে সিট এলিয়ে দিয়ে বিশ্রাম। এই ট্রেনের সিট ইনক্লাইনড করা যায়, ফুটরেস্টে পা রেখে আরামে ঘুমানো যায়। জানালার বাইরে বেলা পড়ে আসে, গ্রীষ্মের ঘন সবুজের উপরে পড়ন্ত রোদ্দুরের খেলা কাব্যময় হয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে ছন্দময় দোলানিতে চোখদুটো জড়িয়ে আসে।

ট্রেনের দেশের মানুষ আমি। ট্রেন আমাদের শৈশব কৈশোর প্রথম যৌবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রেশমী সুতোর বুনুনির মতন। শীতের ভোরে ট্রেনের ভোঁ একরকম আর গ্রীষ্মের ভোরে আরেকরকম। মাঝরাত্রির দুরপাল্লার ট্রেনের হুইসেলের দ্রুতচ্ছন্দ চলে যাওয়া আরেকরকম। একটা সময় ছিলো, যখন আমরা কান পেতে থাকতাম,সকালের গাড়ীর শব্দের জন্য। বাড়ী থেকে কত দূরে রেলস্টেশান,তবু শোনা যেতো স্পষ্ট। তখন বাড়ীঘর অনেক অনেক কম ছিলো। সে আমাদের ছোটোবেলা।

ছোটো স্টেশানটি ছিলো আমাদের, দূরপাল্লার ট্রেনগুলো দাঁড়াতো না,এখনো দাঁড়ায় না। তবে এখন বড়ো হয়েছে প্লাটফর্ম, প্রতিদিনের লোকাল ট্রেনযাত্রীর সংখ্যা বেড়ে গেছে অনেক অনেক। সকলের যেতে হয় বড়ো শহরে,ট্রেন ছাড়া অন্য উপায় খুব একটা নেই সাধারণ লোকের কাছে। বাসের ব্যবস্থা ইদানীং আছে বটে, কিন্তু খুব সুবিধাজনক নয়।

শীতের ভোরে ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসা ট্রেনের আলো আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতো,ছোটো স্টেশানের প্লাটফর্মে অসংখ্য মানুষ সোয়েটার মাফলার চাদরে আবৃত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো অপেক্ষায়-এনারা নিত্যযাত্রী।

লোকাল ট্রেনগুলো চলমান সমাজদর্পণ,প্রতি কামরায় নানা পেশার মানুষজন,প্রায় সকলেই চলেছেন কাজে,সকালের ট্রেনগুলোতে বিরাট বিরাট বস্তা,ঝুড়ি,দুধের বড়ো বড়ো ড্রামওলা অনেক লোকজনও থাকতো,এরা নিত্য এইসব দ্রব্যাদি শহরে পৌঁছে দেন। আর অবধারিত অসংখ্য হকার-ঝালমুড়ি,লজেন্স,ছোলাভাজা,বাদামভাজা, গয়না, পোষাক, মলম, থালাবাটি, ফলমূল তেলেভাজা-কি যে নেই সেই হকারদের পসরায়--তা বলা কঠিন। আর গানশোনানোর ছোটো ছোটো দল-এনারা খুব ভোরে থাকতেন না,একটু বেলা হলে উঠতেন।

স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে-হয়তো তাই হয়। হয়তো আস্তে আস্তে ফিরে আসে ছবি,দেশকালের দূরত্বে ধরা পড়ে সুন্দর হয়ে, যেসব ছোটোখাটো সুন্দর এড়িয়ে গেছিলো তা অনেক পরে স্মৃতি হাতড়ে পাওয়া যায়। কে যেন বলেছিলো, চলে যাওয়া বেলাকে ফিরে পেতে হয় শুধু স্মৃতির মধ্যেই, স্বপ্নের মধ্যেই।

"উঠে পড়ো,উঠে পড়ো,এসে গেছি,এসে গেছি। পৌঁছে গেছি। "-সহযাত্রিণী প্রৌঢ়া আস্তে আস্তে আমার কাঁধে হাত দিয়ে ডাকছেন। ঈশ, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নাকি?

চোখ থেকে ঘুম মুছে ফেলে সোজা হয়ে বসি, সিট খাড়া করে দিই। ট্রেনের গতি মন্দীভূত হচ্ছে, গন্তব্য শহরের বড়ো প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে আমাদের ট্রেন।কেমন যেন দূরপাল্লার ট্রেনের হাওড়া স্টেশানে ঢোকার সময়ের মতন একটা অনুভূতি হয়, আস্তে আস্তে ট্রেন থামে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য এগিয়ে আসে স্বয়ংক্রিয় চেয়ার, প্রথমে ওনারা নামেন, তারপরে আমরা আস্তে আস্তে নামি। নীট ইউনিফর্ম পরা গার্ড ট্রেনের পাশে হাসিমুখে হাত নেড়ে বিদায় দেন আমাদের।

সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দেখতে পাই অপেক্ষমান বন্ধুদের হাসিমুখ, আমাকে নিতে এসেছে ওরা। সহযাত্রিনী বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে শুভকামনা করে চলে যান নিজের পথে, আমি আমার শুভেচ্ছা দিয়ে দিই ওঁর সঙ্গে।

তারপরে বন্ধুদের সঙ্গে মিলনমুহূর্তের উষ্ণতা-তা বর্ণনা করতে পারি এমন শব্দ তো নেই আমার ঝুলিতে!অনূক্ত থাক তাই সেসব,ভাষাহীন ভাষা হয়ে পৌঁছাক সুধী পাঠকের হৃদয়ে।

ঐ দূরে,কুউউউ ঝিকঝিকঝিক করে চলেছে স্মৃতি ও স্বপ্নের মায়াময় সবুজ ট্রেন, সময় তাকে ধরতে পারেনি, ক্ষয় করতে পারেনি...কোনো এক ভালোবাসার স্টেশানে পৌঁছানোর জন্য একদিন সবাই ঐ ট্রেনে যাত্রী হয়েছিলাম, যাত্রী হবো আবারও,বারে বারে... সবুজ ধানের খেতের পাশ দিয়ে, কুলকুল বয়ে যাওয়া নদীর পাশ দিয়ে, ফার্নের পাতায় কুচোজল লেগে হীরার মতন জ্বলজ্বল করতে থাকা আলোছায়া বনভূমির মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে ট্রেন...

কুউউউ...ঝিক্‌ঝিক্‌ করে....

জারুল

পথের দু'ধারে আর পার্কিং-লটের চারপাশ ঘিরে অসংখ্য জারুলগাছ। সাদা আর হাল্কা গোলাপী থোকা থোকা ফুলে ভরে উঠেছে। বেশীরভাগই সাদা। জোরালো হাওয়ায় খইয়ের মতন উড়ে যায় শত শত, হাজার হাজার ফুল।

একদিন মেঘ করে আসে,আকাশ ভরে জটামেলা মেঘ আর দূর সমুদ্র থেকে আসা পরাক্রান্ত হাওয়া---সেই হাওয়ায় ওড়ে অসংখ্য জারুল ফুল। মনে পড়ে যায় আমাদের পাড়ার মাঠের ধার ঘেঁষেও অমন জারুলগাছে ফুলের মঞ্জরী, মৌসুমীমেঘের নীচে ওড়াও উড়ছে জোরালো বাতাসে। আহা উড়ুক, উড়ুক ওরা, মৌসুমী হাওয়ায় আনন্দে উড়ুক। এখানে আমি হাঁটতে হাঁটতে থেমে পড়ে নীচু হই, হাত বাড়িয়ে কুড়িয়ে নিই উড়ে পড়া জারুলের হাল্কা পাপড়িগুলো, হাতের তালু থেকে উড়ে যায় ওরা সামান্য শ্বাসবাতাসে। এদিক ওদিক তাকাই,কেউ দেখলো না তো? এইবয়সী মানুষকে এরকম ছেলেমানুষী করতে দেখলে কি ভাববে কেজানে! ভোরবেলায় নির্জন অবশ্য চারিধার,লোকজন আসতে থাকবে আরেকটু বেলা হলে।

পরদিন বাদলশেষের সোনালী রোদ্দুরের সকাল, গাছগুলোর কাছ দিয়ে আসতে গেলেই শোনা যায় গুণ্‌গুণ্‌গুণ্‌-ভোমরার ডানার শব্দ-আরো কাছে গেলে দেখা যায় অসংখ্য চকচকে সোনালী পিঠওলা কালো ভ্রমর খুব ব্যস্ত মধু খেতে, ওদের ডানায় লেগে লেগে ঝরে পড়ে হলদে পরাগ, বাতাসে উড়ে যায় স্বর্ণরেণুর মতন।ওদের কাছ দিয়ে কেউ চলে যাচ্ছে এ হয়তো ওরা লক্ষ্যও করে না,এত ব্যস্ত! অদ্ভুত প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘাই দেয়, গোটা শীতকাল---যখন গাছপালা রিক্তপর্ণ হয়ে ধূসর তপস্বীর মতন পড়ে ছিলো শুকনো কাঠের মত হয়ে,তখন এরা, এই মৌমাছি ভোমরা--এরা কোথায় ছিলো?

ক্যাম্পাস বিস্তৃত হচ্ছে, নতুন নতুন সব বিল্ডিঙ তৈরী হচ্ছে। আহা সেই উজ্জল খয়েরীবুক সূর্যরঙের ফুলেঢাকা টিঁ-ই-ই-ই করে ডাকা পাখিদের মাঠখানা বুঝি আর রইবে না, দেখি বালি সিমেন্ট এইসব জমা করছে, বিরাট বিরাট রোবট আর্মওলা কন্সট্রাকশনের গাড়ী কেবলই মাটিখোঁড়ে, জঞ্জাল সরায় আর কংক্রীটের চৌকো চৌকো স্ল্যাব এনে জড়ো করে।

ঐ মাঠ যখনি পার হই দিনে বা রাতে,সকালে বা সন্ধ্যায় ---যখনি পার হই দেখি ঐ কখানা পাখিকে,গলা বেষ্টন করে দুখানা গোল কালো দাগওয়ালা ধূসর রঙের লম্বা লেজ ছোটো পাখি, অক্লান্ত দৌড়ে বেড়ায় ওরা মাটির উপর দিয়ে, ওড়ে খুব কম। টিঁ-ইঁ-ইঁ-ইঁ তীক্ষ্ণ চড়া স্বর এই পাখির ডাকে।আমার খুব অবাক লাগে,এই পাখি ঘুমায় কখন? ছোট্টোবেলার ছড়া কেন জানি মনে পড়ে এদের দেখে--"হাট্টিমাটিম্‌টিম্‌/ তারা মাঠে পাড়ে ডিম/তাদের খাড়া দুটো শিং/তারা হাট্টিমাটিম্‌টিম্‌।"

কে জানে এরা সেই হাট্টীমা পাখির কোনো দূরসম্পর্কের আত্মীয় কিনা! এই মাঠখানি ঘুচে গিয়ে কংক্রীটের স্ট্রাকচার দাঁড়িয়ে গেলে এরা কোথায় যাবে? টিঁ -ইঁ-ইঁ-ইঁ করে ডাকতে ডাকতে উড়ে চলে যাবে কোনো অভয়প্রান্তরে, যেখানে ওদের মাঠের বাসাখানি কেউ কেড়ে নেয় না?

বিভিন্ন প্রকৃতিবন্ধু ক্লাব, অর্গানাইজেশান এসব আছে এদেশে, তারা চেষ্টা করছে এইসব তৃণভূমি জলাভূমি বনাঞ্চল,বিশুদ্ধ নদীধারা এইসব বাঁচিয়ে রাখতে, মাঝে মাঝে ওরা দিয়ে যায় আবেদনপত্র, পোস্টে ও পাঠায়। কিন্তু কতটুকুই বা ওরাও করতে পারবে এই সর্বগ্রাসী লৌহসভ্যতার সঙ্গে লড়ে?

কত কত বন্য পশুপাখি চিরদিনের মতন লুপ্ত হয়ে গেছে দেশে দেশে-বামীর হাতের প্রদীপ শিখাটির মতন। কেজানে হয়তো কিছুই হারায় না,সবই রয়ে যায় কোথাও না কোথাও-কোনো নির্জন হৃদয়ের গভীর গোপণ কোনো কুঠুরিতে। ডোডো পাখি, সলিটেয়ার পাখি, নিনি হাঁস---সবই হয়তো রয়ে গেছে সেই অভয় দেশের সবুজ বনে,সোনালী বালুচরে,নীল সমুদ্রে।

একটা মকিং বার্ড সুর করে ডাকছে,এই পাখি একদম আমাদের দোয়েলের মতন দেখতে-কেন এত সুর করে ডাকে রিকিউ রিকিউ টীইন্না রিকিউ রিকিউ টিইন্না-দূর থেকে আরেকটা পাখি সাড়া দেয় ঠিক একই সুরে-কেবল মনে পড়ে যায় সব, অজস্র পাখির পৃথিবী ছিলো আমাদের শৈশবে বাল্যে কৈশোরে---মৌটুসী পাখিরা--মাথায় বাহারী ঝুঁটি ওদের, কী ব্যস্ত হয়ে পোকা খুঁজতো ঘাসবনে, মা-ডাহুক কী দ্রুত লিকলিকে সরু ঠ্যাং নিয়ে দৌড়ে যেতো সদ্যবোনা ধানচারাদের মধ্য দিয়ে,কদিন পরে ওর ক্ষুদে ক্ষুদে ছানাগুলো ওর পেছনে,বড়ো বড়ো শামুকখোল পাখি আসতো বর্ষার শস্যক্ষেত্রে, সবুজ টিয়ার ঝাঁক নামতো সবুজ বাগানে...আর সেসব নেই,অজস্র বাড়ীঘরে ইঁটকাঠের জঙ্গলে ঢেকে গেছে প্রায় সবটুকু সবুজ,ওরা কোথায় চলে গেছে!

একদিন কি মানুষ বুঝবে না, এইভাবে একাকী মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না শুধু সভ্যতার অহংকার নিয়ে, সে একা বিচ্ছিন্ন নয়, সে এইসবের-এই সবুজের, এই পাখিদের, এই আকাশের,এই বাতাসের... অজস্র গাড়ী চলে পথে পথে,অসংখ্য কলকারখানা ধোঁয়া উগড়ে দেয়, আরো আরো আরো, গরম হয়ে ওঠে পৃথিবীর বাতাবরণ, গরমে আইস ক্যাপ গলে যেতে থাকে পৃথিবীর মেরুতে, অনেক সাদা ভালুকের শব উঠে আসে ধীবরের জালে, অপুষ্ট ক্লান্ত মৃতদেহ সব...

প্রকৃতিবন্ধু সংগঠন থেকে আসা কার্ডটির উপর থেকে একটি সাদা মেরুভল্লুক আমার দিকে করুণ চোখে চেয়ে থাকে শুধু...আরেকটি কার্ডে মায়ের কোলের ওমে চুপ করে ঘুমিয়ে থাকা একটি সাদা শিশুভল্লুক। ওদের কোনোদিন দেখিনি আমি, কোনোদিন হয়তো দেখবোও না..."তবু আশা জেগে থাকে অয়ি অবন্ধনে/তবু আশা জেগে থাকে প্রাণের ক্রন্দনে..."

হাট্টিমা পাখিরা দৌড়ে বেড়ায় মাঠ জুড়ে, তীক্ষ্ণ চড়াসুরে টিঁ-ই-ই-ই-ই করে ডাকে, এখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে, আমি ঘরে ফিরে আসছি। কোথা থেকে একঝলক হাল্কা ফুলের গন্ধ ভেসে আসে, বেলফুলের গন্ধের মতন মনোরম...

কে যেন বলেছিলো, বাঁচো ও বাঁচতে দাও? কে যেন বলেছিলো প্রাণের চারণভূমিটি কেড়ে নিও না? কে যেন বলেছিলো রক্ষা করতে, যত্ন করতে, ভালোবাসতে? কে সে, কবে বলেছিলো? কিছুই মনে পড়ে না, আমি আনমনে পথ হাঁটি। তীক্ষ্ণ টিঁ-ই-ই-ই আছড়ে পড়ে কানের পর্দায়, মনের পর্দায় যায় কি?