Wednesday, December 11, 2013

দেশবিদেশের উপকথা-চন্দ্রকুমারী (জাপান)

জাপানের এই উপকথাটা খুব আশ্চর্যরকমের সুন্দর। অনেকে বলে থাকেন আধুনিক কল্পবিজ্ঞানের গল্পের আদিরূপ এই উপকথাতেই প্রথম পাওয়া যায়। অনেকে আরো বলেন, উপন্যাস ইত্যাদির বীজও লুকানো ছিলো এই উপকথায়। এই উপকথাটির জন্য এক বন্ধুর কাছে ঋণী এই পুনর্কথক, উনিই মূল আখ্যানভাগের সন্ধান দিয়েছিলেন।

এক দেশে এক গরীব কাঠুরিয়া থাকতো। গ্রামপ্রান্তের ছোটো এক কুটিরে কাঠুরিয়া আর তার স্ত্রী বাস করতো। সকালবেলা দুটি খেয়ে নিয়ে কাঠুরিয়া নিজের কুড়ুলটি আর ঝোলাটি নিয়ে বেরিয়ে যেতো, সারাদিন বনে বনে কাঠ, বাঁশ কাটতো, দিন ফুরালে সব বোঝা বেঁধে পিঠে নিয়ে ঘরে ফিরতো। ঘরে তখন তার বৌ গরম খাবার বানিয়ে অপেক্ষা করতো, সে ফিরলে হাতমুখ ধোয়ার জল দিতো, গামছা এগিয়ে দিতো, তারপরে তারা দুইজনে খেতে বসতো। হাটের দিনে কাঠুরিয়া ঐসব সংগ্রহ করা কাঠ বাঁশ সব নিয়ে হাটে বিক্রি করে যা টাকা পেতো তাই দিয়ে খাদ্য বস্ত্র ইত্যাদি আবশ্যকীয় জিনিস কিনে আনতো।

এইভাবে তাদের দিন কাটছিলো, গরীব হলেও সেই নিয়ে তাদের তেমন দুঃখ ছিলো না, মোটা ভাত মোটা কাপড়েই তারা সন্তুষ্ট ছিলো। কেবল একটিমাত্র দুঃখ তাদের, বহু বছর তাদের বিবাহ হয়েছে, একত্রে সংসার করছে তারা বহু বছর, কিন্তু আজো সন্তানের মুখ দেখতে পেলো না। মাঝে মাঝে কাঠুরিয়ার বৌ স্বামীকে বলতো, "সারাটা দিন তুমি বাইরে থাকো কাজে, আমি টুক টুক করে এটা করি সেটা করি, রান্না করি, সেলাই করি, পাখা বানাই--কিন্তু মাঝে মাঝে দিন যেন আর কাটতে চায় না। একটা সন্তান থাকলে তাকে নিয়ে দিন আমার কেটে যেতো, কত যত্ন করে বড় করতাম তাকে।" বলতে বলতে সে কেঁদে ফেলতো আর কাঠুরে বলতো, "কেঁদো না বৌ, আমাদের ভাগ্যে থাকলে হবে, না হলে নাই। ঈশ্বর দয়া করলে হবে। এ তো জোর করে লাভ নেই, কপালের উপরে তো আমাদের হাত নাই।"

এমনি করে দিনের পর দিন যায়। একদিন কাঠুরিয়া সারাদিন বনে কাঠ কেটেছে, কাজ করতে করতে কখন যে সূর্য ডুবে সন্ধ্যে হয়ে গেছে, তার খেয়াল নেই। চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে, আকাশে তারা ফুটতে শুরু করেছে দেখে সে তাড়াতাড়ি কাঠ বাঁশ বোঝা বেঁধে বাড়ির দিকে চললো। চলতে চলতে বনের প্রায় প্রান্তে এসে গেছে সে, সামনে একটা খোলা মাঠ মাত্র, সেটুকু পেরোলেই তার গ্রাম। বনের মধ্যে হঠাৎ সে দেখলো ঝোপের আড়াল থেকে জ্যোৎস্নার মতন আলো বেরিয়ে আসছে। এখানে আলো? কেমন করে এলো? কৌতূহলী হয়ে কাঠুরিয়া এগিয়ে গেল।

গিয়ে দ্যাখে, একটা মস্ত মোটা বাঁশের মতন কী একটা জিনিস, কিন্তু চকচকে সেটা, যেন বা ধাতুর তৈরী। সেটার থেকে জ্যোৎস্নার মতন আলো আসছে, যেন চাঁদ নেমে পড়ছে বনে। মন্ত্রমুগ্ধের মতন আরো এগিয়ে গেলো কাঠুরিয়া, কাছে গিয়ে শোনে ভিতর থেকে ওয়াঁ ওয়াঁ শব্দ আসছে, যেন বা সদ্যোজাত শিশুর কান্না। এর ভিতরে মানুষ আছে নাকি?

বোঝা নামিয়ে রেখে নিজের কুঠারটি দিয়ে সে আঘাত করে সেই অদ্ভুত আলোময় বাঁশের গায়ে, অমনি একটা টুকরো ভেঙে যায়, সেই গর্ত দিয়ে উঁকি দিয়ে কাঠুরিয়া দ্যাখে ভিতরে বিস্ময়কর কান্ড! ভিতরে একটা নরম তুলো-তুলো বিছানা, সেই বিছানায় শুয়ে আছে একটা খুব ছোট্টো মেয়ে, এত ছোটো যে কাঠুরিয়ার হাতের তালুতে এঁটে যাবে, সেই মেয়েই ওয়াঁ ওয়াঁ করে কাঁদছে। বাচ্চাটির শিয়রের কাছে কতকগুলো সোনার মোহর।

কাঠুরিয়া খুব সাবধানে বাচ্চা মেয়েটিকে বার করে আনে, তারপরে তুলো তুলো বিছানাটাও। সোনার মোহরগুলোও। তুলো-তুলো বিছানা দিয়ে বাচ্চাটিকে সাবধানে জড়িয়ে বুকের মধ্যে নিয়ে কাঠুরিয়া দ্রুত নিজের বাড়ীতে ফিরে আসে। বাড়ীতে এসে নিজের বৌকে সব ঘটনা বুঝিয়ে বলে সে। বৌ তো মেয়েটিকে পেয়ে খুব খুশি, এতদিনে সে তার মনের সাধ পুরিয়ে এই বাচ্চাকে মানুষ করতে পারবে।

তারপরে দিন যায়, দিনে দিনে চন্দ্রকলার মতন বাড়তে থাকে তাদের কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে। কাঠুরিয়া আর তার বৌ মেয়ের নাম রাখে চন্দ্রকুমারী। কাঠুরিয়াদের আর দুঃখ নেই, দারিদ্রও নেই। সেই যে সোনার মোহরগুলো পেয়েছিলো, সেগুলো ভাঙিয়েই তাদের দারিদ্র ঘুচে গেছে।

দিন যায়, মাস যায়, বছর কাটে। চন্দ্রকুমারী এখন কিশোরী হয়ে উঠেছে। সে এত সুন্দরী হয়েছে যে তার দিকে চাইলে মানুষ চোখের পলক ফেলতে ভুলে যায়। উত্তরে দক্ষিণে পুবে পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে চন্দ্রকুমারীর কথা। কিন্তু চন্দ্রকুমারী কেমন যেন আত্মমগ্ন, সে নিজের মনে নিজের লেখাপড়া আর শিল্পকর্ম নিয়ে থাকে। গ্রামে তার কত বন্ধু বন্ধুনী, তাদের সঙ্গে ছোটো থেকে খেলধূলা করে সে বড় হয়েছে, কিন্তু তাও কেন জানি সকলের থেকে সে আলাদা। তার মনের নাগাল কেউ পায় না, বন্ধুরা না, বাবা না মা না। তার বাবা-মা মাঝে মাঝেই অবাক হয়ে তাকে তারাভরা রাতের আকাশের নিচে ঘুরে ঘুরে গান গাইতে দ্যাখে আর কেমন একটা আনন্দবিষাদ তাদের ঘিরে ধরে, ও যে পৃথিবীর মেয়ে নয়, কোথা থেকে একদিন এসেছিলো তাদের ঘরে, আবার বুঝি কবে চলে যাবে!

তারপরে চন্দ্রকুমারীর যখন বিবাহের বয়স হলো তখন চার দিক থেকে চার রাজপুত্র এসে তার পাণিপ্রার্থী হলো। কিন্তু চন্দ্রকুমারীর মন পৃথিবীর মানুষকে বিবাহ করতে সায় দেয় না। এদিকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেও এই রাজকুমারেরা হয়তো ক্ষুব্ধ হবে, তাহলে উপায়? বুদ্ধিমতী মেয়ে সে, একটা খুব চমৎকার উপায় সে ঠিক করলো।

প্রথম রাজপুত্রকে সে বললো, "রাজপুত্র, আমি তোমাকে বিবাহ করতে পারি এক শর্তে।"

রাজপুত্র সাগ্রহে জানতে চায়, "কী শর্ত?"

চন্দ্রকুমারী বলে, " জম্বুদ্বীপে আছে মহাভিক্ষু দশবলের পবিত্র ভিক্ষাপাত্র। সেই ভিক্ষাপাত্র খুব পবিত্র, সর্বদা তা থেকে দিব্যজ্যোতি স্ফুরিত হয়। যদি ঐ ভিক্ষাপাত্র এনে দিতে পারো আমায়, তবেই তোমাকে আমি বিবাহ করবো।"

এই শুনে রাজপুত্র জম্বুদ্বীপের দিকে রওনা দেয়।

দ্বিতীয় রাজপুত্রকে সে বললো, "রাজপুত্র, আমি তোমাকে বিবাহ করতে পারি এক শর্তে।"

রাজপুত্র সাগ্রহে জানতে চায়, "কী শর্ত?"

চন্দ্রকুমারী বলে, " প্লক্ষদ্বীপে আছে এক আগুনমুখো ড্রাগন, সেই ড্রাগনের গলায় আছে এক রত্নহার, সেই রত্নহারের কেন্দ্রমণিটি, তার জোড়া নেই ভুবনে। যদি সেই মণিটি আমাকে এনে দিতে পারো, তবেই তোমায় আমি বিবাহ করবো।"

এই শুনে রাজপুত্র প্লক্ষদ্বীপের দিকে রওনা দিলো।

তৃতীয় রাজপুত্রকে সে বললো, "রাজপুত্র, আমি তোমাকে বিবাহ করতে পারি এক শর্তে।"

রাজপুত্র সাগ্রহে জানতে চায়, "কী শর্ত?"

চন্দ্রকুমারী বলে, " শাল্মলীদ্বীপে আছে এক আশ্চর্য বৃক্ষ, যার প্রতিটি শাখা রত্নময়। যদি সেই গাছের একটি শাখা আমায় এনে দিতে পারো, তবেই তোমায় আমি বিবাহ করবো।"

এই শুনে রাজপুত্র শাল্মলীদ্বীপের দিকে রওনা দিলো।

চতুর্থে রাজপুত্রকে সে বললো, "রাজপুত্র, আমি তোমাকে বিবাহ করতে পারি এক শর্তে।"

রাজপুত্র সাগ্রহে জানতে চায়, "কী শর্ত?"

চন্দ্রকুমারী বলে, " ভদ্রাশ্ববর্ষে আছে এক অদ্ভুত অগ্নি-মুষিক। সেই অগ্নিমূষিকের আছে এক আলো-ঝলমল দিব্যবস্ত্র। সেটা আমায় এনে দিতে পারলে তবেই আমি তোমায় বিবাহ করবো।"

এই শুনে রাজপুত্র ভদ্রাশ্ববর্ষের দিকে রওনা দিলো।

প্রথম রাজপুত্র জম্বুদ্বীপের দিকে রওনা দিয়েছিলো বটে কিন্তু যেতে যেতে মনে করলো মহাভিক্ষু দশবলের ভিক্ষাপাত্র পাওয়া কি সোজা কথা? তারচেয়ে এখানকার কোনো ভিক্ষু উপাশ্রয় থেকে দামী একটা ভিক্ষাপাত্র কিনে নিয়ে যাই। তো সে তাই করলো, একটি দামী ভিক্ষাপাত্র এনে চন্দ্রকুমারীকে দিল। কিন্তু সেটা যে জাল, তা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় নি চন্দ্রকুমারীর, ভিক্ষাপাত্র থেকে কোনো দিব্যজ্যোতি বেরোচ্ছিলো না।

দ্বিতীয় রাজপুত্র রওনা হয়েছিলো প্লক্ষদ্বীপের দিকে কিন্তু যেতে যেতে মনে করলো ওরে বাবা, ড্রাগনের গলার হারের মণি, সে কি সোজা কথা? আর প্লক্ষদ্বীপ এমনিতেও অনেক দূরে, সাগর পাড়ি দিয়ে যেতে হয়। সে এক নাবিককে অনেক টাকা দিয়ে প্লক্ষদ্বীপে যেতে রাজী করলো, কথা হলো সেখান থেকে নাবিক তাকে ড্রাগনের গলার হারের কেন্দ্রমণিটা এনে দেবে।

নাবিক টাকাকড়ি সব নিয়ে নিজের লোকজন নিয়ে সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়ে পড়লো প্লক্ষদ্বীপের দিকে। তারা তো আর আসে না আর আসে না, ঝড়ে পড়ে ডুবে গেলো নাকি? কিংবা ড্রাগন ওদের সবাইকে খেয়ে ফেললো?

এইসব ভেবে দ্বিতীয় রাজপুত্র তাদের আশা ছেড়ে দিয়ে নিজের রত্মভান্ডার থেকে খুব দামী একটা মণি নিয়ে রওন হলো চন্দ্রকুমারীর কাছে। সেটা যে জাল, তা ধরে ফেলতে চন্দ্রকুমারীর সামান্য সময় লাগলো। ধরা পড়ে মুখ চুন করে ফিরে গেলো রাজপুত্র।

তৃতীয়জনও জাল জিনিস এনে দেখিয়েছিলো ও ধরা পড়ে গেছিলো। চতুর্থজন ফিরে আসে নি আর, হয়তো বা কাজটি না করতে পারার লজ্জায়।

এর কিছুকাল পরে দেশের মহারাজ স্বয়ং মৃগয়ায় এলেন চন্দ্রকুমারীদের গ্রামের কাছে। সেই সময়ে মহারাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো এই বিশ্ববিমোহিনী সুন্দরী চন্দ্রকুমারীর। মহারাজ তো তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বন্ধুত্ব করলেন। তারপরে যখন তাদের বন্ধুত্ব খুবই দৃঢ় হয়েছে, তখন মহারাজ চন্দ্রকুমারীকে বিবাহ করতে চাইলেন।

তখন ছিলো সন্ধ্যেবেলা। মহারাজ আর চন্দ্রকুমারী প্রান্তরে বেড়াচ্ছিলো পঞ্চমীর চাঁদের আলোয়। নানা কথা বলছিলো, হাসছিলো তারা দুইজনে। যেন তারা একজন দেশের মহারাজ আর একজন গ্রামের এক সামান্য মেয়ে নয়, যেন তারা দুই সমপর্যায়ের বন্ধু। তারপরেই একসময় এলো মহারাজের বিবাহপ্রস্তাব।

শুনে চন্দ্রকুমারী হঠাৎ বিষন্ন হয়ে গেল, বললো, " মহারাজ, পৃথিবীর কোনো মানুষকেই যে বিবাহ করা আমার পক্ষে সম্ভব না! আমি পৃথিবীর কেউ নই। ঐ যে চাঁদ, ঐখানে আমার আসল ঘর। শীঘ্রই আমার নিজের লোকেরা আমাকে ফিরিয়ে নিতে আসবে। সব ছেড়ে আমার চলে যেতে হবে, হয়তো আর কোনোদিন এখানের কারুর সঙ্গে দেখা হবে না। " জ্যোৎস্নায় মহারাজ দেখলেন চন্দ্রকুমারীর দুই চোখে টলটল করছে অশ্রু।

রাজা দুই হাত দিয়ে চন্দ্রকুমারীর দুইহাত জড়িয়ে ধরে বললেন, "কে তোমাকে নিয়ে যাবে? কেউ নিতে পারবে না। আমি আমার সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করবো তোমাদের বাড়ির চারপাশে। দেখি কে তোমাকে কীভাবে নিয়ে যায়।" শুনে চন্দ্রকুমারী কেবল ম্লান হাসলো।

মহারাজ সত্যিই বিরাট সেনাবাহিনী এনে মোতায়েন করলেন কাঠুরিয়ার বাড়ির চারপাশে। আর ভয় নেই, কেউ চন্দ্রকুমারীকে কেড়ে নিতে পারবে না।

পূর্ণিমার রাতে আশ্চর্য দিব্যবিমানে চড়ে চন্দ্রকুমারীর দেশের লোকেরা এসে নামলো কাঠুরিয়ার বাড়ির সামনে। পাহারাদার সৈন্যরা সকলে আলোর ঝলকানিতে সাময়িকভাবে অন্ধ হয়ে গেল, অবশ হয়ে গেল। কোনোরকম লড়াই তো দূরের কথা, কোনো বাধা দেবারও সামর্থ্য তাদের রইলো না, তাদের নড়াচড়ার ক্ষমতাই সাময়িকভাবে হরণ করে নেওয়া হয়েছিলো।

চন্দ্রকুমারীর আপন লোকেরা তার ঘরে গেলো, সেখানে তাদের অপেক্ষাতেই ছিলো তাদের মেয়ে। কিন্তু মেয়ের চোখে তখন অশ্রু, পৃথিবীর এই মানুষগুলো তার বড় আপন, তার এই পালক পিতামাতা যারা নিজের সন্তানের মতন তাকে পালন করে শৈশব থেকে এত বড়টি করেছেন, এই গ্রামভর্তি তার বন্ধুরা যাদের সাথে খেলেধূলে সে বড় হয়েছে, এই মহারাজ যিনি তাকে অকপট বন্ধুত্ব দিয়েছেন---এই সবাইকে ছেড়ে যেতে তার মন চায় না, তার বুকের মধ্যে অশ্রুসমুদ্র উথলে ওঠে। কিন্তু যেতে তো হবেই, উপায় তো নেই।

চন্দ্রকুমারী চিঠি লিখে সব জানিয়ে মহারাজের জন্য রাখে সেই চিঠি। চিঠির সাথে রাখে একটি উপহার। তারপরে সে তার বাবামায়ের কাছে বিদায় নিতে যায়। কাঁদতে কাঁদতে সে জানায় আজ সে চলে যাচ্ছে বটে, কিন্তু একদিন সে আবার ফিরে আসবে।

এদিকে সময় গড়িয়ে চলেছিলো, চাঁদের দেশের লোকেরা তাড়াতাড়ি এসে তাদের মেয়েকে একটি পালকের পোশাক পরিয়ে দিলো। যেই না সেটা পরানো অমনি চন্দ্রকুমারীর মন থেকে পার্থিব মায়া আর পিছুটান লুপ্ত হয়ে গেল। যারা তাকে নিতে এসেছিলো, তাদের সাথে চন্দ্রকুমারী গিয়ে দিব্যবিমানে চড়ে বসলো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দিব্যবিমান শূন্যে মিলিয়ে গেল।

কাঠুরিয়া আর তার স্ত্রী পালিতা কন্যার শোকে অভিভূত হয়ে পড়লো। সাঁঝের বেলা উঠান থেকে চাঁদের দিকে চেয়ে তারা কেবল চন্দ্রকুমারীর কথাই ভাবতো। বয়সও হয়েছিলো তাদের, একসময় তারা অসুখ হয়ে মারা গেল দুইজনেই।

প্রতি রাতে মহারাজ চন্দ্রকুমারীর চিঠিটি আর উপহারটি হাতে নিয়ে আকাশভরা তারার নিচে ঘুরে ঘুরে ভাবতেন সে কি আবার আসবে, কখনো আসবে? নাকি "এ পৃথিবী একবারই পায় তারে, পায় নাকো আর !"

(সমাপ্ত)

অপরাজিতা

আমার সঙ্গে যদিও বহুকাল অনীশের দেখা নেই,তবু বসে বসে খাতায় লেখালিখি মকশো করে যাই। অনীশ শুনেছি বেড়াতে গিয়েছেন পাহাড়ে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন তিন ভাগ্নেভাগ্নী গ্যাঞ্জামা, নিশঙ্কা আর ঝঞ্ঝাকে। যাবার আগে আমায় কিছু ডেডলাইন দিয়ে গিয়েছেন , যাতে এসেই পাকড়াও করতে পারেন। অনীশ হলেন পাক্ষিক সাহিত্যপত্রিকা "আনন্দঝর্ণা"র সম্পাদক।

আমি জানালার ধারে বসে কবিতা লেখার চেষ্টা চালাই,"আকাশে চিল,বেঁফাসে নীল,বাতাসে ঢিল,বাড়ীতে খিল।"এই ধরনের ছোটো ছোটো ছন্দে প্রথমে হাত পাকাচ্ছি। ওদিকে আপনমনে জগাদা গান গাইতে গাইতে পথ দিয়ে চলে চলে গেলো,"সীমের মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর",ওর নজর ছিলো পাশের দত্তদের সব্জিবাগানের দিকে।নধর নধর সীম ফলে আছে মাচায়।

আমি উদাস হয়ে গেলাম, দুত্তোর বলে থলে হাতে বাজার করতে বেরিয়ে পড়লাম। উরেব্বাবা,সে কি গরম বাজারে! সব্জিওয়ালা, মাছওয়ালা, ফলওয়ালা তারস্বরে সেই গরমের মধ্যে চেঁচাচ্ছে,"তিরিশ তিরিশ তিরিশ, চল্লিশ চল্লিশ চল্লিশ।" ই কী রে বাবা?

বেগুনওয়ালার কাছে এসে কোনোমতে মিনমিন করে কইলাম,"এই বেগুন কত করে?" সে বীরবিক্রমে চিৎকার করে বললে,"এ চল্লিশ টাকা কিলো।"

চল্লিশ টাকা? বলে কী রে ব্যাটা? প্রায় ভির্মি খেয়ে যাচ্ছিলাম।

কোনোমতে সামলে বললাম,"এত দাম? এই তো গত হপ্তায় ছিলো পনেরো টাকা কিলো?"

একটুও না ঘাবড়ে সে বললে,"গত হপ্তায় আর এ হপ্তায়? কিসের সঙ্গে কিসে,চাঁদের সঙ্গে ইসে!এখন লগনসার বাজার। দাম কি আগের মতন থাকবে?"

এ তো ব্যাপার গুরুচরণ! বাজারেও কবিতা? বেগুনওয়ালাও কবিতা বলে,তাও আবার অন্তমিল দিয়ে?

আমি কান্নিক খেয়ে বাঁদিক ঘেঁষে বেরিয়ে গেলাম। কিন্তু সামনে পুজো,অষ্টমীতে খিচুড়ী-লাবড়া না হলে তো ....এদিকে বেগুন ছাড়া লাবড়া তো মধু ছাড়া মৌচাকের মতন....

দুত্তোর,যতো ভাবি কবিতা নয় কবিতা নয়,ততই এসে যায় কবিতা? তারচেয়ে "শ্রী শ্রী চন্ডী" ভাবি,তাতে কিছু উপকার হতে পারে। ভাবতেই ভাবতেই মনে হলো এক চ্যাংড়া প্যারোডি করেছিলো মেধস মুনি আর রাজ্যভ্রষ্ট রাজা সুরথের কথোপকথন আধুনিক কালের পটভূমিতে কেমন দাঁড়াবে,"হে মহাভাগ বলো বলো,আমরা কেন এমন দুখী?/বাজারে দাম দেখি তবু মন সদা রয় বাজারমুখী!/এমন কেন হয় বুঝেও বুঝতে নারি মহামতি/চিত্তে কেন লোভ জেগে রয় বিগুণ বেগুনগণের প্রতি?" সত্যিই বেগুনেরা বড়োই বিগুন আজও আমার প্রতি। চল্লিশ টাকা কিলো হয়ে গেলো তেরাত্তির পেরুতে না পেরুতে? কলির চারপোয়া পুরে গেলো নাকিরে বাবা?

যাক,পাকড়াশীদের বাগান থেকে রাতে মেরে দোবো,এই ভেবে নিয়ে বাড়ীর পথে চললাম চাট্টি কাচকি মাছ আর দু'ছড়া কলা কিনে নিয়ে।

বাড়ীতে আসতেই পাশের থেকে রুপী এসে ঘাড়ে ঝাঁপ দিলো। উদ্দেশ্য কলা ক'টা হাতানো।

রুপী হলো ঘেন্টুমেসোর পোষা রুপী বাঁদর। কেল্টিমাসী,মানে ঘেন্টুমেসোর একমাত্র বৌ স্বর্গে যাবার পরে পরে ঘেন্টুমেসো কেমন যেন পাগলা পাগলাহয়ে গেছিলেন, দাঁড়িটাড়ি না কামিয়ে চুলটুল না সামলে হুতাশী হুতাশনের মতন ঘুরতেন। কী খেতেন কোথা ঘুমোতেন কোনো খেয়াল থাকতো না। অনেকে কইলো আলঝাইমার,অনেকে কইলো চিত্তভ্রংশ,কিন্তু কেউ কোনো সমাধান দিতে পারলো না। মেসো ঘুরে ঘুরে ছড়া বলেন,"কেল্টি মাসী পল্টী মাসী বুল্টী মাসী কইতো/তাদের দেশের চিনাং নদী দুকুল ছেপে বইতো।"বোঝো কান্ড!এর মধ্যে এত মাসী কোথা থেকে এলো আর চীনই বা কোত্থেকে উপস্থিত?আর বৌকে শেষে বোনপো-বোনঝিদের দেখাদেখি মাসী বলে ফেলা!কী ডেন্জারাস কেস রে বাবা!শেষে পাড়ার ষন্ডাগুন্ডা গুপীদা একদিন ওঁকে নিয়ে গেলো ঘুটঘুটানন্দজীর কাছে। তিনিই সব শুনে টুনে বিধান দিলেন রুপী পোষার।আর যায় কোথা? ম্যাজিকের মতন কাজ!ঘেন্টুমেসো ভালো হয়ে এখন ভালো কোম্পানিতে করে খাচ্ছেন,বর্তমান পোস্ট রাঁচী হাজারিবাগের মাঝামাঝি।

যাবার আগে আগে উনি রুপীকে ছেড়ে দিয়েছিলেন।ছাড়া পেয়ে রুপীর সে কি ফূর্তি!পাড়ার গাছে গাছে ফলপাকুড় খেয়ে বেড়াতো,বাজারেও ছিলো অবাধ গতি,পাড়ার ষাঁড়েদের সঙ্গেও দিব্যি ভাব হয়ে গেছিলো। একেবারে চলে যাবার আগে রুপীকে একবার দেখার জন্য ঘেন্টুমেসো ভারী কেঁদেছিলেন, কিন্তু তখন রুপী কোথা? বোসেদের কলাবাগানে খুঁজলে পাওয়া হয়তো যেতো,কিন্তু লোকের অত কি দায় পড়েছে গাল বাড়িয়ে চড় খাওয়ার?

যাইহোক ঘেন্টুমেসো চলে গেলেন কিন্তু রুপী রয়ে গেলো আর যথারীতি দৌরাত্ম করে বড়াতে লাগলো। কারুর কিচ্ছু করার নেই। ঘেন্টুমেসোকে নাহয় ঘুটঘুটানন্দজী দিয়ে সামলানো যায়,কিন্তু রুপীকে সামলাবে কে, কেমন করেই বা? পারলে একমাত্র গুপীদাই পারতো,কিন্তু সেও রণে ভঙ্গ দিয়ে চাকরি নিয়ে আবুধাবি চলে গেলো। এই তো অবস্থা! এইসব বীরের মুখের দিকেই নাকি আমরা চেয়ে ছিলাম?

দু'ছড়া কলা গেল! কোনোক্রমে কেচকী মাছকটা বাঁচিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লাম। যদিও বাঁদরে আমিষ খায় না,কিন্তু বিশ্বাস কী?

রান্নাঘরে যেতেই দেখি জানালা দিয়ে পাশের বাড়ীর মোটা হুলো বেড়ালটা পালাচ্ছে,যেতে যেতে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে বিশ্রী একটা হাসিও দিয়ে গেলো। কড়ায় দুধ ছিলো,তাহলে সেটাও এখন আর নেই ধরে নিতে পারি। হুলো কি আর ছেড়ে দিয়ে গেছে?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে থলে নামালুম,নাঃ,এইবারে হিমালয়ের দিকে যাওয়া ছাড়া তো আর উপায় দেখিনা। সম্পাদক চালাক মানুষ,তাই কাজ এগিয়ে রাখতে পাহাড়ে ঘুরতে গেছেন। আমারও শিগগীরই যেতে হবে,মানে সম্পাদক আসার খবর পেলেই। অবিশ্যি সেখানে আবার কি গেরো বেঁধে আছে তাই বা জানে কে?

শিকে থেকে ডুলা নামিয়ে দেখি পড়ে আছে ক'টা অনার্য ঝিঙা আর দু'খানা অনার্য চিচিঙা। মুহ্যমান মুখ করে সেই কুটতে বসলুম। তাহলে আজ কেচকী মাছের ঝিঙে চচ্চড়ি আর চিচিঙা ভাজাই হবেখন ভাতের সঙ্গে। তাতে আমার অবিশ্যি কোনো অসুবিধে নেই,কিন্তু পাকেচক্রে কোনো অতিথি এসে গেলেই চিত্তির। ভদ্দরলোকেদের কিকরে এই অনার্য খাবার খাওয়াবো?

যাইহোক রান্নাবান্না সেরে সবকিছু শিকেয় তুলে পাশের ঘরে গেলুম মকশো খাতায় গদ্য লেখা অভ্যেস শুরু করতে।

খানিকটা বেশ র লেখা লিখতে হবে,যাকে বলে বাস্তব। পান্তাভেজা বোষ্টুমগোছের লেখা চলবে না।বেশ ঝাঁঝ ঝাঁঝ ঝাল ঝাল চচ্চড়ির মতন লেখা চাই।তো গোটা দেড়েক পাতা এগিয়েছে,অমনি দরোজায় ঠকঠক।কোন দুশমন এলো রে বাবা এই ভরদুপুরে?

দরোজা খুলে তো আমি অবাক!পাকড়াশীদের ছেলে দুষ্মন্ত।এর সঙ্গে ছোটোবেলা বন্ধুত্ব ছিলো আমার,পরে বড়ো হয়ে এ তো চলে গেলো ব্যাঙ্গালোরে ইঞ্জিনিয়ারিঙ পড়তে,পরে সেখান থেকে চলে গেলো বিলেত। কবে ফিরলো রে বাবা?

"আসুন আসুন,কেমন আছেন?" বলে তো ঘরে আসতে বললাম।

সে একগাল হেসে কইলো,"আমাকে আবার আপনি আজ্ঞে কেন মিন্টি?আগে তো তুমি বলতে।"

আমার একটা মজার কথা মনে পড়লো, ওকে তুমি বলতাম আর ডাকতাম দুশমন।

কিন্তু এখন? তাড়াতাড়ি বললাম,"সে আগে। এখন আপনি কত বড়ো মানুষ,কত দেশবিদেশ ঘুরেছেন,কত জানকারি। আর কি তুমি বলতে পারি?"

"না না মিন্টি,তুমি বলো।আমি এই কদিনের জন্য দেশে ফিরেছি,দুহপ্তা পরে আবার বিলেত যাবো।তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলাম। কেমন আছো?"

"ভালো। দুপুরে এলেন,খেয়ে যান। দাঁড়ান আগে সরবৎ করে আনি।"

হাত ধরে আটকে বললো,"আবার আপনি? তাইলে কিন্তু খাবো না,এক্ষুণি চলে যাবো।"

তাইলে তো বাঁচি,নইলে ঐ ঝিঙা চিচিঙা কিকরে খাওয়াবো এই বড়োলোকের ছেলেকে?

"ঠিক আছে রে বাবা,তুমিই বলবো। এখন সরবৎ আনি।" চটপট করে লেবুর সরবৎ বানিয়ে এনে দিলাম,সরবত খেতে খেতে সে বললো,"খুব ভালো সরবৎ। খেয়ে যেতে বললে, কী খাওয়াবে?"

আমার এইবারে একটু মনখারাপ হলো,সত্যি তো সেরকম ভালো কিছু তো নেই।

আমি বললাম,"তুমি খেতে চাইবে না দুশমন,ঝিঙে চচ্চড়ি আর চিচিঙে ভাজা কি তুমি খাবে? ভুল করে বলে ফেলেছি,সরবৎ খেয়েই বিদায় হও বরং।"

সে উৎফুল্ল মুখে বললো,"উল্স,কতদিন ওসব খাইনি।ঐসব পিত্জা বার্গার খেতে খেতে জিভে চড়া পড়ে গেলো,সঙ্গে আছে আবার আধাসেদ্ধ মাংস গুঁজে তৈরী স্যান্ডউইচ,হিন্দিতে বালুটা ডাকিনি যে কেন বলে কামড় দিলেই মালুম হয়।কখন দেবে চচ্চড়ি?"

দুশমনকে খাইয়ে দাইয়ে বিদায় দিলাম। মৌরী চিবিয়ে খুব হেসে চলে গেলো সে। আমি এরপরে দুই গেলাস জল আর চারদানা মৌরী খেয়ে লিখতে বসলুম আবার। ঝাড়া পনেরোপাতা লিখে উঠে দেখি অন্ধকার হয়ে গেছে, আলো জ্বেলে সন্ধে দেখিয়ে আবার এসে লিখতে বসলাম,কিন্তু এইবারে একটু মাথাটা ঘুরাচ্ছিলো। সম্পাদক তো শুনবে না,খালি আমায় তাড়াতাড়ি করতে বলে,দেরি হলে বকে। দুত্তোর লিখবো না,পয়সা দেয় না,কিছু না,সামনে পুজো,আমার কাপড় কখানা এত পুরানো.....

বাংলা ইস্কুলে পড়তাম,ইংরেজী শিখতে পারিনি,তাই অন্য কোথাও কিছু কাজও তো পাইনা। বাবামাও তো তাড়িয়ে দিলো,ভাগ্যিস এই কুটিরখানায় কম ভাড়ায় থাকতে দিয়েছে অনীশ! তাঁর তো টাকাকড়ির অভাব নেই, পূর্বপুরুষের জমিদারি ছিল,এটুকু করলে কিছু কম পড়ে না। কিন্তু তাই বা করে ক'জন?

দুশমনও তো বাংলা ইস্কুলে পড়তো,কিন্তু ওর তো বাড়ীতে জমিদারি,বিলেতফেরৎ বাবামা। ওর সঙ্গে কিসের তুলনা? তাছাড়া ও পড়াশোনাতেও খুব তুখোর ছিলো।তাই তো চটপট মেমসাহেব রেখে ইংরেজি বলা দুরস্ত করে নিয়ে বিলেতে চলে গেলো। যাক গে যাক,আজকে রাতে ওদের বাগান থেকেই তো বেগুন ঝাড়তে হবে।

রাত বাড়লে শাড়ীটার আঁচল কোমরে জড়িয়ে রেডি হলাম। পাঁচিলের এক জায়্গা একটু ভাঙা,ওটাই সুবিধের জায়গা। পরিকল্পনা মতন চারটে বেগুন,কিছু পালং,কটা সীম,বরবটি তুলে চলে আসছি,কোথা থেকে একজন এসে হাতটা মুচড়ে ধরে আটকালো। গালাগাল করছিলো,পুলিশে দেবে বলছিলো। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিলো না, গলা শুনে বুঝেছিলাম দুষ্মন্ত। ঝটাপটি করতে গিয়ে আঁচল থেকে সব বেগুন,পালং পড়ে গেলো মাটিতে।

আহ,হাতটা এত জোরে ধরেছে! ছাড়াতে পারছি না কিছুতেই। শব্দ করিনি,পাছে চিনে ফেলে।মনখারাপ লাগছিলো। একসঙ্গে পড়তাম, এখন এ রাজা,আমি ওর বাগানে সব্জি চুরি করতে এসেছি সারাদিন না খেয়ে থেকে।

এইবারে টানাটানিতে আঁচলটা ফরফর করে খানিকটা ছিঁড়ে গেলো,এত পুরানো জীর্ণ কাপড়! হাতটায় মোচড় দিয়ে দুশমন বললে,"ছাড়বো না,মেরে তক্তা করবো,হুকে ঝুলিয়ে রাখবো,বাঁশপেটা করবো।"

হাতটায় বড্ড লাগছিলো,কাতরে উঠলাম,"আহ আহ,আর কোনোদিন করবো না,ছেড়ে দাও আজ।বড্ড লাগছে,দয়া করো।"

সে ছেড়ে দিলো,খুব অবাক হয়ে বললো,"মিন্টি? তুমি?"

আমি ওর পায়ের কাছে বসে পড়লাম,খুব কান্না পাচ্ছিলো,মাথাটা ঘুরাচ্ছিলো। আস্তে আস্তে বললাম,"মারতে চাও মারো,পুলিশে দিও না দয়া করে। সারাদিন কিছু খাইনি,মাথা ঘুরাচ্ছে।"ওর পা জড়িয়ে ধরলাম।

সে ম্রিয়মান গলায় বললো,"নিজের খাবার তখন আমায় দিলে তুমি?কেন বললে না তোমার কিছু নেই?"

ধরে তুললো আমায়। হাতটা ব্যথায় টনটন করছিলো।ও ডলে দিলো একটু।

তারপরে ধরে ধরে ওর ঘরে নিয়ে গেলো। মুখের কষ বেয়ে রক্ত পড়ছিলো আমার, এমনিই পড়ে মাড়ি থেকে,ও মারেনি ওখানে।ও গেলাসে জল দিলো,মুখ ধুয়ে নিলাম।

ও ভয় পাচ্ছিলো,"মুখ থেকে রক্ত পড়ছে তোমার,ভিতরে কোথাও লাগে নি তো?"

আমি হেসে বললাম,"ও এমনি পড়ে,রোজই পড়ে। হয়তো স্কার্ভি কিংবা ভিটামিন সি এর অভাব। আহ,হাতটা .....বড্ড ব্যথা। এমন করে মুচড়ে দিলে!অবিশ্যি কে আর চোরকে না মেরে ছেড়ে দেয়?"

ও ম্লান মুখে বললো,"অমন বোলো না। আমি জানতাম না তোমার এরকম অবস্থা। কাপড়টা ছিঁড়ে দিলাম। মায়ের একটা কাপড় নেবে? রাতে খেয়ে যাও,হ্যাঁ,মিন্টি?"

আমার কান দুটো গরম হলো,বললাম "না না,ছেড়ে দিলে চলে যাই,কিছু দিতে হবে না,ছেঁড়াটুকু সেলাই করে নেবোখন।"

"এই,আমি যে খেলাম তোমার ওখানে দুপুরে? তবে? আমার এই পাশের ঘরে ফ্রীজেই আছে খাবার,মাইক্রো-ওয়েভে গরম করে এনে দোবো।একটুও দেরি হবে না।আর মায়ের কাপড় আছে ও পাশের ঘরের আলমারিতে, এটা পুরোটাই স্পেয়ার কাপড়,মা পরেও না।"

খেতে দিলো,ভালো ভালো সব খাবার। সারাদিন খাইনি,খুব খিদে পেয়েছিলো,কিন্তু লজ্জা লাগছিলো খেতে। ও বুঝতে পারছিলো,আমায় কইলো,"তোমার এত লজ্জা করতে হবে না। খাও না ভালো করে। এমনিই এসে সব্জি নিয়ে যেও তো সকালে,আমি তুলে দেবো।"

"দুশমন,আমায় কোনো চাকরি দিতে পারো? এই যে লেখার কাজ করি,সম্পাদক সস্তায় থাকতে দিয়েছে আর মাঝে মাঝে কিছু পয়সা দেয়,ইচ্ছে হলে দেয়,নইলে দেয় না। আমার ....আমার দিন চলে না,উপোস করতে হয়। বাবামা তাড়িয়ে দিয়েছে চোর আর অন্নধ্বংসকারি বলে। ইংরেজী বলতে পারিনা বলে কাজ পাইনা,তোমার তো অনেক সোর্স, কিছু জুটিয়ে দিতে পারো?কোনো কাজ? খুব কষ্ট হলেও করতাম। এইভাবে আর চলে না,সম্পাদক এসে লেখা না পেলেও তো বাড়ী থেকে বার করে দেবে,তখন বা কোথায় যাবো?" চোখে জল আসছিলো,দুশমনকে লুকিয়ে মুছে ফেললাম।কতদিন বাবামাকে দেখিনি। ওদের সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে না।

দুষ্মন্ত আমার হাতটা আলতো ধরে বললো,"চাকরি? চাকরি অনেক আছে। ইংরেজী বলা শিখে নে না, এমনি ইংরেজী তো জানিস, বলা প্র্যাকটিস করলেই হয়ে যাবে। ভর্তি হয়ে যা কোথাও,কালই। আমিই নিয়ে যাবো,কালকে সকালে। আর একবার ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যাবো,তোর মাড়ি থেকে রক্ত পড়ে,কিছু চিকিৎসা করাস না কিছু না,এমনি বসে আছিস।পরে কিছু একটা হয়ে গেলে?"

মরলে তো বাঁচি,কিন্তু সে তো আর এই ভালো ছেলেটার কাছে বলা যায় না।

ও আমায় দিয়ে কড়ার করিয়ে নিলো যে কালকে সকালে আমায় নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে প্রথমে,তারপরে যাবে ইংরেজী বলা শেখানোর ক্লাসে ভর্তি করতে। আমি কোনোমতে রাজী হয়ে মথা নীচু করে বাড়ী ফিরার রাস্তা ধরলাম। কিন্তু কিসে যেন একটা লাগলো পায়ে,হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম।তারপরে আর কিছু মনে নেই।

যখন চোখ মেললাম দেখি চোখে মুখে জল দিয়েছে দুশমন,পাশে বসে কাগজ দিয়ে হাওয়া করতে করতে কাঁদছে। আমায় চোখে মেলতে দেখে ও ভারী অপ্রস্তুত হয়ে গেলো আর আমিও খুব অপ্রস্তুত হয়ে উঠে বসলাম। "আরে দুশমন,কাঁদছো কেন?আমার কিছুই হয় নি,এই তো এখনি হেঁটে হেঁটে বাড়ী চলে যাবো।"

দুশমন চোখটোখ মুছে বললো,"মণিকাকীমা খুব দুঃখ করলো আমার কাছে,তুই এইভাবে বাড়ী ছেড়ে চলে এসেছিস দেখে। বলে,আমরা কিছুই কইনি বাবা ওকে,ও নিজেই অভিমানে বাড়ী ছেড়ে চলে গেলো। কেন রে এইরকম করে চলে এসেছিস?"

একি রে বাবা? এ আবার আমায় মাবাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে!কেন? কী উদ্দেশ্যে?

বললাম,"চলে যাবো না তো কী? কতকাল আর ওদের অন্নধ্বংস করবো? এত বুড়ী দামড়ী হয়েও ওদের খাবো,ওদের পরবো? কিন্তু তুমি আমার মাবাবার সঙ্গে দেখা করতে যাও নাকি? ওদের আবার বলে দাও নি তো আমি কোথায় থাকি?"

ও হাসলো,"না তা বলিনি।কিন্তু তুই এভাবে....উপোস করে,ছেঁড়া কাপড়ে...ওদের ভুল বুঝেছিস তুই। ওরা চান না তুই এত কষ্ট পাস। আমায় জিজ্ঞেস করছিলেন তোর খোঁজ পেলে যেন বলি,ওরা এসে তোকে নিয়ে যাবেন। ওরা ভয় পাচ্ছেন তোর কী হলো ভেবে। অবিশ্যি অনীশও ওদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, ও ওদের আশ্বস্ত করেছে আগেই যে তুই ভালো জায়গাতেই আছিস।"

আমার এইবারে আবার মাথা ঘুরতে লাগলো,সম্পাদক এইভাবে আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে? তাহলে কী করবো? কাল শেষরাতেই পালাবো? পুরীর গাড়ী ধরবো? তার জন্যেও তো ছাই টাকা দরকার। আর যদি হিমালয়ে যাই....

আমার হাতে নাড়া দিয়ে দুশমন বললো,"কী ভাবছিস রে? চল কালকে দুজনে মিলে তোর বাবামায়ের কাছে যাই।যাবি?"

আমি ছিটকে উঠে পড়লাম। নাহ,এর একটা বিহিত করা দরকার। সবাই আমার খিলাফে খেলছে।

"কী রে,রাগ কল্লি নাকি মিন্টি? কী রে?"

আমি মুখ না ফিরিয়ে খুব তেজের সঙ্গে বললাম,"যদি আমায় না খেয়ে মরতে হয়,যদি কাপড় সব ছিঁড়ে যায়,তবে শেষ কাপড়টা দিয়ে গাছের ডালে লটকে পড়বো।তবু কোনোদিন কোনোদিন কোনোদিন আর বাবামায়ের কাছে যাবোনা।"

অবাক হয়ে দুশমন বললো,"কী বলেছিলো ওরা? এত রেগে আছিস?কী করেছিলো? খারাপ কিছু বলেছিলো?মিন্টি?"

আমি আর কথা কওয়ার অবস্থায় নেই,চোখ মুছতে মুছতে কোনোক্রমে কইলাম,"কিছু না।কিছু বলেনি।কিছু করেনি।"

"তবে?মণিকাকীমা কিন্তু আমার কাছে কাঁদছিলেন।তুই ভুল বুঝছিস না তো?"

"আমায় কেউ ভালোবাসে না রে দুশমন,কেউ না। কেউ চায় না আমায়।আমি চলে যাবো।কবে থেকে মা আমায় মরতে কয়,সেই ছোট্টো থেকে।এইবারে মরে যাবো।বাপের অনেক খরচ করিয়ে গেলাম কিছু ফিরৎ দেওয়া হলোনা।ভেবেছিলাম কিছু ধারশোধ করে যাবো।হলো না।"

চলে আসছিলাম,দুশমন এসে আবার হাতটা ধরলো,আস্তে হাতে চাপ দিয়ে বললো,"মিন্টি,অভিমান করতে গিয়ে এতখানি বড়ো ভুল করিস না !তোকে ওঁরা সত্যি ভালোবাসেন,পল্টুকাকু তোর কথা কইতে গিয়ে কাঁদছিলেন। বলছিলেন কথাও তো কইতে পারে ফোনে, তাও কয় না।আমি কী করেছিলাম ওর? এইরকম করে বলেন আমায়।তুই ওদের নামে বলছিস যে ওরা ভালোবাসে না?"

ও তাহলে বেশ ভালোরকম যাতায়াত ওর আমাদের বাড়ীতে!এতদিন ধরে এত কান্নাকাটি শোনা তো অল্পের ব্যাপার নয়! উঃ,কোথায় পালাই আমি?

দুশমন বলছে, "মিন্টি শোন, তোর যদি আপত্তি থাকে বাড়ী যেতে হবে না। কিন্তু কালকে সকালে আগে তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো, তারপরে স্পোকেন ইংলিশ এর ক্লাসে নিয়ে ভর্তি করবো। আমি আটটার সময় তোর ওখানে যাবো। রেডি থাকবি তো? "

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, "আমার কাছে অত টাকা নেই রে। ডাক্তারের ভিজিট কী করে দেবো? আর স্পোকেন ইংলিশ এর ক্লাসেও ভর্তির সময়েই নিশ্চয় বেশ কিছু টাকা দিতে হয়। থাক ওসব। তোকে শুধু শুধু ডিস্টার্ব করলাম, মাফ করিস। তুই বিলেতে ফিরে যাচ্ছিস কবে? "

দুশমন এইবারে কেমন যেন রেগে গিয়ে বললো, "মিন্টি, আমি নিজে এখন তোর জন্য খরচ করি যদি, অসুবিধে কীসের? তুই পরে চাকরি পেলে শোধ করে দিস।"

আমি মাথা নাড়ি, তা হয় না।

দুশমন আরো রেগে যায়, বলে, "বন্ধু বলে মনেই করিস না বুঝতে পারলাম। ঠিক আছে। যা তাহলে চলে যা, তোর যা খুশি কর। আমারও যা খুশি তাই করবো। আমিও মণিকাকীমা আর পল্টুকাকুকে জানিয়ে দেবো তুই কোথায় আছিস কেমন আছিস। ওদেরও তো দায়িত্ব আছে একটা।"

আমি আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বললাম, "সেক্ষেত্রে ঝুলে পড়তে হবে সেই মুহূর্তেই। ওরা আসছে দেখলেই।"

ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে কী যেন পর্যবেক্ষণ করে দুশমন, তারপরে বলে, "কিছু একটা হয়েছিল, খুবই গুরুত্বপুর্ণ কিছু। নাহলে এইভাবে একেবারে কচ্ছপের মতন নিজের প্ল্যান কামড়ে আছিস কেন? যাক, নাহয় জানাবো না। কিন্তু এই ডেডলক তো কাটাতে হবে। কিছু একটা তো করা দরকার। তাই না?"

অদ্ভুত একটা অবসাদ-অবসাদ ভাব গ্রাস করতে থাকে আমাকে, আস্তে আস্তে বলি, "ঠিক আছে তাহলে নাহয় তোর থেকে ভিক্ষাই নিলাম। তোর টাকাতেই কর তবে। যদি কোনোদিন আমার সুদিন আসে, তোকে ফেরৎ দেবো, নাহলে টাকাটা তোর জলেই যাবে।"

দুশমনের মুখে হাসি ফোটে, বলে,"এই তো বেশ যুক্তির কথা বলছিস। ঠিক আছে তাহলে কালকে দেখা হচ্ছে। এখন চল তোকে একটু এগিয়ে দিই। "

দুশমন আমার সঙ্গে আসতে থাকে, এগিয়ে দেবার নাম করে একেবারে প্রায় দোরগোড়ায় এসে পড়ে। তারপরে আবার আমার হাত চেপে ধরে মিনতি করে বলে, "মিন্টি, তুই কিন্তু ভালো হয়ে থাকবি। কিছু ক্ষতি করবি না নিজের। কালকে সকালে রেডি হয়ে থাকবি কিন্তু, হ্যাঁ তো? "

আমি মাথা হেলিয়ে জানাই যে তাই থাকবো।

(চলছে)